জাহিদুজ্জামান জাহিদ
আমি খুব সাধারণ একজন মানুষ, আমার নাম জাহিদুজ্জামান জাহিদ।আমার আরেকটা বড় পরিচয় আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা,যে পরিচয় দিতে আমার অনেক শান্তি লাগে।এখন সমসাময়িক সময়ে করোনা যোদ্ধারা যেমন করে নিজের জীবন বাজি রেখে কাজ করে যাচ্ছে,আমিও তেমন ১৯৭১ সালে নিজের জীবন বাজি রেখে দেশকে স্বাধীন করেছিলাম। আমার বয়স এখন ৭১ বছর। চুলগুলো এখন আর কালো নেই,সব পাক ধরে গেছে। ফ্লাসব্যাক করে চলে গেলাম আমার সেই সোনালি অতীতে। সময় তখন ১৯৭১ সাল, আমি তখন ১৯ বছরের টগবগে তরুন, আমরা ছিলাম ১০ ভাই বোন, তখন অবশ্য ছোট বোন বুড়ির জন্ম হয়নি, বুড়ির ভালো নাম ছিলো শিরিন সবার ছোট ছিলো তাই আদর করে সবাই বুড়ি ডাকতাম এখনো আমার আদরের বোনকে সবাই বুড়ি বলেই ডাকে,বুড়ি নাম নিয়ে ছোটবেলা ছিল তার হাজারো অভিমান,যাই হোক আমি ছিলাম আমার বাবা,মায়ের দ্বিতীয় সন্তান। আমাদের সবার বড় বোন আমাদের বুবু,নাম তার হোসনেয়ারা। তখন আমার বুবু ছিলো অনেক সুন্দরী একজন মেয়ে, সবাই দেখলে বলতো লাউ ফুলের মত গায়ের রং আমার বুবুর, আমার বুবু এর জানের টুকরো ছিলাম আমি, খুব আদরের ভাই ছিলাম, বুবু আর আমি একসাথে খেলাধুলা করেছি বড় হয়েছি এক সাথে। আমার মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার পেছনে একটি কাহিনি আছে। সময়টা তখন ১৯৭১ সালের জানুয়ারী মাস, পাকহানাদার বাহিনীর বরর্বতা যেন দিন দিন বেড়েই চলেছে, গ্রামের সবাই আতংকে থাকে কখন কি হয়ে যায়।পাশের গ্রামে থাকতো আমার বন্ধু বিমল আর তার পরিবার,তারা ভয়ে ইন্ডিয়া চলে যাবে, যাওয়ার সময় বন্ধুকে জরিয়ে ধরে অনেক কেদেছিলাম ওই দিন। আমার ছোট বেলার খেলার সাথী আজ অন্য আরেক দেশে চলে যাচ্ছে ভাবলেই তখন বুকটা মোচড় দিয়ে উঠতো,আজও তার কোনো খবর পাইনি আমি। আস্তে আস্তে দিন পার হচ্ছে, আর পাকবাহিনীর বর্বরতা যেন বেড়েই চলেছে, আমার বুবুকে এখন আর মা আগের মত বের হতে দেয়না, বুবু সারাদিন বাসায় বসে থাকে, যে বুবুকে নিয়ে আমি সব জায়গায় যেতাম ওই বুবু আজ ঘর বন্দী। সবার ভিতর একটা আতংক কাজ করে কখন আবার পাক বাহিনী গ্রামে টহল দেয় এটা ভেবে, যখন পাকবাহিনীর টহল আসে ঘরের মা,বোনরা তখন তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিতো, সবাই যেন খাচার বন্দি পাখির মত হয়ে গেছে। ফেব্রুয়ারি মাস,,, ঘরে পাকা ধান উঠেছে, পাকা ধানের গন্ধে সারা বাড়ি ভরে গেছে।আকাশে ভালো রোদ উঠেছে তাই মা আর সব ভাইবোন মিলে আজ ধান সিদ্ধ করবে, উঠানে মাটি খুরে বড় চুলা বানানো হলো, মা আর বুবু মিলে ধান সিদ্ধ করে,আমি আর আমার ভাই মিলে চুলায় লাকড়ি দিয়ে আগুন ধরাচ্ছি চুলায়।দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে আর সিদ্ধ হচ্ছে ধান, আগুনের এতো তাপ যে চুলার সামনে গেলে শরীর একদম সিদ্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম তাও সব ভাইবোন মিলে ধান সিদ্ধ করে যাচ্ছি। হঠাৎ কারা যেন চিল্লাচিল্লি করে বলে উঠলো "পাক বাহিনীর গাড়ি আসতাছে, গাড়ি আসতাছে" এই কথা শুনে সবাই হুরাহুরি শুরু করে দিলো,আমার মা আমার ছোট বোনকে কোলে নিয়ে আমাদের বলতে লাগলো তাড়াতাড়ি ঘরে আয়,পাশ থেকে বুবু বলে উঠলো "মা, ধানতো পুইড়া যাইবো" মা তখন ধমক দিয়ে বুবুরে বললো" ওই মাইয়া তারাতাড়ি ঘরে আয় নাইলেতো মরবি" তখন সবাই তাড়াহুড়ো করে ঘরে যাবো,বুবু আমার হাত ধরে বলে উঠলো, "ভাই তারাতাড়ি আয়, ঘরে যাই" বুবু আমার যেই উঠতে যাবে চুলার পাশে রাখা লাকরির স্তুপে পা লেগে পরে যায় জলন্ত চুলায়!! সাথে সাথে বুবুর চিৎকারে আকাশ যেন কেপে উঠেছে,আমিও চিৎকার করে বুবু বলে ডেকে উঠি!আমার মা যেন ওই এই দৃশ্য দেখে প্রায় অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার উপক্রম। বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে আমার বুবুর চিংকারে,তখন কিসের পাকবাহিনীর ভয়, কিসের কি, কোন কিছুই যেন আর ভয় করছেনা আমাদের, হায়রে ভাগ্য! ওই দিনের ওই দৃশ্য আজও ভেসে উঠলে গায়ের লোম দাড়িয়ে যায়, সাথে সাথে বুবুকে চুলা থেকে উঠিয়ে নিতে নিতে আগুন তার কার্জ সাধন করে ফেলেছে, আমার অপরূপ সুন্দরী বুবুর ডান পাশের মুখ সহ পুরো শরীরের ডানপাশটা পুরো ঝলসিয়ে গেছে! আমার যে বুবুর লাউ ফুলের মত গায়ের রং ছিলো, যে বুবুরে দেখলে সবাই বলতো কার মেয়ে এটা এতো সুন্দর দেখতে!! আজ ওই বুবুর মুখটা পুড়ে বিকট হয়ে গেছে। বাবা দূর থেকে বড় কবিরাজ নিয়ে এসেছে, আমার বুবুরে কবিরাজ মাটিতে কলাপাতার বিছানায় সোয়ায় রেখেছে সাথে কি যেন পাতার রশ দিয়ে গেছে, আমি দূর থেকে আমার বুবুর ব্যাথায় কাতরানো দেখেছি শুধু! আমি দরজার আড়াল থেকে শুধু দেখতাম আমার বুবু আর মা এর কান্না। যে সব মানুষগুলো আমার বুবুর রুপের প্রশংসা করতো আজ তারা সবাই আমার বুবুকে দেখে যায় আর আফসোস করতে থাকে, "আহারে কি সুন্দর মেয়েটার কি হয়ে গেলো", এখন আর কেউ বলে না আমার বুবু দেখতে সাদা লাউ ফুলের মতন সুন্দর।তখন আর বাসায় থাকতে ভালো লাগতো না, রাতে ঘুমাতে পারতাম না, চোখ বন্ধ করলেই বুবুর সেই চিৎকার সেই পোড়া মুখ ভেসে উঠে। ওই দিন ভাগ্যের জোরে আমার বুবু বেচে যায় কিন্তু পালটে যায় আমার বুবুর জীবন। বুবু এখন আর হাসি মুখ করে সবার সামনে আসে না। হাসবে কি করে আমার বুবু,সে যে কাপড় দিয়ে মুখটা অর্ধেক ঢেকেই রাখে যাতে তার মুখের পোড়া অংশটা দেখা না যায়, তাই বুবুর পুরো মুখের হাসিটা এখন আর দেখাও হয়না।। পরে প্রতিজ্ঞা করি আমিও যুদ্ধে যাবো, যাদের ভয়ে আমার বুবুর হাসিটা চলে গেছে তাদের এই দেশ থেকে বিদায় দিয়ে আমি আমার বুবুর পোড়া মুখের ভুবন ভুলানো হাসি দেখবো ইনশাআল্লাহ। মা আর বুবুর কাছে দোয়া নিয়ে যোগ দেই পাশের গ্রামের ইপিআর বাঙালি আর্মি ক্যাম্পে, তাদের সাথে কিছুদিন কাজ করি তারপর ১৮ই মে হাতিমারা ইউথ ক্যাম্পে ভর্তি হই, ১২ দিন থাকার পর ১লা জুন আমাদেরকে ট্রেইনিং এ পাঠানো হয়। বাঘরামা ট্রেইনিং সেন্টারে ৪ নং প্লাটুন কমান্ডার হই, ২১ দিন টেইনিং এর পর অস্ত্র নিয়ে মেলাঘর আসি ওই খান থেকে আমাদের বাড়ির কাছে এসে বাংগালী ইপিআর আর্মিদের সাথে যোগ দেই, পুরো দমে যুদ্ধ শুরু হলো। ল্যাফটেনেন্ট দিলারুল আলম স্যার,ওস্তাত সুবেদার মেজর জবেদ আলি, মেজর জালাল, হাবিলদার তাহের, হাবিলদার ইমান আলি আরও অনেক সেনাবাহিনীর লোক ছিলো। তারপর সময় যায় চলে আসে ১৬ই ডিসেম্বর, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়, বাড়ি এসে দেখি আমার বুবু এর হাসি। সেই পোড়া মুখের হাসি, যে হাসির দেখার জন্য আমার যুদ্ধে যাওয়া। স্বাধীনদেশে আমার বুবুর পোড়া মুখের হাসি আমি আজও ভুলিনি।