মোহিনীর বিজয়ের গল্প

মুতাছিম নয়ন

বাড়ির সামনে সাংবাদিক জমজম করছে। সম্প্রতি শহরের স্বনামধন্য ব্যক্তি রফিকুল আলমের সুইসাইড নোটে যে ব্যক্তিকে তার মৃত্যুর জন্য দায়ী করা হয়েছে সেই ব্যক্তিকেই উদ্দেশ্য করে সাংবাদিকদের এই আনাগোনা। অভিযুক্ত ব্যক্তি চারতলা বিল্ডিংয়ের তৃতীয় তলার জানালার কেদারায় বসে সাংবাদিকদেরকে হাত নাড়িয়ে উপস্থিতির জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছেন। নিচতলায় বাড়িতে প্রবেশের পথ বন্ধ করে দিয়েছে পুলিশ। হয়তো এখনই অভিযুক্ত ব্যক্তিকে থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। পুলিশ তৃতীয় তলায় পৌঁছে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে শুধাল, "মোহিনী ম্যাম?" মোহিনী জবাব দিলো, "জি"। পুলিশ প্রধানের মিনতি, " আপনাকে একটু আর্জেন্ট থানায় যেতে হবে।" কথাটা শোনার জন্য মোহিনী বোধহয় আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। দোলনায় ঝুলতে থাকা নিজের সন্তানের দিকে আলতো চোখের ছোঁয়া দিয়ে বুয়ার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল, " ওরে দেখিস তাহলে"। মোহিনীকে সম্মানের সাথেই নিয়ে যাওয়া হলো থানায়। মোহিনী! নামের মতো সুন্দরী এই মোহিনীর জীবনে ট্রাজেডি সৃষ্টিকর্তা কতৃক লিখিত ছিল। মোহিনী অবশ্য খোদা কতৃক পাওয়া পরিহাসকে এখন গর্বের সাথেই বলে, "ভাগ্য"। কিন্তু নিছক ভাগ্য নিয়েই কি বাংলার সড়কে নব্বই ডিগ্রির মোড় ঘুরে যাওয়া গাড়ির মতো জীবনের মোড় ঘোরানো সম্ভব? অবশ্যই না। ইঞ্জিন আর বগির পাশাপাশি যে জিনিসটা একটা গাড়ির জন্য অত্যবশ্যকীয় তা হলো পেট্রোল। মোহিনীর জীবনের মোড় ঘুরে যাওয়ার ক্ষেত্রে সাজিদের কাছ থেকে পাওয়া অবিশ্বাস আর নির্মমতা থেকে সৃষ্ট ক্ষোভের প্রতিশোধী চেতনাকে পেট্রোল হিসেবে ধরা যায়। কৃষক পরিবারে জন্ম নিয়ে গ্রাম্য পরিবেশে বেড়ে ওঠা মোহিনীর সাদাসিধে জীবনে হঠাৎ লাগে ধাক্কা। বাবার কঠিন অসুখ দেখা দিলো। কৃষক বাবার কঠিন অসুখের পাথ্য ক্রয়ের টাকা যোগাড় করতে হিমসিম খেতে হলো মোহিনীর পরিবারকে। গৃহস্থালির এটা ওটা বেঁচে যা টাকা হয়েছে তা কেবল ঔষধ ক্রয়ের পিছনেই গেছে; উন্নত চিকিৎসার কিছু হয় নি। মোহিনী বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। যে পরিবারের কর্তার অসুখ নিরাময়ের অর্থ জোটে না সে সে পরিবারের একমাত্র সন্তানকে তো রোজগারের পথে নামতেই হয়, তা সে ছেলে হোক অথবা মেয়ে। মোহিনীকেও তাই করতে হলো। কিন্ত সদ্য দশম শ্রেণিতে ওঠা গ্রামের এই মেধাবী সুন্দরী ছাত্রী কীভাবে নিজের গ্রামেই রাতারাতি কাজের মেয়ে হয়ে যাবে এই চিন্তায় মোহিনীর মস্তিষ্কে সমাধান এলো খুব দ্রুতই। সে জানতো, জেএসসি পাস করেই বাংলাদেশের গার্মেন্টসে চাকরি করা যায়। মোহিনী শহরে যেতে উদ্যোত হয়। কিন্তু বাবা-মা কি মেয়েকে এভাবে পাঠাতে পারেন? অসুখে কোনো বাবা-মা মরে গেলেও মেয়েকে এভাবে একাকী শহরে পাঠাতে পারেন? কিন্তু মোহিনী কারোর কথাই শুনলো না। কারণ সে জানে, শুধু বাবার অসুস্থতার জন্যই না বরং রোজগার করতে না পারলে মা ও তাকে ক্ষুদার জ্বালায় ছটফটিয়ে মরতে হবে। মোহিনী ঢাকা শহরে এসে উপস্থিত। কিন্তু কোথায় গার্মেন্টস, কোথায় কর্মসংস্থান কিছুই সে প্রথম দিনে ঠাহর করতে পারলো না। সন্ধ্যার সময় ক্লান্ত মোহিনী বসেছিল ফুটপাতের পাশে একটা স্তম্ভের উপরে। কোত্থেকে একটা আধবয়সী পুরুষ এসে মোহিনীকে বলল, "কে তুমি মা? এখানে এভাবে বসেছ কেন?" মোহিনী এই অপরিচিত জন জোয়ারের শহরে অচেনা মানুষের মধ্যে কারোর কাছ থেকে "মা" ডাক শুনবে কল্পনাও করতে পারে নি। আবেগ আপ্লূত হয়ে কেঁদেই ফেলল মোহিনী। বলল, "আঙ্কেল, বাবা ভীষণ অসুস্থ। টাকার দরকার তাই আইছি।" আগন্তুক ছোট্ট একটা হাসি দিয়ে অতি আন্তরিকতার সাথে বলল, "আরে তুমি কাঁদছ কেন? তুমি ঠিক জায়গায় এসেছো। আমিও মানুষ খুঁজছি।" কথাটা শুনেই মোহিনীর মলিন মুখে হাসির রেশ চলে এলো। পরক্ষণেই আগন্তুকের ডাকে সাড়া দিয়ে তাকে অনুসরণ করার কারণে হাসতেও পারলো না মনখুলে। মোহিনীকে নিয়ে যাওয়া হলো একটা চারতলা বিল্ডিংয়ের তৃতীয় তলার একটা ঘরে। সেটাকেই বলা হলো অফিস। অফিসে মাত্র দু'জন কর্মচারী আর কিছু কাগজপত্র। কর্মচারীদেরকে বাইরে বের করে দেওয়া হলো। মোহিনী ভয় পেল। তার একটু সন্দেহ হতে লাগলো মানুষটার উপরে। কিছু বলার আগেই তার সার্টিফিকেট দেখা হলো যত্ন সহকারে। আগন্তুক ব্যক্তি এবার নিজের পরিচয় দিলেন। বললেন, "হাই, আমি নিজাম সাজিদ। নারী আমার ব্যবসা। কিন্তু ভয় নেই। চৌদ্দ পুরুষ তোমাকে ছুঁবে না। শুধু আমি ছুঁবো।" মোহিনী পালানোর জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই খপ করে তার হাত ধরে ফেলল সাজিদ। চিৎকার করার আগেই দেখানো হলো ধারালো ছুরি। ঘরের দরজা বন্ধ করা হলো সহসাই। সারাদিন না খাওয়া মেয়েটির উপর শুরু হলো এবার যৌন নির্যাতন। প্রায় ঘন্টা খানেক পরে পিশাচের অত্যাচার থেকে মুক্তি পেল মোহিনী। তবে তা সাময়িক। নরপিশাচ সাজিদ মোহিনীর শরীর থেকে উঠে পাঁচশ টাকার একটা নোট বের করে বলল, "দে তোর বাপের নম্বর দে, কাল পাঠিয়ে দেবো। এ মাসে আর পাঁচশ পাবি।" এভাবে দিনের পর দিন ধর্ষিত হতে থাকে মোহিনী। চারতলা বিল্ডিংয়ের তৃতীয় তলার এই ঘরটা বাইরে থেকে তালাবদ্ধ করে সাজিদ যখন তার মূল ব্যবসা অর্থাৎ পাঁচ কিলোমিটার দূরের পতিতালয়ে যেত তখন মোহিনী চিৎকার চ্যাঁচামেচি করে বাইরের মানুষকে জানানোর চেষ্টা করতো। কিন্তু তাতে খুব একটা লাভ হতো না। আয়নায় দাঁড়িয়ে মোহিনী প্রায় প্রতিদিনই চমকে ওঠে। শরীরে, মুখে ক্ষতচিহ্ন তার চেহারাকে বিকৃত করে দিয়েছে। মোহিনী তবুও সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানায় এই কারণে যে, সে বেঁচে আছে এবং বাবাকে কিছুটা সাহায্য করতে পারছে। সপ্তাহে মাত্র একদিন তার মায়ের সাথে তাকে কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয়। সে বলে যে, "ভালো চাকরি পেয়েছি।" তাকে এর বেশি কিছু বলার সুযোগও দেওয়া হয় না। এভাবে কাটতে থাকে দিন। একসময় মোহিনীকে নিজের স্ত্রী বলে পরিচয় দেয় সাজিদ। অথচ গলিতে গলিতে তার এমন অসংখ্য "স্ত্রী" আছে বলে খবর পায় মোহিনী। তাকে এ সময় এসব খবর দেয় নুমান নামের সাজিদের এক কর্মচারী। এই কর্মচারীর সাথে সখ্যতা গড়ে ওঠে মোহিনীর। এরই মধ্যে গর্ভবতী হয়ে যায় মোহিনী। কিন্তু নরপিশাচের নির্যাতন থামে না। পৃথিবীর মুখ দেখার আগেই মারা যায় গর্ভের সন্তান। প্রচন্ডভাবে ভেঙে পড়ে মোহিনী। বদ্ধঘরে একাকী জীবন দিনকে দিন দূর্বিষহ হয়ে ওঠে তার। এমতাবস্থায় সে খাতা কলম নিয়ে বসে যায় বিরহী জীবনের কাহিনি লিখতে। মোহিনী কবিতা লেখে। প্রতিদিনকার নির্যাতনের বিবরণ সে খুব সুচারুরূপেই লেখে। এ লেখা সে সাজিদকে দেখায় না। লুকিয়ে রাখে। লুকানোর কাজে তাকে সাহায্য করে নুমান। এভাবে কাটে সাত বছর। এরপর একদিন নিরাপত্তা বাহিনীর অভিজানে গ্রেফতার হয় সাজিদ। কিন্তু টাকার দাপটে সে জেল থেকে ছাড়া পায়। ছাড়া পেয়েছিল সাময়িক সময়ের জন্য। তাই তাকে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হতো। কিন্তু টাকার কাছে হেরে যায় দেশের আইন। সাজিদ হয়ে ওঠে দেশের অন্যতম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। এদিকে মোহিনীর বিল্ডিংয়ের তিন তলার সেই রুমটাকে বিনা ভাড়ায় মোহিনীকে থাকার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। আর সাজিদ যেমন হয়ে ওঠে অন্যতম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব তেমনি মোহিনী হয়ে ওঠে সাহিত্য জগতের এক জনপ্রিয় নাম। নুমানের সহযোগিতায় লেখালেখি প্রকাশ করার সুযোগ পায় মোহিনী। নুমান সাহিত্য নিয়ে মোটামুটি ঘাটাঘাটি করতো। মোহিনীর প্রকাশিত প্রথম ও জনপ্রিয় কবিতা "মুক্তি"। এরপর ধীরে ধীরে প্রকাশিত হতে থাকে মোহিনীর একের পর এক লেখা। সাহিত্যিকদের আনাগোনা শুরু হয় মোহিনীর বাড়ি ঘিরে। কালক্রমে জনপ্রিয় হয় ওঠেন লেখিকা মোহিনী। তার সর্বশেষ  প্রকাশিত লেখা উপন্যাস  "মোহিনীর ঘুরে দাঁড়ানো গল্প"। এই উপন্যাসে নিজের জীবনের সাথে ঘটা ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন লেখিকা মোহিনী। আর এ বইটা পড়ে জলে পুড়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন প্রখ্যাত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সাজিদ। আর মৃত্যুর আগে নোটে মৃত্যুর জন্য দায়ী করে গেছেন মোহিনীকে। এই অভিযোগে মোহিনীকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যাওয়া হলে ভ্যাবাচ্যাকা খেতে হলো আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর পুরো ইউনিটকে। কেননা, "মোহিনীর ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প" উপন্যাসের নায়কা চরিত্র লেখিকার নামে থাকলেও পিশাচ চরিত্রের নাম ছিল "সাজ্জাদ"। থানা থেকে সহাস্যে বেরিয়ে পড়লো মোহিনী। বাইরে বেরিয়ে সে অবাক হয়ে গেল। দেখলো, একজন মন্ত্রী তাকে সম্বর্ধনা দিতে এসেছেন। আমজনতা থেকে শুরু করে উপস্থিত সবার মুখেই মোহিনীর সাহসিকতার প্রশংসা হচ্ছে। মোহিনীর এই বিজয়ের দিনে সাধারণের উল্লাসে কয়েকবার কেঁপে উঠলো শহরটা। মোহিনী হাত নেড়ে সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে রাস্তার একপাশে অপেক্ষারত নিজের স্বামী নুমানকে বলল, "চলো ফেরা যাক।" লেখাঃ-মুতাছিম নয়ন। ইমেইলঃ- Mutasimnayon30@gmail.com