Kabir Kanchon
আমি একজন শিক্ষক কবির কাঞ্চন শূন্যহাতে বাড়ি থেকে বের হয়ে সোজা এসে শীপে উঠলাম। এমুহূর্তে লক্ষ্য একটাই- পরিবারের সবার মুখে হাসি ফোটানো। ক'দিন আগেই বাংলাদেশ বিমানবাহিনী থেকে অসুস্থতাজনিত কারণে চাকরি হারিয়ে বাড়ি ফিরেছি। স্বজনরা কেউই আমায় বুঝতে চায়নি। কাছের মানুষদের দূরে সরতে দেখেছি। অর্ধমৃত জীবনের শেষ সম্বল এইচএসসি'র সনদপত্রকে পুঁজি করে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। উত্তাল মেঘনার এক একটা ঢেউ যেন আমার বুককে বিদীর্ণ করে দূর অজানায় মিশে যাচ্ছে। সদরঘাটে নেমে মহাচিন্তায় পড়ে গেলাম। 'কোথায় উঠব? নিকটাত্মীয় বলতে এখানে কেউই নেই।' হঠাৎ জাফর কাকার কথা মনে হলো। হালিশহরে লজিং থাকেন। ফোনে পরিচয় দিতেই ওপার থেকে তিনি বললেন, - হ্যালো, ভাতিজা, কোথায় আছ? - কাকা, সদরঘাটে। - চট্টগ্রামে! - জ্বি, কিন্তু ---। - কিন্তু কী? - আমার থাকার জায়গা নেই! - একি কথা! তুই হালিশহর চলে আয়। আমি অপেক্ষা করছি। - আচ্ছা। এরপর সিএনজি যোগে জাফর কাকার লজিং বাসায় পৌঁছলাম। সেখানেই আমার সাময়িক থাকার জায়গা হলো। একদিন তিনি বললেন, - ভাতিজা, সাথে টাকা-পয়সা কিছু আছে? - জ্বি, ৫০০টাকা আছে। আমার একটি লজিং খুব দরকার। - ঠিক আছে। কাল থেকে খোঁজা শুরু করব। প্রথম দুইদিন জাফর কাকার ওখানেই খেলাম। নিজের কাছে লজ্জা লাগছিল। এরপর হোটেলে খাওয়া শুরু করলাম। খুব হিসাব করে চলতাম। দিনে কোনভাবেই চল্লিশ টাকার বেশি খেতাম না। সকালে দু'টো সিংগাড়া, দুপুরে আলু ভর্তা-ডাল, রাতে উপবাস থেকে দশদিন পার করলাম। হাতের টাকাও প্রায় শেষ। এরইমধ্যে একাদশতম দিবসে এসে আমার একটি লজিং হলো। থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হওয়ায় কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। শিক্ষার্থীদের পড়ানোর পর বাকি সময়টা নিজের পড়াশুনায় মনোনিবেশ করতাম। অল্প কয়েকদিনের মধ্যে এলাকায় আমার নামডাক হয়ে যায়। দু'টো টিউশনিও হয়। আমার সমবয়সীরা যখন খেলাধুলা কিংবা বিনোদনে মেতে থাকতো আমি তখন বই নিয়ে পড়ে থাকতাম। এরপর অনার্সে ভর্তি হলাম। দেখতে দেখতে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষ পার করলাম। তৃতীয় বর্ষের সময় আমার বাড়ির পরিস্থিতি খুবই খারাপ হয়ে যায়। বাবার ব্যবসা আগের মতো নেই। আমার ভাইবোনদের স্কুলে পড়াতে হিমশিম খাচ্ছেন। তারওপর নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছিল আমাদের বাপ-দাদার সহায়-সম্পত্তি। খুবই দুশ্চিন্তাগ্রস্থ অবস্থায় বাবাকে দূর থেকে সাহস জোগাতাম। একদিন টিউশনি থেকে এসে ক্লান্ত শরীরে শুয়ে আছি। এমন সময় জাফর কাকা এসে আমায় একটি পত্রিকা দিয়ে বললেন, - ভাতিজা, এখানে পরীক্ষা দে। স্কুলটা নামকরা। আমার বিশ্বাস, তুই টিকবি। জাফর কাকার কনফিডেন্স আমাকে আরো উজ্জীবিত করলো। চাকরির পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে প্রথম হলাম। চাকরিও হলো। চাকরি জীবনের প্রথমদিনটি ছিল আমার সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতার। শিক্ষার্থীদের মাঝে অর্জিত জ্ঞান বিলিয়ে দেয়ার এমন সুযোগ আমাকে আপ্লূত করেছিল। আমি যতই পড়াচ্ছিলাম ততই চমকিত হচ্ছিলাম। আমার ভেতরে একধরনের আনন্দের অনুভব হয়। মাসখানেকের মধ্যে পুরো স্কুলে আমার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা আমার কাছে পড়ানোর প্রস্তাব নিয়ে আসে। আমি যেখানে পড়াচ্ছি তা বাংলাদেশের ব্যস্ততম এলাকাগুলোর মধ্যে অন্যতম। ইপিজেড এলাকা হওয়ায় এখানে লাখো মানুষের বসবাস। এদের বেশিরভাগই শ্রমজীবী। নিম্ন আয়ের। আমার চোখে তারা একেকজন স্বপ্নবাজ। গার্মেন্সে স্বল্প বেতনে চাকরি করলেও সন্তানদের নিয়ে মধুর স্বপ্ন দেখেন। তাদের আশা - নিজেদের রক্ত-মাংস, ঘামে সন্তানেরা যেন মানুষ হয়। মনে মনে ভাবলাম, তাদের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে আমিও কিঞ্চিৎ ভূমিকা রাখতে পারি। কিন্তু শুধু স্কুলে তা সম্ভব নয়। আমার একান্ত অবসরে ওদের জন্য কিছু করব। হঠাৎ মাথায় আসে- স্কুলের পাশে একটি কোচিং সেন্টার গড়ে তোলার। যেখানে শিক্ষার্থীদের আলাদা সময় দেয়া যাবে। সাথে কিছু মেধাবী ফ্রিল্যান্সারের কর্মসংস্থানও হবে। একদিন দুপুরের খাবার খেয়ে একটু ঘুমাতে চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু আমার চোখে ঘুম নেই। কোন এক অজানা আকাঙ্খা আমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। বিছানায় শুয়ে এপাশওপাশ করছিলাম। একসময় ওঠে বসে টেবিলের ওপর থেকে জগটা টেনে নিয়ে ডগডগ করে কয়েক গ্লাস পানি খেলাম। এরপর গভীর মনোযোগ দিয়ে একটা ছক তৈরি করলাম। সেই ছক মোতাবেক একটি রুম ভাড়া নিলাম। আর যেসব শিক্ষার্থী আগে বলে রেখেছিল তাদের পড়ানোর সময় দিলাম। শুরু হলো আমার ব্যস্ত জীবনের অধ্যায়। সকালে লজিং বাসায় পড়িয়ে স্কুলে যেতাম। তারপর একটানা ছয়ঘন্টা ক্লাসের পর ক্লাস চালিয়ে যেতাম। স্কুল থেকে বেরিয়ে হাল্কা নাস্তা করে আবার কোচিং-এ পড়াতাম। সন্ধ্যা ছয়টার দিকে লজিং বাসায় ফিরতাম। এভাবে বছরখানেক পার হলো। এরইমধ্যে আমার কোচিং-এর ছাত্রসংখ্যা শতাধিক হয়ে গেল। কোচিং-এর জন্য আরো দু'টো রুম নিলাম। সেইসাথে পরিবারের অার্থিক অবস্থা নাজুক অথচ মেধাবী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া কয়েকজন শিক্ষার্থীকে আমার সাথে নিলাম। প্রতিদিন ক্লাস শেষে তাদের সাথে পরবর্তী দিনের কার্যক্রম নিয়ে সংক্ষিপ্ত মিটিং করতাম। আমার অধীনে থাকাদের কঠোর পরিশ্রম আর ধৈর্য ধরে শিক্ষার্থীদের জীবনের লক্ষ্য পূরণে ভূমিকা রাখার তাগিদ দিতাম। পরিকল্পনা মোতাবেক সবকিছু এগুতে থাকে। আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা সফল হতে লাগলো। শিক্ষার্থীদের ফলাফল প্রত্যাশার চেয়ে ভালো হতে লাগলো। কোচিং থেকে ভালো ফলাফল করে বের হওয়া শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা এলাকায় আমাদের একটা নেটওয়ার্কের মতো কাজ করে। একসময় মনে হলো কোচিংকে সাধারণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে এ্যাডভারটাইজিং প্রয়োজন। সেলক্ষ্যে লিফলেটও বের করলাম। এতোদিনে কোচিং-এর একটা নামও হলো। 'এন এক্সিলেন্ট টিচিং হোম'। এরইমধ্যে লক্ষ্য করলাম আমার পেছনে কিছু প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে। সাথে প্রতিযোগিতাও। আমি কখনও সেসব নিয়ে পড়ে থাকিনি। সবসময় আত্মবিশ্বাসী হয়ে এগিয়ে গিয়েছি। শিক্ষার্থীদের সহজতর করে পড়ানোর চেষ্টা করতাম। যতক্ষণ কোচিং-এ থাকতাম ততক্ষণ পড়ানো নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম। কাজের প্রতি আমার আন্তরিকতা দেখে আমার সাথের শিক্ষকরাও তাদের কাজে গভীর মনোনিবেশ করতেন। দিনেদিনে আমার কোচিং-এর শিক্ষার্থী সংখ্যা বাড়তে থাকে। শিক্ষার্থীসংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে আমি আমার অধীনস্থদের সম্মানীও বাড়িয়ে দিতাম। এতে তারা খুশি হয়ে আরও মনোযোগী হতো। আমারও খুব ভালো লাগতো যখন দেখতাম তারা আমার দেয়া সম্মানী দিয়ে নিজেদের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিচ্ছে । কোচিং-এর শিক্ষার্থীর হার বাড়ার সাথে সাথে বিনামূল্যে পড়ুয়া শিক্ষার্থীর হারও বাড়তে থাকে। দিন শেষে ক্লান্ত শরীরে যখন বাসায় ফিরি তখন শিক্ষার্থীদের এক একটা সফল মুখ আমার মনে প্রশান্তি নিয়ে আসে।