শাকিব হুসাইন
দাদুর পায়ে বুলেট লেগেছিল শাকিব হুসাইন বিকেলবেলা । সোনা দাদুর বাড়ির উঠোনে গোল হয়ে বসে আছে ওরা । ওরা মানে পাড়ার কচিকাঁচারা । কিন্তু কেউ কোন হইচই করছে না । সবাই সোনা দাদুর জন্য অধীর আগ্রহে বসে আছে । আজ সোনা দাদু সবাইকে একাত্তরের গল্প শোনাবে । হইচই করলে সোনা দাদু কিন্তু গল্প শোনাবে না । তাই সকলে চুপচাপ হয়ে বসে আছে । কিছুক্ষণ পর ক্রাচে ভর দিয়ে সোনা দাদু ঘর থেকে উঠোনে নেমে এলেন । সবাই সমবেত স্বরে সোনা দাদুকে সালাম জানালো । সবাই বলল , ' আসলামুআলাইকুম সোনা দাদু । ' সোনা দাদু সালামের জবাব দিল , ' ওলাইকুমুস সালাম । তোমরা সকলে কেমন আছ ? ' সবাই একসাথে বলে উঠলো , ' আমরা সবাই ভালো আছি সোনা দাদু । তুমি কেমন আছ ? ' সোনা দাদুও বলল , ' আমিও ভালো আছি । তোমরা আমার জন্য অনেক সময় ধরে বসে আছ তার জন্য আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত । ' কচিকাঁচাদের টিমের মধ্যে মিনহাজ একটু বড় । তাই সে সোনা দাদুকে বলল , ' এটা আপনি কি বলছেন সোনা দাদু । আপনি আমাদের গুরুজন । আপনার জন্য আমরা বসে থাকতেই পারি । ' সোনা দাদু বলল , ' তোমরা সকলে খুব ভালো । একদিন তোমরা অনেক বড় হবে । ' মিনহাজ বলল , ' সোনা দাদু আজকে আমাদের একাত্তরের গল্প শোনাতে চেয়েছিলেন । আমরা সবাই আপনার কাছ থেকে একাত্তরের গল্প শুনব । ' মিনহাজের কথায় সবাই একসাথে বলে উঠলো , ' সোনা দাদু আমাদের আর তর সইছে না । আমাদের একাত্তরের গল্প শোনান । বঙ্গবন্ধুর গল্প শোনান । ' সোনা দাদু বলল , ' আচ্ছা , তাহলে শোন সবাই একাত্তরের গল্প । তখন ১৯৭১ সালের মার্চ মাস । জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ ই মার্চ ঘোষণা দিলেন অমর বাণী - ' এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম । ' তখন আমি বিশ বছরের যুবক । বঙ্গবন্ধুর ডাক শুনে আমরা ক'জন চলে গেলাম মুক্তিযুদ্ধে । প্রথমে আমাদের ভারতে পাঠানো হলো । সেখানে আমরা একমাস অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধে নেমে পড়ি । আমরা দলে বারো জন ছিলাম । আমাদের দলের লিডার ছিল আহাদুজ্জামান আহাদ ভাই । আহাদ ভাই অস্ত্র চালাতে অনেক পারদর্শী ছিল । তেমনি তার নেতৃত্ব দেওয়ার কৌশল ছিল ভিন্নরকম । তখন মে মাস । আহাদ ভাই আমাদের নিয়ে এলেন একটা পুরোনো বাড়িতে । বাড়িটা আগে কোন এক রাজার ছিল । দোতলা বাড়ি । আহাদ ভাই বলল , ' এখানে আমাদের কিছুদিন থাকতে হবে । এখান থেকেই আমাদের অপারেশন চালাতে হবে । ' আমরা সবাই বেশ কিছুদিন সেখানে অবস্থান করলাম। অনেক কয়টা মিশন সফল হয়েছিল ওখান থেকেই । হঠাৎ একদিন মতিউর হাঁপাতে হাঁপাতে এসে খবর দিলো , ' পাশের জেলেপাড়ায় মিলিটারি ঢুকেছে । সংখ্যায় পনেরো বিশজন তো হবেই । জেলেপাড়ার স্কুলটাতে ঘাঁটি গেঁড়েছে । ' সেই রাতেই আহাদ ভাই আমাদের সব পরিকল্পনা বুঝিয়ে দিলেন । পরের রাতে আমরা পরিকল্পনা মাফিক মিলিটারিদের দিকে এগুতে থাকলাম । হঠাৎ এক মিলিটারি আমাদের দেখে ফেলে । শুরু হলো এলোপাতাড়ি গোলাগুলি । এক পর্যায়ে সব মিলিটারিদের শেষ করে দিলাম সবাই । সেদিন আমাদের অনেক আনন্দ হলো । পুরোনো বাড়িতে ফিরে গিয়ে সকলে সমবেত স্বরে গান ধরলাম । ' আমরা সোনা বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি চিরদিন তোমার তোমার বাতাস আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি । ' এমনি করে বিভিন্ন জায়গায় আমরা বিভিন্ন মিশনে যেতাম । মিশন সফল করে নিরাপদ স্থানে ফিরে এসে সবাই সমবেত স্বরে আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি গাই৷ কি যে আনন্দ হতো তখন আমাদের । এমনি করে ছয়মাস কেটে গেল আমাদের । দেশের বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে আমরা যুদ্ধ করি । প্রত্যেকবারই আমরা সফল হয়ে ফিরে আসি । আমরা সফল হতাম কেবল আহাদ ভাইয়ের বিচক্ষণতার জন্য । তখন ডিসেম্বর মাস । আমরা রতনপুর গাঁয়ে পাহাড়ের গুহায় অবস্থান করছিলাম । ওখান থেকেই হিজলপুর , তাঁতিপাড়া , বৈষ্ণবপাড়া মিলিটারিদের হাত থেকে রক্ষা করেছিলাম । বেশ কিছুদিন কেটে গেল ওখানে । সেদিন ডিসেম্বরের পনেরো তারিখ । মতিউর খবর আনল রতনপুরে দুই ট্রাক মিলিটারি ঢুকেছে । সাথে কামানও আছে তাদের সাথে । আহাদ ভাই আমাদের বলল , ' আজ আমাদের বাঁচা-মরার লড়াই । ওদের সাথে আজ সামনাসামনি লড়াই করব । হয় আমরা মরব না হয় ওঁরা মরবে । ' যেই ভাবনা সেই কাজ । রাতের জন্য সবাই অপেক্ষা করতে লাগলাম । সেদিন আকাশে পাখিগুলো উড়াউড়ি করছিল । আমাদের দলের সবার চোখেমুখে বিজয়ের রেখা ভেসে বেড়াচ্ছিল । রাত হয়ে গেল । পূর্ব পরিকল্পনা মাফিক আমরা মিলিটারিদের দিকে এগুতে থাকলাম । রতনপুর গাঁয়ের বনের পাশেই ওঁরা তাঁবু গেঁড়েছিল । হঠাৎ এক রাজাকার আমাদের দেখে ফেলে । সাথে সাথে শুরু হলো এলোপাতাড়ি গোলাগুলি । ওঁরা আমাদের দিকে গুলি করতে করতে এগিয়ে আসছিল । আমরাও নাছোরবান্দা । পিছু না হেঁটে আমরাও ওদের দিকে এগিয়ে যাই । এমনি করে অনেক মিলিটারি মারা গেল। হঠাৎ করে একটা বুলেট এসে আহাদ ভাইয়ের বুকে লাগলো । সাথে সাথে আহাদ ভাই মাটিতে পড়ে গেল । আমি দৌড়ে আহাদ ভাইয়ের কাছে যাই । আহাদ ভাই তখনও বলছিল , ' সোনা মিয়া আমি ঠিক আছি । তোমরা লড়াই চালিয়ে যাও । ওদের মেরে বুঝিয়ে দাও যে বাংলার ছেলেরা ভীরু নয় । ' আহাদ ভাই উঠে আবারও গুলি চালাতে থাকলো । আমিও আহাদ ভাইয়ের সাথে গুলি চালাতে থাকি । এক পর্যায়ে আহাদ ভাই আবারও মাটিতে পড়ে গেল । আহাদ ভাইয়ের কাছে যেতেই আমার বা পায়ে একটা বুলেট লেগে গেল । সেই পা নিয়েই মিলিটারিদের দিকে গুলি চালাতে থাকলাম । এক পর্যায়ে সব মিলিটারি মারা গেল । আমরা সবাই আহাদ ভাইয়ের কাছে গেলাম । আহাদ ভাই তখন বলছিল , ' আমরা পেরেছি । সোনা মিয়া আমরা পেরেছি । বাংলার ছেলেরা ভীরু নয় । আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি । জয় বাংলা । ' বলতে বলতে আহাদ ভাই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো । পরেরদিন লাল রক্তিম সূর্য উঠলো পূর্ব আকাশে । সবুজ ঘাসের বুকে রক্তের স্রোত যাচ্ছিল সেদিন । বাংলাদেশ স্বাধীন হলো । জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন পূরণ হলো । আহাদ ভাইয়ের স্বপ্ন পূরণ হলো । আহাদ ভাই , তিরিশ লক্ষ শহীদ ও হাজার হাজার সম্ভ্রম হারা মা ও বোনের বিনিময়ে আজকের এই বাংলাদেশ । একাত্তরের গল্প বলতে বলতে সোনা দাদুর দু-চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি ঝড়ছে । সোনা দাদুর কান্না দেখে সবার চোখে পানি চলে এলো । মিনহাজসহ সবাই একসাথে দাঁড়িয়ে সোনা দাদুকে স্যালুট করল । মিনহাজ বলল , ' তোমরা যুদ্ধ করে আমাদের দেশ দিয়েছ , স্বাধীনভাবে বাঁচার অধিকার দিয়েছ আমরা চিরদিন তোমাদের স্মরণ করে যাবো । তোমাদের কথা আমরা কোনদিন ভুলব না । ' তখনও সোনা দাদুর দু-চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি ঝড়ছে ।