এ এম তানভীর
ছাত্রজীবনের শুরু থেকে কখনোই ভালো ছাত্র ছিলাম না। একজন ছাত্রকে বিচার করা হয় তার ভালো ফলাফলের ভিত্তিতে। সে তখনই ভালো ছাত্রের তকমা পায় যখন তার ফলাফল ঈর্ষনীয় তথা ভালো হয়। আর তার ফলাফল ভালো তথা আশানুরূপ না হলে খারাপ ছাত্র তকমা লেগে যায় তার গায়ে। সেই দিক থেকে, স্কুলের বরাবরের মতো সবসময় খারাপ ফলাফল অর্জন করায় খারাপ ছাত্র হিসেবে পরিগণিত হয়। এই খারাপ ফলাফলের ধারাবাহিকতায় যখন নবম শ্রেণীতে উচ্চতর গণিতে দুই সাময়িকে শূন্য লাভ করি তখন স্কুল এবং এলাকার সবচেয়ে খারাপ ছাত্র হিসেবে পরিচিত হই সবার কাছে। বাসার মানুষ, আত্নীয় স্বজন, প্রতিবেশী সবাই তুচ্ছ তাচ্ছিল্য, উপহাস আর অপমান করতে থাকে নিয়মিত।এলাকার এক ছেলে আদু ভাই বলেও সম্বোধন করেছিল। তাদের এমন তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের মধ্যেও যখন এসএসসি আর এইচএসসি পরীক্ষায়ও ভালো ফলাফল অর্জন করতে পারি নি তখন তাদের উপহাস,তুচ্ছতাচ্ছিল্য আর অপমান আরো তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে যায়। নিজেই নিজের কাছে একা হয়ে যায়। ঘরবন্দী হয়ে পড়ি। বাসা থেকে বের হতাম না,সবসময়ই একা একা থাকা শুরু করি আর আত্নকেন্দ্রীক হয়ে পড়ে পুরোপুরি। সকল বন্ধু বান্ধবের সাথে সম্পর্ক কমতে থাকে ধীরে ; আমার বাজে ফলাফলের কারণে অনেকে দূরত্ব বজায় রাখা শুরু করে আমার কাছ থেকে। সেইসাথে প্রতিবেশী সহপাঠীরা আমার চাইতে অনেক বেশি ভালো ফলাফল অর্জন করায় তা আমার জন্য মরার উপর খড়ার গাঁ হয়ে যায়। এবার নিজ বাসায়ই নিয়মিত তীর্যক মন্তব্য আর কটুক্তির স্বীকার হতে থাকি। সময় গড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার সময় চলে আসে,প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করি ধীরে ধীরে। প্রতিবেশী সহপাঠীরা যখন ঢাবি বুয়েটের পড়ার ইচ্ছা পোষণ করে আমি চুপচাপ শুনি তাদের এমন আলাপ গুলো কোন ধরনের মন্তব্য ছাড়াই। ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়ার মধ্যে বাসায় এক আত্নীয় আসলেন জিজ্ঞেস করলেন কোথায় পড়ার ইচ্ছা? বললাম - ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন- এসএসসি আর এইচএসসি তে আমার জিপিএ কত? আমি বলার পর তিনি উত্তর দিলেন-- " এই জিপিএ দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশা বাদ দাও তারচেয়ে বরং এলাকার সরকারি কলেজের ভর্তি চেষ্টা করো,তোমার এই জিপিএ দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তো দূরের কথা ভর্তি পরীক্ষা দেওয়া হবে বৃথা চেষ্টা।""" তার এমন মন্তব্যে আমি পুরোপুরি ভেঙে পড়ি, যার ফলস্বরূপ দুই তিনদিন পড়াশোনা থেকে দূরেই ছিলাম। মা আমার এই অবস্থা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন, বারবার আমাকে স্বাত্বনা দিচ্ছিলেন এই বলে--" মানুষের কথায় কান দিতে নাই,তোকে দিয়ে সম্ভব, তুই পারবি"" অবশেষে আবার পূর্ণোদ্দমে পড়া শুরু করি। রাত জেগে পড়া শুরু করি,রাত জেগে পড়ার কারণে চোখের নিচে কালো দাগ পড়ে যাওয়ায় আব্বু আম্মু রাত জেগে পড়ায় বাঁধা দিতো। তারা রুমের লাইট অফ করে দিতো আমিও শুয়ে পড়ার ভান করতাম, একটু পরে ওয়াশরুমে বই নিয়ে গিয়ে ওয়াশরুমেই পড়তে থাকতাম ফজর অবধি। এমনকি ঈদের দিনও প্রায়ই ১৫ ঘন্টা পড়াশোনা করেছি।অবশেষে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করি,পরীক্ষা দিয়ে কিছুটা আশাবাদী ছিলাম কিন্তু পরীক্ষার্থী সংখ্যা দেখে ভাবলাম এত লক্ষাধিক স্টুডেন্টদের মধ্যে আমার চান্স কি আসলেই সম্ভব? রেজাল্টের দিন এলাকার কম্পিউটার দোকানে গিয়ে রেজাল্ট চেক করে যা দেখলাম তা দেখে রীতিমতো হতবাক হলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে নির্বাচিত হলাম। তখনই মনে হলো, আমার এত বছরের শিকার হওয়া লাঞ্চনা, বঞ্চনা আর অপমান সব এক মূহুর্তেই বিদায় নিল আর সেদিন থেকে আমি পৃথিবীর সুখী মানুষ হিসেবে মনে করি যেদিন নিজেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে নির্বাচিত হলাম।আমার এমন সাফল্যে যারা এতদিন তুচ্ছ তাচ্ছিল্য আর অপমান করেছিলো তাদের হতবাক আর খুশি হওয়া দেখে আমার জীবনের সাথে একটা সত্য চিরন্তন হয়ে যায় তা হলো- আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।