লেখক হয়ে ওঠার গল্প

ফাহাদ হোসেন ফাহিম

স্বপ্ন প্রতিটা মানুষেরই থাকে। কখনো লুকিয়ে থাকে বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে, কখনো বা নীল আকাশে এক টুকরো মেঘ হয়ে। প্রকৃত অর্থে স্বপ্ন ছাড়া মানুষ হয় না। আমার জীবনের স্বপ্ন হচ্ছে মাঝি হওয়া। কখনো উত্তাল জলস্রোত, কখনো বা মেঘলা দিনে মাথায় গামছা বেঁধে নৌকো নিয়ে বেড়িয়ে পড়ব। তারপর " মন মাঝি তোর বৈঠা নে রে আমি আর বাইতে পারলাম না..." গান গাইতে গাইতে নৌকার বৈঠা নেড়ে একদিন পাড়ি জমাব জলজ নদীর রাজ্যে। সেই খুশিতে আমার মন গেয়ে উঠবে, " যাব না আজ ঘরে রে ভাই যাব না আজ ঘরে, আকাশ ভেঙে বাহিরকে আজ নেব রে লুট করে। " কিন্তু সভ্য সমাজ কি মেনে নেবে আমায়? সমাজে কি মূল্য আছে একজন মাঝির? সমাজের এতসব হিসেবের ভিড়ে হয়ত একসময় হারিয়ে যাবে আমার শৈশবের চপল মনের সেই স্বাধের স্বপ্ন। তবে সমাজ নৌকার পরিবর্তে আমার ছোট্ট মাথায় চাপিয়ে দিলো প্লেনের বহর। বলতে লাগলো, " ইউ মাস্ট বি এ পাইলট ইন্সটিয়েট অব বোটম্যান।" আমি যখন বলতাম " কেনো? " সমাজ বলে, " দে আর জাস্ট ইলিটারেট।" কিন্তু আমার অমিত ইচ্ছা যে নৌকা নিয়ে ভেসে বেড়াব নদীকান্তের এ পার হতে ওপার। সেই ভাবনার জগৎ একান্তই আমার। মুখে প্লেনের কথা বললেও মনের গহীনে ছিল সেই ভরদুপুরে নদীতে নৌকা নিয়ে বের হবার স্বপ্ন। কিন্তু সময়ের সাইক্লোসিসে হারিয়ে গেলো শৈশবের পথহারা প্লেন এবং নৌকা দুটোই । হ্যাঁ, হারিয়ে গেলো আমার কৌতূহল। কিন্তু হারায় নি প্যাশন এবং ঘুমন্ত স্বপ্নরা। ভাবছেন কিভাবে? চলুন তাহলে গল্পটা বলি। ঢেউখেলানো নধরদেহী নদী শীতলক্ষ্যা। উদ্দাম ঢেউ, ভাঙন ও তার বুকের পলি জমে পূর্ব পাড়ে মফস্বল বন্দরের উপকণ্ঠ। শ্রাবণের এক মেদুর সন্ধ্যায় (২৯ শ্রাবণ ১৪০৭ বঙ্গাব্দ) নারায়ণগঞ্জ জেলার বন্দর উপজেলায়ই আমার জন্ম। বেড়ে উঠেছি এখানেই। লেখালিখির হাতেখড়ি স্কুল জীবনেই। তবে আত্মপ্রকাশ ঢাকা কলেজের ছাত্রাবস্থায়। ছড়া, কবিতা, গল্প, রম্য রচনাসহ লিখছি নানা বিষয়ে। স্বাচ্ছন্দ্য সম্ভোগের বিষয় কথাসাহিত্য। সেদিন পড়ন্ত বিকেলে পুরনো একটা কাগজ খুঁজতে গিয়ে হাতে আসে ময়লাঠাসা ধূসর রঙের ডাইরিটা। মার্জিনের উপরে লাল কালিতে বড় করে লেখা ছিল, " স্বপ্ন "। সময় পেলেই লিখতে বসি। ছোটকাল থেকেই লিখতাম। মনের সব কথাগুলো জমিয়ে রেখে দিতাম কালি কলমের সিন্দুকে। তবে লেখালিখির প্রতি বিশেষ আগ্রহ জন্মাতে লাগে যখন ২০১৩ সালে আমার নিজ জেলা নারায়ণগঞ্জে আমার লেভেলে ( জুনিয়র ক্যাটাগরি-তে ) " ভাষা ও সাহিত্য "- এ শ্রেষ্ঠ নির্বাচিত হলাম। তার ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালে শ্রেষ্ঠ নির্বাচিত হয়েছিলাম সিনিয়র ক্যাটাগরিতেও। এরপর ছড়া, কবিতা, রচনা, প্রবন্ধ, নিবন্ধ ইত্যাদি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে করতে একসময় শুরু করে দিলাম লেখালিখি। প্রসারিত হতে লাগলো চিন্তার জগৎ। Carson Mccullers এর তাই লিখেছিলেন, " The writer by nature is a dreamer, a conscious dreamer." লেখালেখির সংসর্গে এসে অনুভব করতে লাগি চিন্তা এবং কল্পনার গুরুত্ব কতটা সুদুরপ্রসারি। এতটাই যে আইনস্টাইন জোর গলায় বলেছেনঃ " Imagination is more important than knowledge. For knowledge is limited to all we now know and understand, while imagination embraces the entire world, and all there ever will be to know and understand." তাই, লিখে রাখতাম যা আসতো মনে, লেখক হবার স্বপ্ন, হিয়ার অন্তরালে বৃহৎ হচ্ছিল গোপনে গোপনে। দু' পাতা উল্টোতেই চোখে পড়ল উপরের লেখাগুলো। ভাবতে লাগি কি অদ্ভুত মানুষের জীবন! সবকিছুর ভিড়ে লুকিয়ে লুকিয়ে লেখালিখিটাই যে নৌকা এবং প্লেনের জায়গা দখল করে নিবে, কে জানতো সেটা। জীবনের সব স্বপ্নই আজ দুঃস্বপ্ন শুধু লেখালিখিটা ছাড়া। হ্যাঁ, লেখালিখিই ছিল আমার স্বপ্ন। কিন্তু বলা হয়ে উঠেনি কখনো। আমি এখনও ছোট একজন মানুষ, বয়সের বিয়োগ এবং অভিজ্ঞতায় - দু' দিক থেকেই। কতটুকুও বা যোগ্যতা আছে লেখালিখি করার, তা আমি জানি না। কিন্তু প্যাশনই আমার শক্তি, প্যাশনই আমার যোগ্যতা, প্যাশনই আমার এগিয়ে চলার অনুপ্রেরণা। আমি শিখবো, লড়াই করবো, তবেই অর্জিত হবে স্বপ্ন, অর্জিত হবে বিজয়। লিখছি আজও। লিখবো ভবিষ্যতেও। যতদিন আমি আছি ততদিন বেঁচে থাকবে আমার প্যাশন ও স্বপ্নরা। আর সবুজ স্বর্গ খ্যাত দক্ষিণ এশিয়ার কৃষি শিক্ষার অন্যতম সেরা বিদ্যাপীঠ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে সুযোগ হয়েছে নিজের প্যাশন এবং স্বপ্নকে মনের সাথে কেন্দ্রীভূতকরণের। তাই পড়াশোনার পাশাপাশি সাহিত্যচর্চা নিয়মিত চালিয়ে যাবার সুযোগ হয়েছে। তাছাড়াও মহান আল্লাহর কৃপায় সুযোগ হয়েছে কবিতা লিখায় ন্যাশনাল চ্যাম্প হবার। নিয়মিত লিখছি বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকা এবং ম্যাগাজিনের পাতায়। ইতোমধ্যে প্রকাশিত আমার যৌথ গ্রন্থের মধ্যে রয়েছেঃ "মেঘের বাড়ি", "সাগরকন্যা (২য় খন্ড)", "মনপ্রবাহ", "বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ" ইত্যাদি। জাতীয় ত্বকী রচনা প্রতিযোগিতা ২০২০ এবং বাংলা বর্ণমালা ও বানান প্রতিযোগিতা ২০২১ এ দেশসেরা একজন নির্বাচিত হবার পাশাপাশি সৌভাগ্য হয়েছে জলধি তরুণ লিখিয়ে পুরস্কার ২০২১ এর সম্মানিত লেখকদের একজন হবার। একাধারে কবিতা, ছড়া, প্রবন্ধ, গল্প লেখার পাশাপাশি কাজ করবার সুযোগ হয়েছে Physically-challenged Development Foundation (PDF) এর জন্য। পুরস্কার ও সম্মাননার মধ্যে রয়েছেঃ জলধি সাহিত্য সম্মাননা (গল্প-২০২১), সেরা গল্পকার সম্মাননা (বিক্রয় ডটকম-২০২১), তারুণ্য জাতীয় কবিতা পুরস্কার ২০২১, উজান বই আলোচনা পুরস্কার (নির্বাচিত দশ - ২০২১) ইত্যাদি। সামনে আসছে আরও কয়েকটি বই। কেমন লিখি বা কতটুকু লিখতে পারি তা আমি জানি না। তবে প্যাশন এসে বারবার আমার কানে দোলা দিয়ে যায়, " আমি চির-বিদ্রোহী বীর - বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির! " ধূসর জীবনে জলজ নদীর মাঝি হয়তো হতে পারিনি, কিন্তু জীবন এবং প্যাশন সুযোগ করে দিয়েছে জীবন শিল্পের শৈল্পিক নদীর মাঝি হবার। জনপ্রিয় আমেরিকান হোস্ট Oprah Winfrey একবার বলেছিলেন," Passion is energy. Feel the power that comes from focusing on what excites you." তাই প্যাশন এবং স্বপ্নরা বেঁচে থাকলে সামাজিক বৈরিতাও লক্ষ্যে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বাঁধা হতে পারবে না। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের বক্তব্যের একটি উক্তি এরকম, শুধু বলোঃ আমি করব আমি পারব - এর বাইরে কিছুই আমি জানি না। এটা যেদিন করতে পারবে সেদিন তুমি বাংলাদেশকে পৃথিবীর বুকে এক নম্বর জায়গায় তুলে নিতে পারবে। এভাবেই নিজের প্যাশনকে আকঁড়ে ধরার মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে আমার বিজয় আর কাঁধে এসে ভিড়েছে আর-ও বড় দায়িত্ব। তাই নেলসন ম্যান্ডেলার মতো আমি ও বলতে চাইঃ " আমাকে আমার সফলতা দ্বারা বিচার করো না; ব্যর্থতা থেকে কতবার আমি ঘুরে দাঁড়িয়েছে তা দিয়ে আমাকে বিচার করো। " শেষ করছি আমার মনের কথা দিয়ে, বেঁচে থাকুক প্যাশন এবং স্বপ্নরা, আছে যেথায় যত, আসবে শত বাঁধা, তাই বলে হওয়া যাবে না কভু নত! ~ সমাপ্ত ~