Farhad Reza
“মাগুরা জেলার মুচাপুর বাজারের নূরজাহান আক্তার স্বর্ণা যখন এক হাতে বই আর অন্য হাত মায়ের কাঁধে রেখে গ্রামের আঁকাবাঁকা মেঠোপথ দিয়ে হেঁটে স্কুলে যেত, তখন প্রতিবেশী থেকে শুরু করে অন্য সহপাঠীরা খুব হাসত। ‘কানা মেয়ে, কানা মেয়ে’ বলে চিত্কার করত। প্রতিবেশীরা নাক সিটকে বলত, এমনিতেই গরিব তার ওপর অন্ধ মেয়ে, তাকে দিয়ে আবার পড়ালেখা হয় নাকি! এসব কথা শুনে নূরজাহান আক্তারের পিত্তি জ্বলে যেত। কিন্তু প্রতিবাদের ভাষা তার জানা ছিল না। সেদিন প্রতিবেশী ও সহপাঠীদের সেই নাক সিটকানো আর ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ দমাতে পারেনি নূরজাহানকে; বরং তা তাকে আরও সাহস জুগিয়েছে, জেদি করে তুলেছে। দিনমজুর বাবা আর গৃহিণী মায়ের সাধ মেয়েকে লেখাপড়া করাবেন, কিন্তু সেই সাধ্য কি তাঁদের আছে? এর পরও হাল ছাড়েননি বাবা ফজল রহমান। অনেক ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ উপেক্ষা করে আধপেটা খেয়েও মেয়েকে স্কুলে যেতে উত্সাহ জোগাতেন। স্বপ্ন দেখতেন, মেয়ে পড়ালেখা করে একদিন অনেক বড় হবে। অভাব ঘুচবে সংসারের। কিন্তু কোথায় পাবেন এত টাকা? কীভাবে এই অন্ধ মেয়েকে ব্রেইল পদ্ধতির বইপত্র কিনে দেবেন? যাঁদের একবেলা খাবার জোটে না, তাঁদের আবার ব্রেইল পদ্ধতির বই জুটবে কী করে? একসময় হতাশায় ভেঙে পড়েন বাবা ফজল রহমান। কিন্তু নিজের ইচ্ছাশক্তির কাছে হার মানতে নারাজ নূরজাহান আক্তার। এসব গল্প নয়, তবু গল্পের মতো মনে হয় কখনো কখনো। আর এ গল্পগুলোই নাড়া দেয় কারও কারও মনে। বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে এমন সব গল্পের নায়ক-নায়িকাকে দেখে তিন তরুণের মন যেন ডুকরে কেঁদে ওঠে। নূরজাহান আক্তারের মতো দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মেয়েদের ইচ্ছাশক্তিকে আরও বেগবান করতে, আর সেই সব অন্ধকারের যাত্রীদের আলো দেখিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে তাঁদের ভাবনার শেষ নেই। ২০০৭ সাল। ফেরদৌস আলম, ওবায়দুল ইসলাম ও হাছিব—এই তিন তরুণ মিলে শখের বশেই গড়ে তোলেন একটি তরুণ ক্লাব। বিভিন্ন ধরনের সচেতনতামূলক কাজই ছিল এ সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু শুধু সচেতনতার মধ্যেই তারুণ্যকে বেঁধে রাখতে নারাজ তাঁরা। তাহলে উপায় কী? তাঁদের তো অন্য কিছু করার মতো পয়সা-কড়িও নেই। কিন্তু স্বপ্নের সীমানা তো তাঁদের আকাশ ছুঁইছুঁই। যখনই হতাশা গ্রাস করতে শুরু করল, ঠিক তখনই তাঁদের এই স্বপ্ন আর সচেতনতামূলক কাজের কথা শুনে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল একটি পরিবার। এবার যেন স্বয়ং ভাগ্যদেবী মুখ তুলে চাইলেন এ তিন তরুণের দিকে। আবার নতুন করে ভাবার পালা—এ টাকা তাঁরা কাদের পেছনে খরচ করবেন, কীভাবে খরচ করবেন ইত্যাদি। বিভিন্ন সচেতনতামূলক কাজের সুবাদে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুরে বেড়িয়েছেন এ তিন তরুণ। ওই সময় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কিছু অসহায়, নিগৃহীত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মেয়ের সঙ্গে কথা বলার সুযোগও হয়েছিল তাঁদের। ওই সব মেয়ের অসহায় অবস্থা খুব ভাবিয়েছিল তাঁদের। ২০০৯ সালের মার্চ মাস। উদ্যমী এই তিন তরুণ ভাবতে থাকেন—এসব দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ও পিছিয়ে পড়া মেয়েকে কীভাবে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। যেই ভাবা, সেই কাজ। কোমর বেঁধে তাঁরা নেমে পড়েন কাজে। এবার সেই তরুণ ক্লাবেরই নতুন নাম দিলেন তাঁরা ‘অগ্র আগামীর বাংলাদেশ’। তাঁদের স্লোগান হলো ‘অ্যাবলিং দ্য ডিজঅ্যাবল’। তাঁদের এ সংগঠনের মূল লক্ষ্য হলে,া সারা দেশের যত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মেয়ে আছে, তাদের লেখাপড়া, চিকিত্সাসহ যাবতীয় মৌলিক প্রয়োজন নিশ্চিত করা। কিন্তু ওই একটি পরিবার থেকে যে অনুদান আসে, তা দিয়ে পুরো বাংলাদেশের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মেয়েদের সহযোগিতা করা সম্ভব নয়। তাই তাঁরা খুলনার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ফাউন্ডেশন অব দ্য ডিফারেন্টলি অ্যাবলের (এফডিএ) সহযোগিতায় রংপুর, যশোর, খুলনা, মাগুরা ও নড়াইল থেকে ১৭ জন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মেয়েকে সাহায্য করার জন্য বেছে নেন। তাদের সবার পরিবারের অবস্থাই শোচনীয়। স্কুলের পুরো বছরের বেতন পরিশোধ করে শুরুতেই তাঁরা এসব দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মেয়ের স্কুলে যাওয়া নিশ্চিত করেন। এরপর ধীরে ধীরে চিকিত্সা, সাদা ছড়ি, ছাতা, ব্রেইল পেপার, ব্রেইল মেশিন, ব্রেইল বই, রাইটিং ফ্রেম, স্কুলের পোশাক, ব্যাগ, টেপরেকর্ডার, অডিও ক্যাসেট, স্কুলে যাতায়াত ভাতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে তাদের সাহায্য করছেন। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই তাঁরা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মেয়েদের লেখাপড়ার খোঁজখবর নেন। আর এ ব্যাপারে তাঁদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করে এফডিএ। কারও নাক সিটকানো এখন আর নূরজাহান আক্তারদের পিত্তি জ্বালায় না। স্কুলেও কেউ আর তাচ্ছিল্য করে না তাদের। পরীক্ষায় অনেকের চেয়ে ভালো ফলের কারণেই এখন তারা ক্লাসের মধ্যমণি। এখন নূরজাহান আক্তারের মতো ওই ১৭ জন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মেয়েও স্বপ্ন দেখে, তারা একদিন অনেক বড় হবে। বাবা-মায়ের অভাব ঘোচাবে। কিন্তু ফেরদৌস আলম, ওবায়দুল ইসলাম ও হাছিব শুধু এই ১৭ জনকে নিয়েই স্বপ্ন দেখেন না; তাঁদের স্বপ্ন পুরো দেশের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের সহযোগিতা করার। কিন্তু এখন তাঁদের সেই সামর্থ্য নেই। যদি আবারও কেউ দেবদূত হয়ে সাহায্যের হাত বাড়ান, তাহলে হয়তো আরও অনেক নূরজাহানই স্বপ্ন দেখবে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার। এই তিন তরুণ স্বপ্ন দেখেন একটি সুন্দর ভবিষ্যতের। সেই আগামী দিনের বাংলাদেশ গড়তে তাঁরা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মেয়েদের স্বপ্ন দেখান সুন্দর জীবন গড়ার, সুন্দরভাবে বাঁচার”