আদিল মাহবুব
শান্ত নদীর পাড়, সবুজ বৃক্ষের আড়াল আর বিস্তৃত ফসলের মাঠের এক গ্রাম ছিল আমার শৈশব এবং খুব 'অল্পসময়' জুড়ে পাওয়া কৈশোরকালের চেনা ভূমি। ভীষণ দুরন্তপনায় সেই 'অল্পসময়ের' পাওয়া কৈশোর জীবন এক ঝটকায় শেষ হয়ে যায়। এক গ্রীষ্মের দুপুরে যখন আমি চেতনা ফিরে নিজেকে আবিষ্কার করি গাছের উপর থেকে নিচে, তখনও বুঝিনি সব শেষ হয়ে গেছে। শরীরের উপরের অংশজুড়ে প্রচন্ড ব্যথা। অথচ দুই পা ভীষণ শান্ত আর শীতল। নিজের পা হাত দিয়ে স্পর্শ করেও চিনতে পারছিলাম না। অনেক পরে বুঝেছি আমার জীবনকালের মাঝে 'বিস্ময়চিহ্ন' এঁকে দিয়ে দুই ভাগ হয়ে গেছে তখনই। সপ্তম শ্রেণীতে মাত্র তের বছর বয়সে ভিন্ন মানুষ হয়ে যাই। ছয় মাসের হসপিটাল জীবন, যার একমাস ছিল বেডে চুপচাপ শুয়ে থাকা! সেই ক্লান্তিকর একঘেয়ে জীবন যে কী ভীষণ দুর্বিষহ ছিল! শৈশব কৈশোরের দুরন্ত দিনগুলো ভীষণভাবে মনে পড়ত। খুব ছটফট করতাম বাসায় যাওয়ার জন্য। স্কুলের ক্লাস মিস যাচ্ছে, পড়ার ক্ষতি হচ্ছে ভেবেও চিন্তিত থেকেছি। তখনও বুঝিনি আমার জীবন আর কোনদিন স্বাভাবিক হবে না। আমার পরিবারের সবাই জানতো বটে। সাইকেলের প্রতি ভীষণ আকর্ষণ ছিল আমার। ছোটবেলাতে বাবার পুরাতন সাইকেল চুরি করে চালাতাম। খুব দুরন্ত ছিলাম বলে দুর্ঘটনার ভয়ে সাইকেল দিতে চাইতো না। তাই হসপিটালে বেডে শুয়ে থেকে বড় ভাইয়ার কাছে একটা সাইকেল কিনে দিবার আবদার রেখেছিলাম। আমাকে হাসিমুখেই ভাইয়া কথা দিয়েছিলেন যে কিনে দিবেন। কিন্তু বুঝিনি এই আবদার তাঁর বুকের ভিতর পাথর হয়ে বিঁধে ছিল। কেননা সবাই জানতো আমার মেরুদণ্ড ভেঙে স্পাইনাল কর্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর কোনদিন আমি হাঁটতে পারব না। দীর্ঘ একমাস পর যখন আমাকে হুইলচেয়ারে বাসানো হয়েছিল তখন একঘেয়ে শুয়ে থাকার জীবন থেকে মুক্তির সাধ পেয়ে আনন্দিত হয়েছিলাম। ধীরে ধীরে চেয়ারটা চালানো শিখেছি। সি.আর.পি'র হসপিটালে সমবয়সী অনেকে ছিল আমার মতো। তাদের সাথে ঘুরে ঘুরে হসপিটাল দেখতাম, আড্ডা দিতাম। কিন্তু সেটাও সাময়িক ভেবেছিলাম। চিকিৎসা শেষ হলে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবো এমনই ভেবেছি। কিন্তু যখন সেই হুইলচেয়ারে করেই হসপিটাল ছেড়ে বাড়িতে ফিরি তখন খুব অল্পবয়সেই কঠিন সত্যটা বুঝে গিয়েছিলাম যে আমার জীবনে মাঝে একটা ছেদ চিহ্ন এঁকে গেছে। কিন্তু খুব বেশি চিন্তিত ছিলাম না। কেননা হুইলচেয়ার নিয়েও বেশ চলা যাচ্ছিল। অতটুকু বয়সে ভবিষ্যত নিয়ে আর কে ভাবে। পরিবারের সবাই অকুণ্ঠ স্নেহ ভালোবাসায় আগলে রাখছিল। পরের বছর অষ্টম শ্রেণিতে স্কুলে ভর্তিও হই। তখন বাহিরের বাস্তবতার সাথে পরিচিত হলাম। উপলব্ধি করলাম আমার এই জীবনের সাথে চলার জন্য যে অবকাঠামো প্রয়োজন তা তৈরি হয়নি। স্কুল ছিল বেশ দূরে। তাতে র্যাম্পও ছিল। কাঁচা মাটির পথ দিয়ে ভাঙা রাস্তায় পাড়ি দিতে হয়। ফলে মাত্র দুই মাস যেতে অসুস্থ হয়ে পড়ি পুনরায়। কৈশোরের অল্প পথ আজ দীর্ঘ মনে হয়। স্কুলের যে বন্ধুদের সাথে ছিল প্রগাঢ় সখ্যতা, তাদের সাথে আর সহজ হতেও পারছিলাম না। কোথাও একটা জড়তা ছিল! স্কুলে যাওয়া বাদ দিলাম। তখন থেকে চার দেয়ালের বন্দিজীবন শুরু হলো। সময় কাটে ভীষণ নিশ্চুপ আর নিঃসঙ্গতায়। ব্যস্ত চারপাশের মাঝে আমারই কেবল অফুরন্ত অবসর! এর অনেকদিন পর এক বিশাল পৃথিবীর সন্ধান পেলাম আকস্মিকভাবে! বাসায় বড় ভাইয়া প্রচুর সাহিত্যের বই ছিল। ধীরে ধীরে ছোট বইগুলো পড়তে শুরু করলাম। তারপর নেশার মতো দিনরাত ডুবে যেতে থাকলাম উপন্যাস গল্পের জগতে। সমরেশ মজুমদার, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সুচিত্রা ভট্টাচার্য, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব বসু, শার্লক হোমস, জুলভার্ন, আর্নেস্ট হোমিংওয়ে, আলেকজান্ডার দ্যুমা, ডি এইচ লরেন্স আরো কত নাম! আমি অভিভূত হয়ে থেকেছি দীর্ঘদিন। এই নেশা থেকে বের হতে পারিনি। আর এঁরাই আমাকে চার দেয়ালের বাহিরে টানতে থাকে বারবার। জীবনের অর্থ বোঝায়, নিজেকে চেনায়, ভাবনায় চলে আসে ভবিষ্যত। নিজেকে যেদিন বলেছি, এভাবে শুয়ে বসে আর কত দিন চলবি তুই? সেদিনই ঘর ছেড়েছি। সময়টা ২০১১ সাল। ঘটনাক্রমে একটা আবাসিক স্কুলের সন্ধান পাই রাজশাহীতে। যেখানে হোস্টেল ছিল স্কুলের সাথেই। বাসার কারো ইচ্ছা ছিল না আমি কষ্ট করে পড়ি। অন্যদিকে কোনদিন আমার বাহিরে একাকী কোথাও যাইনি। সেই মানুষ কিনা একটা হুইলচেয়ারকে সঙ্গী করে ঘর ছাড়বে তা ছিল বিস্ময়! আমি তখন ঘোরের ভিতর ছিলাম। আমাকে নতুন করে শুরু করতে হবে এই চ্যালেঞ্জ নিয়ে ফেলি। তখন রাজশাহীর পি.এস.এন সমন্বিত উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হই। শুরু হয় এক নতুন জীবনের পথচলা। যেখানে বন্ধু, বান্ধুবী সব পেয়েছিলাম। আর দশজন স্বাভাবিক শিক্ষার্থীদের মতোই আমার রুটিন। স্কুল, ক্লাস, প্রাইভেট, আড্ডা! এইতো আমার স্বপ্নভূমি! ধীরে ধীরে সহজ হতে থাকি জীবনের সাথেও। আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে বড়ো হতে থাকে জীবনের লক্ষ্য। দশম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করি। দারুণ অনুপ্রেরণাদায়ক ছিল এটা। প্রত্যেক শিক্ষকের অপত্য স্নেহ আর ভালবাসায় আমি নিজেকে পরিবর্তন করতে থাকি। তাঁদেরও প্রত্যাশা বাড়তে থাকে। প্রতিটি সাময়িক পরীক্ষাতে প্রথম স্থানে থেকেছি। তবে চুড়ান্ত অর্জন আসে এস এস সি পরীক্ষায় GPA-5 (Golden) পেয়ে। আমার জীবনের এই অর্জনটা একটা জাদুর কাঠির মতো ছিল। যেখানে চেয়েছিলাম শুধু পড়াশুনার মধ্য দিয়ে আনন্দময় জীবন কাটাতে, সেখানে এই রেজাল্ট জীবনের পথ তৈরি করে দেয়। ২০১৩ সাল। বগুড়ায় নিজ জেলা শহরে ফিরে আসি। সরকারি শাহ সুলতান কলেজে ভর্তি হই। পাশেই একটা মেস ভাড়া নিয়ে শুরু করি কলেজ জীবন। শিক্ষাজীবনের এক বর্ণীল আনন্দময় জীবন পার করেছি এই কলেজ আজ মেস জীবনে। প্রত্যেকের ভালবাসা আমার জীবনকে সহজ করে তুলেছিল। ভুলে থাকতে পেরেছিলাম আমার ব্যতিক্রমী জীবন। কলেজ থেকে বনভোজন গিয়েছি, রাতের শহরে ঘুরেছি দল বেঁধে, বিভিন্ন দিবসে অনুষ্ঠান করেছি মেসে। সব ছিল আর দশজন শিক্ষার্থীদের মতো। সব শেষে পড়াশুনাটাও করেছি। এইচএসসিতে GPA-5 নিয়েই কলেজ জীবন শেষ করি। এরপর শুরু হয় ভর্তি পরীক্ষা নামক অসম যুদ্ধ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কোচিং তখন চারপাশ জমজমাট। প্রত্যেক বন্ধুই কোন না কোন কোচিং প্রতিদিন যাচ্ছে, গল্পও শুনছি তাদের। যেহেতু কোচিং গুলোতে লিফট ছিল না, তাই হুইলচেয়ার নিয়ে সেখানে ভর্তির চিন্তাও করতে পারিনি। নিয়মিত যাতায়াত তো অকল্পনীয়। তাই মেসের রুমে বসে একা একাই নিজের মতো প্রস্তুতি নিতে থাকি। কখনো কখনো দুর্বলতা পেয়ে বসতো যে কোচিং ছাড়া সম্ভব নয় চান্স পাওয়া। কিন্তু নিজের সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়ে আরো বেশি করে চেষ্টা চালিয়েছি। আল্লাহ মুখ ফেরাননি। ২০১৫ সাল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা দিই। একই দিনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা। কিভাবে যেন ভীষণ আশাবাদী হয়ে উঠেছিলাম। নিজের উপর আস্থা রেখেছিলাম। ফলাফল, দুই বিশ্ববিদ্যালয়েই মেধা তালিকায় চলে আসি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খ-ইউনিটে মেধা তালিকায় ৯৯৯তম স্থান অধিকার করি। এক দুঃসহ জীবনকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ঠিকই স্বপ্নলোক জয় করি! নিজেকে নিজের দেয়া এই উপহারের চেয়ে দামি আর কি হতে পারে? ২০১৬ সাল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী হিসেবে শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয় জীবন। হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের ১০৭ নাম্বার রুমে আমার হল লাইফ শুরু হয়। তবে অবকাঠামোগত বাধা প্রতিনিয়ত আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিয়েছে এখানে। বিল্ডিংগুলোতে র্যাম্প, লিফট না থাকাসহ অবকাঠামোগত প্রতিবন্ধকতায় আমার হুইলচেয়ার জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেই। কিন্তু সেই গল্প থাক। বাধা গুলো অতিক্রম করে গিয়েছি সেটাই ছিল আশার কথা। এখান থেকেই গ্রাজুয়েশন শেষ করে আজ পোস্ট গ্রাজুয়েশনের রেজাল্টের অপেক্ষায় আছি। বর্তমানে চাকরি নামক সোনার হরিণ ধরতে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছি। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন ছিল এক মহাকাব্যিক জীবন। অল্প কথায় শেষ হবে না। বলবো কোন একদিন। গল্প দীর্ঘ হয়ে যায়। তাই প্রিয় পাঠক, শুধু একটু জানুন, আমি আর দশজনের মতো একজন হতে পেরেছি। বর্ণীল, আনন্দময় শিক্ষাজীবন ভালোভাবে শেষ করেছি। পিছনে ফেলে এসেছি সমাজ, রাষ্ট্রের সকল প্রতিবন্ধকতা। পথ তৈরি ছিল না, তৈরি করে নিয়েই পথিক হয়েছি। কেননা নিজের জীবনের সঙ্গেই ছিল আমার নিজের চ্যালেঞ্জ। স্বপ্ন পখিরা বেঁচে থাকা, উড়তে থাক নিজস্ব আকাশে। জীবনযুদ্ধই তো নিয়তি। যোদ্ধা হতে পারলে বিজয় আসবেই ইনশাআল্লাহ। আদিল মাহবুব ভূঁইয়া বি.এ. (অনার্স), এম.এ. বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।