মানুষের মন জয় করার অতুলনীয় অনুভূতি

Puja Paul

ছোট থেকেই ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন ছিলো। মা বলতো ডাক্তার হতে হলে ছোট থেকেই ভালো রেজাল্ট করতে হবে। তাই স্কুল ও কলেজ জীবনে পড়াশুনা ছাড়া অন্য কোনো দিকে মন দেই নাই। সৃষ্টিকর্তার পরম কৃপায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে চান্স পেলাম।এখানে আসার পর বেশকিছু মানুষকে সাহায্য করতে পেরেছি।মানুষকে সাহায্য করার মধ্য দিয়ে যে তৃপ্তি পাওয়া যায় তা পৃথিবীর কোন টাকা দাঁড়ায় কেন সম্ভব নয়। আমার ক্যাম্পাসের (চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ) এমন তিনটি প্রিয় অভিজ্ঞতার কথা আজ শেয়ার করব। ১. প্রত্যেক মেডিকেলে সন্ধানীর নামক একটি সংগঠন রয়েছে,যার "মূল মন্ত্র সেবাই আমাদের আদর্শ"। আমাদের চট্টগ্রাম মেডিকেলেও তার ব্যতিক্রম নয়। এটি একটি সমাজ সেবামূলক সংগঠন মেডিকেল সেন্টারে পরিচালিত হয়। এদের কাজ হচ্ছে ব্লাড নিয়ে কাজ করা। কোন রোগীর ব্লাডের প্রয়োজন হলে তারা তৎক্ষনাৎ রক্ত জোগাড় করে দেয়।এর বিনিময়ে তারা কোন টাকা নেয় না। যেহেতু ঘরে বসেই ছিলাম তাই ভাবলাম এই সংগঠনে যোগ দিন যোগ দিয়ে অনেক কিছু শিখলাম। ব্লাড প্রেসার মাপা, ব্লাড গ্রুপিং, স্ক্রিনিং টেস্ট করা, ভ্যাকসিন দেওয়াই ত্যাদি। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং আনন্দের কাজ যেটা শিখলাম তা হল কোন রোগীকে ব্ল্যাড ম্যানেজ করে দেওয়া।সাধারণত নেগেটিভ গ্রুপের ব্লাড গুলো সহজে পাওয়া যায় এবং এই ব্লাড গুলো ইমারজেন্সি মুহূর্তেই লাগে।সন্ধান তে যোগ দেই বুঝেছি মানুষের জীবনে ব্লাডের কত চাহিদা। আমাদের সন্ধানীতে প্রতিনিয়ত ব্লাডের প্রচুর রিকুইজিশন আসে যেমন ডেলিভারি পেশেন্ট, থালাসেমিয়া পেশেন্ট,অ্যাক্সিডেন্টের পেশেন্ট ইত্যাদি। শুধুমাত্র ঠিক সময়ে ব্লাড না পাওয়ার জন্য কত লোকই যে মারা যায় প্রতিদিন তার হিসেব নেই। তাই কোন রোগীকে ব্ল্যাড ম্যানেজ করে দিতে পারলে খুবই ভালো লাগে। এবং সেইসাথে ব্ল্যাড ম্যানেজ করে দেওয়ার পর রোগীর আত্মীয় স্বজনের মুখে হাসিটা দেখে তা দেখে প্রাণ ভরে যায়। জীবনের যত দুঃখ কষ্ট সব দূর হয়ে যায়। এ পর্যন্ত ব্ল্যাড ম্যানেজ করে দেওয়ায় অনেক মানুষ আমাকে মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ পর্যন্ত পড়েছে এটা যে কত বড় অনুভূতি তা বলে বোঝানো যাবে না। ২. আমার রক্তের গ্রুপ বি নেগেটিভ। সাধারণত এটি খুব রেয়ার ব্লাড গ্রুপ। একদিন সন্ধানে থেকে রাত চারটায় ফোন এলো। এক ভাই ফোন দিয়ে বলল ব্লাড দিতে পারব কিনা।তখন রাত চারটা বাজায় এবং বাসা থেকে পারমিশন দিবে কিনা তা ভেবে কিছুটা ইতস্তত বোধ করলাম। তাই বললাম সকালে দিলে হবে কিনা।তখন ভাই বলল ডেলিভারি পেশেন্ট। এক ঘণ্টার মধ্যে ব্ল্যাড ম্যানেজ না হলে বাচ্চার মা দুজনই মারা যাবে। শুনে তখনই মেডিকেলে ব্লাড দিতে দৌড় দিলাম বাসা থেকেও আর না করলো না। সেদিনই প্রথম ব্লাড দিলাম। 1 ব্যাগ ব্লাড দিয়ে একজন মা এবং একজন বাচ্চার জীবন বাঁচাতে পেরে কি যে ভালো লাগছি। রোগীর বাবা আমার মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করে বলল, "দোয়া করি অনেক বড় ডাক্তার হও"।কথাটি অনেকটা সিনেমাটিক মনে হলো সেদিন বাস্তবে ঘটনাটা আমার সাথে ঘটেছিল। সৃষ্টিকর্তার কাছে অশেষ ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি। আমাকে এই পেশায় আসার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। এমন একমাত্র মেডিকেল পেশায় এসেই আমি মানুষের খুব কাছে যেতে পারছি এবং সমাজের মানুষের জন্য কাজ করতে পারছি। ৩. লকডাউন এর শুরুর দিকে, একদিন fb তে দেখলাম চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে ত্রাণ সহযোগিতা দিবে। volunteers গ্রুপে যোগ দিলাম।প্রচারণায় অংশ নিলাম। নিজের জমানো টাকা থেকে প্রায় হাজার খানেক টাকা ডোনেট করলাম। আমাদের ব্যাচ থেকে ৫৪,০০০ টাকা উঠলো। সেই টাকার কিছু অংশ আমাদের দাদু-মাসিদের বিকাশে পাঠিয়ে দেওয়া হলো।আর বাকি টাকা এলাকার গরীব-দুঃখীদের মধ্যে বণ্টন করা হলো। ভালো লাগছিল এই ভেবে যে, ঘরে বসে অন্তত কিছু মানুষকে তো সাহায্য করতে পারলাম। ছোটবেলা থেকে মানুষের সাহায্য করার অনেক ইচ্ছা ছিল। কিন্তু টাকার স্বল্পতার জন্য ঠিক তেমনভাবে মানুষকে সাহায্য করতে পারেনি। কিন্তু একমাত্র চট্টগ্রাম মেডিকেলে এসেই শিখতে পেরেছি কিভাবে টাকা ছাড়াও মানুষকে সাহায্য করা যায়। পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তার কাছে অসংখ্য ধন্যবাদ আমাকে এই পেশায় এনে দেওয়ার জন্য, যে পেশার মাধ্যমে মানুষের খুব কাছে যাওয়া যায়। এই পেশার মাধ্যমে প্রতিনিয়তই মানুষকে সাহায্য করে যাচ্ছি এবং সেই সাথে মানুষের মন জয় করে ফিরছি।