দেশপ্রেম এবং আমাদের একজন সিরাজ চাচা

M Yeasin Arafath

এক. আমরা তখন খুব ছোট ছিলাম। আমাদেরই পাড়ার সিরাজ চাচা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনাতেন। গল্প শুনাতেন মুক্তিযুদ্ধের সময় ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনার কথা। পাকিস্তানি বাহিনী আমাদের মা বোনের উপর কীরকম অত্যাচার চালিয়েছিলো সেই গল্পগুলোও। আমরা মন দিয়ে শুনতাম। সিরাজ চাচা সবসময়ই চাইতো, নতুন প্রজন্ম এই মহান মুক্তিযুদ্ধের গল্প জানুক। কীভাবে একটা মানুষ দেশপ্রেমিক হবে, সেটাও চাইতো আমাদের সিরাজ চাচা। চাচা আমাদের খুবই প্রিয় ছিলেন। খুব শান্তশিষ্ট একজন মানুষ ওনি। লেখাপড়া কম করলেও জ্ঞান ছিলো অনেক বেশি। দেশ বিদেশের সব খবর শুনতেন ওনি। একটা কালো রেডিও আছে ওনার। ওটা দিয়ে বাংলাদেশ বেতারের খবর শুনেন। ওই রেডিওটা মুক্তিযুদ্ধের সময়কালের। সিরাজ চাচার আব্বা নাকি রেঙ্গুন থেকে এনেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই রেডিও দিয়ে বিজয়ের সংবাদ শুনেছিলেন ওনি। এজন্য এখনো ওই রেডিও যত্নের সাথে রেখে দিয়েছেন। দুই. সিরাজ চাচার মেজ ছেলে পাড়ায় একটা দোকান করেন চায়ের। তো চাচা সেখানে বিকেল টাইমে সময় দেন। এই সময়টাতে বেশিরভাগ সময় ওনি এলাকার ছোট ছেলেপুলেদের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার গৌরব গাঁথা দিনগুলোর গল্প শুনাতেন দোকানে। সবাই মন্ত্র মুগ্ধের মতো শুনে যেতো। মুক্তিযুদ্ধের সময় নাকি ওনার বয়স ছিলো ১৫/১৬ বছর। ওনি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে যাননি। কারণ তখন নাকি ওনি অসুস্থ ছিলো খুব। জন্মের পরে নাকি একবার সিরাজ চাচা ওনার আব্বার সাথে বাঁশ কাটতে গিয়েছিল পাহাড়ে। বৃষ্টির সময়ে পা পিছলে গিয়ে নিচে পড়ে গিয়ে খুব আঘাত পেয়েছিলো। ওনি যে তখন বাঁচবে কেউ বলেনি। এখনো ওনি পা বাঁকা করেই হাটে। এই সমস্যা ওনার মুক্তিযুদ্ধ চলার সময়ও ছিলো। এটা আমাদের বলতেই ওনি কেঁদে ফেলেছেন। কেন যে ওনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পারেননি! তবে ওনি গর্বের সাথে বলেন, মুক্তিযুদ্ধ চলা অবস্থার সবকিছুর সাক্ষী ওনি। এবং বিভিন্ন মুক্তিযুদ্ধাকে ওনি নাকি পানি কিংবা খাবার দিয়ে সহায়তা করতেন। অসুস্থ থাকায় চাচাকে তখন চাচার আব্বা আম্মা ঘর থেকে বেরও হতে দিতো না। রেঙ্গুন থেকে আনা রেডিওটা নিয়ে পড়ে থাকতেন। কখন একটা সুসংবাদ আসবে। রেডিওতে যখন শুনেছিলেন, বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পাকিস্তান নিয়ে গেছে। সেদিন নাকি সিরাজ চাচা ভাত পর্যন্ত খাননি। সিরাজ চাচা নামাযে পড়ে থাকতেন। দোয়া করতেন, দেশ এবং বঙ্গবন্ধুর জন্য। একদিন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আমাদের পাড়া দিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। পাড়ার সবাই তো খুব ভয়ে। আমাদের পাশেই অনেক ছোট বড় পাহাড় আছে। সবাই ভয়ে পাহাড়ের নিচে লুকিয়ে থাকলেন। কিন্তু ঠিকই সিরাজ চাচা ওখানে যাননি। বাড়ির বাইরে বসে থাকলেন। যদিও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সিরাজ চাচাকে দেখে কিছু বলেনি। সিরাজ চাচা বললেন, সেদিন মরে গেলেও ওনার আফসোস থাকতো না। কারণ মরলে দেশের শত্রুদের হাতে মরবেন। ওনি মুক্তিযুদ্ধের এসব গল্প সবাইকে বলে আনন্দিত হতেন। সবাইকে দেশপ্রেমিক হওয়ার জন্য উদ্ধুদ্ধ করতেন। তিন. আমার দেখা একজন সেরা দেশপ্রেমিক মানুষ আমাদের সিরাজ চাচা। ওনার বাড়িতে ওনার রুমে লাল-সবুজের গর্বিত পতাকা লাগানো। আছে বঙ্গবন্ধুর ছবিও। দেশে কোথাও অরাজকতা কিংবা সহিংসতা হলে ওনি ব্যাপক কষ্ট পান। পত্র পত্রিকায় কিংবা খবরের কাগজে কোন দুর্নীতির খবর পেলে মন খারাপ করেন। কোন ধর্ষণ কিংবা কান্নার খবর ওনি সহ্য করতে পারেন না। বলেন, লক্ষ মানুষ কেন জীবন দিয়েছে এই দেশের জন্য? এগুলো তো শুনার জন্য না। মন খারাপ করে কেঁদেও দিতেন। মন খারাপ করে বলেন, আহা- বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে আজ এসব হয়তো দেখতে হতো না। চার. সিরাজ চাচা বয়স এবং অসুখের ভারে ন্যুব্জ হয়ে গেছেন। এখনো মসজিদে আসলে অথবা পাড়ার কোথাও বসলে মুক্তিযুদ্ধের গল্পগুলো করেনই। তবে আগের মতো অতটা সুন্দর করে বলতে পারেন না। আস্তে আস্তে বলেন। কেঁদে ফেলেন। আগে এগুলো বলার সময় হাসিমুখে থাকতেন। এখন উল্টো। সিরাজ চাচার কারণে আমাদের পাড়ার সবাই মুক্তিযুদ্ধের সব কিছুই জানেন। আমাদের সিরাজ চাচা আফসোস নিয়েই এখনও বলেন, আহা! বেঁচে থেকেও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পারিনি। মরলেও আমি শান্তি পাব না...