মিজানুর রহমান বেলাল
পিতার বাইসাইকেল - মিজানুর রহমান বেলাল প্রাচীর ঘেরা টিনশেডের বাড়ি। বাড়ির লম্বা বারান্দা। বারান্দার নিচে মস্তবড় আঙিনা। আঙিনায় হাঁটুমুড়ে বসে-মহসীন মন্ডল বাইসাইকেল পরিস্কার করছে। বাইসাইকেল পরিস্কার শেষে তৈল মালিশ করে। তৈল মালিশ নিয়ে প্রতিদিন মধুর সাথে রসাত্মক ঘটনার সৃষ্টি করে। মধু মন্ডলের বাড়ির কাজের ছেলে। মহসীন মন্ডলের স্ত্রী সুমী বেগম অথিষ্ট হয়ে গেছে। সুমী বেগম বাধা দেয়। মানুষ হাসাহাসি করে। তবুও মন্ডল নিজের শরীরে তৈল না মেখে সাইসাইকেলে তৈল মালিক করে। মহসীন মন্ডলের হাড়কিপ্টের কথা সাতপাড়া জানে। মটরসাইকেল, প্রাইভেট কার কেনার সামর্থ্য থাকলেও বাইসাইকেল নিয়ে প্রতিদিন সাত গ্রাম ঘুরে। তিন দশক ধরে এমন ঘটনায় মন্ডল ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। রবি মন্ডলের বোনের জামাই। প্রচন্ড রসিক। মন্ডলের বোন মোনা রবির রসিকতার কারণে আর ভাইয়ের হাস্যত্মক সব ঘটনার কারণে লজ্জায় ঘরবন্দি হয়। স্বামী ও ভাইয়ের ব্যঙ্গত্মক কাজকর্ম থামানোর জন্য ভাবি সুমীর সাথে জোট করে। ৭ দফা ইশতেহার পেশ করে-তবুও চলতে থাকে তাদের কাজকর্ম। মহসীন মন্ডল নিজেকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জ্ঞনী মানুষ হিসেবে দাবি করে। চিকন বুদ্ধির স্রষ্টা হিসেবে দাবি করে। একদিন বাইসাইকেল নিয়ে গঞ্জে যাবার সময়, ১টি কাক মন্ডলের মাথায় পায়খানা করে দেয়। এই নিয়ে মন্ডল গ্রামে মাইক দিয়ে প্রচার করে-কাক ধরার ঘোষণা দেয়। ব্যান্ডপার্টি দিয়ে সারা গ্রাম আলোড়ন তুলে। পাখি শিকারিদের ভাড়া করে আনে। কাক ধরে কাকের লেজ কেটে দেয়। এমন রকম নানান ঘটনার জন্য পাড়া, মহল্লা, হাট-বাজারে আলোচিত হয়ে ওঠে মন্ডল। মাহতাব খান হাইস্কুলের মাস্টার। মন্ডলের প্রতিবেশী। মন্ডলের সমালোচনা করে সময় কাটায়। স্কুল থেকে কখনোই কোন ছাত্র এস.এস.সি. পাশ করে না। তাই মাহতাব খানের নাম ‘রাখাল মাষ্টার’ হিসেবে প্রচার করে মন্ডল। খান আর মন্ডল বংশ গৌরব নিয়ে দ্ব›দ্ব দিনে দিনে বেড়ে যায়। দু’জনই আমেরিকার প্রেসিডেন্টের চেয়ে মেধাবী হিসেবে দাবি করে। একে অন্যের কূটোক্তি করতে থাকে। মাষ্টার ও মন্ডল দু’জনের মধ্যে কে বেশী বুদ্ধিবান; শ্রেষ্ঠতের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেই দুজনই। এক পর্যায়ে মন্ডল গোপনে প্রচার করে- মাষ্টারের মরিচ ক্ষেতে মাটির নিচে ম্যাগনেট পিলার আছে। রাতের অন্ধকারে পিলার সন্ধানী’রা মরিচ ক্ষেত পুকুর বানিয়ে দেয়। তবুও পিলার পায় না। মাষ্টার জ্ঞানশূন্য হয়ে যায়। মন্ডলের কাছে হেরে গেছে বুদ্ধিতে। তাই, মাস্টার বুদ্ধির ছক নতুন করে সাজাতে থাকে। অন্যদিকে, জীবন নগরের চেয়ারম্যান কুতুব খান। অনেক ভালো মানুষ। শান্ত ও বুদ্ধিবান প্রকৃতির। চেয়ারম্যানের ছেলে স্বজল মাষ্টারের বোন সোহাগীকে পছন্দ করে। কখনো মেঠোপথ, কখনো বটবৃক্ষের ছায়ায়, কখনো নদীর পাড়ে- স্বজল দাঁড়িয়ে থাকে সোহাগীর জন্য। সোহাগীও স্বজলকে পছন্দ করে। কিন্তু মাষ্টার ও মন্ডলের চোখ ফাঁকি দিয়ে সম্পর্ক গড়ে তুললেও মন্ডল প্রেমকাহিনি নিয়ে পোষ্টারিং করে। মাষ্টারও চাপে পড়ে এলাকায়। কুতুব চেয়ারম্যান- মাষ্টার ও মন্ডলের দ্বন্দ থামাতে নানান উদ্যোগ নেয়। চলতে থাকে উত্তেজনা। লুসু পাগল বীর মুক্তিযোদ্ধা। সারাদিন বাঁশি বাজায়-গ্রামে, গঞ্জে, পাড়া-মহল্লায়। পাঁজারে হাত রেখে, চোখ বন্ধ করে বলে-বাংলাদেশ তার বুকে। তার বুকে দেশপ্রেম কিলবিল করে। বাংলাদেশকে নিয়ে কেউ কোন নেগেটিভ মন্তব্য করলে-বাঁশি বাজাতে বাজাতে তাড়া করে। মন্ডলের বাইসাকেলকে লুসু পাগল খুব ভালোবাসে। হাত রেখে আদর করে। লুসু পাগল বটের ছায়ায় শুয়ে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে। বঙ্গবন্ধুর ৭মার্চের ভাষণ স্মৃতিচারণ করে আর সারা গ্রাম বঙ্গবন্ধুর কথাগুলো ভাষণ দেয় আর বাঁশি বাজায়। লুসু মন্ডলের এই সাইকেলে নাকি অনেক প্রাণ লেগে আছে। লুসু, পাগল বলে তার কথার কেই গুরুত্ব দেয় না। মাস্টারকে লুসু পাগল দেখলেই অদ্ভূত আচারণ করে। একদিন মাস্টারকে তাড়া করে পানিতে নামিয়ে ফেলে। মহসীন মন্ডল নানান ঝামেলা ও অহংকারমূলক আচরণ করলেও বউ সুমীকে ভীষণ ভালোবাসে। সুমীকে জন্মদিনে লকেট উপহার দেয়। জ্যোৎস্না রাত, বাঁশবাগানে তরুণ- তরুণীর মতো ভালোবাসার খোষগল্প করে। সিনেমার নায়ক-নায়িকার মতো গান গায়। সুমী বেগমও অবাক হয় মন্ডলের আচরণে। কখনো রাগারাগি কখনো প্রেমিকরাজ হয়ে যায়। মন্ডলেল আচরণ ওঠানামার মধ্যে এগিয়ে যেতে থাকে। মাহতাব মাষ্টার ভাড়াটে বখাটে ছেলেদের ভাড়া করে; রাতের অন্ধকারে মন্ডলের বাইসাইকেল মেড ইন জাপান ভেঙে টুকরো টুকরো করে বটগাছে ঝুলিয়ে রাখে। মন্ডল বাইসাইকেল নিয়ে অনেক অহংকার করে। তাই তার অহংকার মাটিতে নামিয়ে আনতে এমন কাজ করে। মহসীন মন্ডল সকালে ঘুম থেকে ওঠে দ্যাখে-তার বাইসাইকেল মেড ইন জাপান ভাঙ্গা, ভাঙ্গা টুকরোগুলো বাড়ির উঠোনের বটগাছে ঝুলানো। দৃশ্যটা দেখে মহসীন মন্ডল বাম পাঁজর ধরে বসে পড়ে। চিৎকার কর মহিলাদের মতো কাঁদতে থাকে। কান্না জড়িত কণ্ঠে বলে-কোনো তাকে হত্যা করলো না। হত্যা করলেও এতো কষ্ট পেতো না। কারণ, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু এই বাইসাইকেলে উঠেছিলো। বঙ্গবন্ধুর স্পর্শ আছে এই বাইসাইকেলে। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত রেখে যাওয়া সাইকেল ওটি। সেই সাথে মুক্তিযোদ্ধা পিতার স্মৃতি লালন করতো গোপনে। মহসীন মন্ডলের পিতা করিম মন্ডল ডাক্তার ছিলো। আহত মুক্তিযোদ্ধার এই সাইকেল দিয়ে সেবা করতো। পিতার মৃত্যুর সময় এই সাইকেল দিয়েছিলো। মহসীন মন্ডলের আহাজারি দেখে, সুমী বেগম, মোনা, মধু, রবিও কেঁদে ওঠে। গ্রামের অনেক মানুষ মন্ডলের বাড়িতে ভীর করে। মন্ডলের কান্না দেখে সবাই কান্না দেয়। মাহতাব মাস্টার নারিকেল গাছে ওঠে কান্নার দৃশ্যগুলি দ্যাখে। তখনি থীমগান বেজে উঠে-‘পিতার বাইসাইকেল ... মাহতাব মাস্টার সবার কান্নার দৃশ্য দেখে-অনুতপ্ত হয়। নিজেকে অপরাধী মনে করে ভেতরে ভেতরে। মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন দ্যাখে। রাতে ঘুমাতে পারে না। লুসু পাগল মাস্টারকে তাড়া করে ঘুমের ঘোরে। পরের দিন মাস্টার গোপনে মন্ডলের বাইসাইকেল মেকার দিয়ে ঠিক করে রেখে যায় মন্ডলের বাড়িতে। মন্ডল দেখে ফেলে দৃশ্যটি। মÐলও অনুতপ্ত হয়। চেয়ারম্যানের ছেলে স্বজলের সাথে মাস্টারের বোন সোহাগীকে বিয়ের ব্যবস্থা করে মন্ডল। মন্ডল ও মাস্টার অতীতে খুব ভালো বন্ধু ছিলো। শুধু মাত্র অহংকার, ঈর্ষা, ছোটখাটো ভুল বোঝাবুঝির কারণে সম্পর্ক খারাপ হয়েছিলো মাঝখানে। তাই অহংকার, ঈর্ষা, ছোটখাটো ভুল, দাম্ভিকতার কারণে কারো বন্ধুত্ব ভেঙ্গে যাতে না যায়, সেই দিকে সবাইকে লক্ষ্য রাখতে বলে। বন্ধুত্বের সম্পর্ক খারাপ হবার কারণেই চির শত্র“র জন্ম হয়েছে যুগে যুগে। কথাগুলো প্রচারে মন্ডল ও মাস্টার এক সাথে সাইকেলে চড়ে-মেঠোপথ দিয়ে গঞ্জে যেতে থাকে। অবশেষে, মাস্টার ও মন্ডলের দ্বন্দের অবসান হয়। গোধূলির সূর্য্য সোনার থালার মতো সাইকেলের চাকায় সে পড়ে। তখনি-থীমগান বেজে ওঠে; পিতার বাইসাইকেল....মুক্তির বাইসাইকেল.... সমাপ্ত