আতিফ আসাদ
আমি আতিফ আসাদ।জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ী উপজেলার ডোয়াইল ইউনিয়নের হাসড়া মাজালিয়া প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে থাকি।বাবা,মা আর ৭ ভাই বোনের পরিবার আমাদের। সবার ছোট আমি।আমরা ৩ ভাই ও ৪ বোন।৭ ভাই বোনের বিশাল পরিবারে একমাত্র বাবার রোজগারের আয়ের টাকায় পরিবার চলতো না।তাই আমরা সবাই বাবার পাশাপাশি কাজ করে সংসার চালাতো।আমি লেখাপড়ার পাশাপাশি কাজকর্ম করে লেখাপড়া চালাতাম।পরিবারের অনেকেরই মত ছিলো মাধ্যমিক না পার হওয়ার আগেই ঢাকায় চাকরিতে পাঠিয়ে দেওয়া।কিন্তু আমার প্রবল ইচ্ছার কারণে এখনো লেখাপড়া করে যাচ্ছি।প্রাইমারি স্কুলে থাকা অবস্থায় মার সাথে নকশিকাঁথা থেকে শুরু করে,ধানকাটা,দিনমুজুরি,রং বার্ণিশ ,রাজমিস্ত্রি, রডমিস্ত্রি ইত্যাদি কাজ করে লেখাপড়া চালাই এবং পরিবারকে কিছু দেই।লেখাপড়ার পাশাপাশি স্কুল বন্ধ হলে এই কাজগুলো করতাম এবং এখনো করি।টাকার অভাবে ভালোভাবে স্কুলে যেতে পারিনি,বই,গাইড কিনতে পারিনি।ভালো কোন শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়তে পারিনি।এই কষ্টগুলো ছোট থেকেই বিবেকে নাড়া দিতো।ভাবতাম সমাজের জন্য শিক্ষার আলো দরকার।কারণ আমার মতোই প্রায় সবাই।এদের নিয়ে আমার ছোট থেকেই কিছু করার ইচ্ছা। ভালো কিছু করতে হলে এবং জ্ঞানকে বিকশিত করার জন্য বই পড়ার ভূমিকা অপরিসীম। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে পাঠাগার নেই,বই পড়ার সুবিধা নেই।আবার টাকা দিয়ে বই কিনে পড়ার মতো অর্থ নেই সবার।যেখানে লেখাপড়ার টাকাই যোগাতে পারেনা সেখানে টাকা দিয়ে বই কেনার সামর্থ্য কারো নেই।ছেলেমেয়েরা অবসর সময় টুকু কাটাতে তাই বিনামূল্যে বই পড়ানোর পরিকল্পনা করি বড় ভাই মিলনের সাথে।প্রথমে ২০ টি বই দিয়ে ২০১৮ সালের জানুয়ারীতে শুরু করি।কোথাও ঘর ভাড়া নিয়ে পাঠাগার শুরু করার টাকাটাও আমার ছিলো না।ভাবলাম যেহেতু শিক্ষার ও জ্ঞানের আলো ছড়ানোই আমার মূল কাজ সেখানে অবকাঠামো কোন বাধা হতে পারেনা।তাই নিজের বাড়ীতেই ঘরের বারান্দায় পাট শোলা দিয়ে বেড়া দিয়ে পাঠাগার শুরু করি।প্রথমে নিজের ঘর থেকেই শুরু করি।তারপর ঘরের বারান্দায়।এরপর বই,সংরক্ষন করার একটা ব্যাপার আছে।তাই বাবার সাথে পরামর্শ করে,ঘরে কিছু কাঠ ছিলো তা দিয়েই নড়বড়ে একটা বই রাখার তাক/বুকশেলফ বানাই। শুরুর দিকে বিভিন্ন লোকদের কাছ থেকে চেয়ে চেয়ে ২/৪/৫/১০ টা করে বই নিয়ে বই বাড়ানো আর পাঠকদের নতুন বই দেওয়ার চেষ্টা করি।এরপর গ্যাসটন ব্যাটারিজ লিমিটেড এর নির্বাহী পরিচালক কে এইচ মালেক স্যার পাঠাগারের এই ভালো কাজ দেখে ১০০ বই দেন এবং ভিয়েতনামে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সামিনা নাজ ম্যাম বই কেনার জন্য কিছু টাকা দেন।এতে আমার পাঠাগার সমৃদ্ধ হয় এবং পাঠকরা ভালো বই পড়তে পারে।এরপর এতগুলো বই সংরক্ষন করতে সমস্যা দেখা দিলে মালেক স্যার আবার একটি বুকশেলফ বানানোর টাকা দেয়।ছাত্র,শিক্ষক,চাকুরীজীবী, প্রবাসী থেকে সবার দেওয়া বই গুলো নিয়ে আজকে আমার পাঠাগারে বর্তমানে প্রায় ২০০০ বই আছে। আমি লেখাপড়ার পাশাপাশি বাড়ী বাড়ী গিয়ে বই দিয়ে আসি সপ্তাহে ২/৩ দিন।এছাড়াও কেউ যদি ১০-১৫ কিলোমিটার দূর থেকেও ফোন করে।তাকে সাইকেল চালিয়ে গিয়ে বই দিয়ে আসি। প্রায় ১০০ পাঠক আছে পাঠাগারের।সময় ভেদে কম বা অনেক বেশিও হয়।শুরুর দিকে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতাম।বই রাখার মতে জায়গা না থাকা,ঘর সংকট তো আছেই।অনেকে উপহাস করতো টিটকারি দিয়ে কথা বলতো।এখনও বলে।কি শুরু করেছে ছেলেটা,এখন কি আর এই বইগুলো পড়ে কেউ!লেখাপড়া না করে মানুষের সেবা করবে!অনেকে সামনে না বললেও পিছে পিছে পাগল বলতো।তাতে আমার কষ্ট লাগতো কিন্তু দমে যাইনি।আমার অবসর সময় টুকু মানুষের জন্যই কাজে লাগাচ্ছি এবং সেটা বই দিয়ে আলোকিত করার।প্রথমে তো পাঠাগার কি বুঝতোই না অনেকে।পাঠাগারের সব বই কুরিয়ারে আসে উপজেলায়।৮-১০ কিলো সাইকেল চালিয়ে নিয়ে আসতে হয়।একদিন আমি আর আমার বন্ধু সবুজ কুরিয়ার থেকে বই নিয়ে বাড়ী ফিরছি।তখন এক লোক বলতাছে,এতগুলো বই দিয়ে কি করবে?পাঠাগারে কি বই বিক্রি হয়?সবার ধারণাও ছিলো না পাঠাগারে বই বিক্রি নয় বিনামূল্যে পড়া যায়।এই জিনিসগুলো বুঝিয়ে পাঠক তৈরী করা শুরুতে একটু সমস্যাই ছিলো।মাঝে মাঝে টাকা না থাকলে জামালপুর শহর কুরিয়ারে থেকে ৪০ কিলো সাইকেল চালিয়ে বই আনতে যেতে হয়।আবার আমি যদি বাড়ীতে কোন কারনে না থাকি,আমার মা যেহেতু বাড়ীতে থাকেন তিনিই বই দেন এবং সংগ্রহ করেন।হয়তো আমার মাঝে মাঝে লেখাপড়ার খরচের জন্য দূরে কোথাও দীর্ঘ সময় কাজ করতে যেতে হয়। পাঠাগার শুরু করার সময় নাম ঠিক করতে পারি নাই।পারিবারিক জমির বিরোধের জেরে আমার বড় ভাই মিলনকে জবাই করে হত্যা করে পাশের গ্রামের কালভার্টের মধ্যে ফেলে রেখে যায়।হটাৎ খবরে পাগলের মতো হয়ে যাই।যেহেতু ভাই সবসময়ই দিকনির্দেশনা দিতো এবং পাশে ছিলো।তাই ভাইয়ের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণার একটা শক্তি ভিতরে কাজ করতো।তাই ভাইয়ের নামেই,’মিলন স্মৃতি পাঠাগার’ নামে আবার শুরু করলাম।আমার ভাইকে এর মাঝে খুঁজে পাই। আমার লক্ষ্য হলো,প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে পাঠাগার আন্দোলনের মাধ্যমে জ্ঞান ভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণ, সারা বাংলাদেশে রেলওয়ে স্টেশনে ১০০ টি ইস্টিশন পাঠাগার চালু করা এবং উপজেলার ১৮৮ টা গ্রামে গ্রাম পাঠাগার স্থাপন করে বিশ্বে প্রথম লাইব্রেরি ভিলেজ স্থাপন করা। বই পড়া আন্দোলনকে ছড়িয়ে দিতে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম মিলন স্মৃতি পাঠাগারের উদ্যোগে শুরু হয়েছে রেলওয়ে স্টেশন ভিত্তিক চায়ের বিনিময়ে বইপড়া ‘ইস্টিশন পাঠাগার’ প্রজেক্ট। (https://www.facebook.com/1692118057696342/posts/2935270743381061/?app=fbl)।তারাকান্দি ও সরিষাবাড়ী দুটি আন্তঃনগর স্টেশনে চালু হয়েছে ইতিমধ্যে।মুজিব বর্ষ উপলক্ষে আরো ৫ টা উদ্বোধন সহ সারা বাংলাদেশে ১০০ টি ইস্টিশন পাঠাগার উদ্বোধন হবে।যাতে অপেক্ষার মতো বিরক্তিকর সময়ে যাত্রীরা বই পড়তে পারে। শুরু করেছি গ্রাম ভিত্তিক পাঠাগার।দুটি গ্রামে উদ্বোধন হয়েছে পাঠাগার।সর্বমোট ১৮৮ টা গ্রামে গ্রাম পাঠাগার করবো আমরা। বর্তমানে ৫ টা পাঠাগারের মাধ্যমে গড়ে মাসিক ১৫০০-২০০০ পাঠক বই পড়ে জ্ঞান অর্জন করছে। স্বাধীনতা ও বিজয়ের ৫০ বছরে আমার এই বই পড়া আন্দোলনকে বেগবান করে যাচ্ছি আরো সুন্দর ভাবে। যাতে পাঠাগার আন্দোলনের মাধ্যমে সারা বিশ্বে বাংলাদেশকে তুলে ধরতে পারি।