দেখা হবে বিজয়ে

মোঃ আরমান হোসেন

২০১৫ সাল। সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষা দিলাম। পরীক্ষা দিয়ে এসে শুনি, পরীক্ষার আগের রাতেই প্রশ্ন ফাঁস হয়ে গিয়েছে। ফলাফল সরকারি মেডিকেলে চান্স হলোনা। তাই, প্রশ্ন ফাঁসের বিরুদ্ধে বন্ধুরা মিলে আন্দোলন শুরু করলাম। প্রায় এক মাস ধরে সবাই প্রতিবাদ করলাম কিন্তু কোন লাভ হলো না। দেশব্যাপী হাজার হাজার শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ, শ্রম বিফলে গেলো। এরপর অগত্যা সবাই যে যার মতো বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে লাগলাম। আমিও একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ভর্তি হয়ে গেলাম। যখন আমরা প্রশ্ন ফাঁসের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করলাম, তখন আন্দোলনের সুবিধার্থে ফেসবুকে একটি মেসেঞ্জার গ্রুপ খুলেছিলাম। সেই গ্রুপে আন্দোলন কোথায়, কখন, কিভাবে করবো সে বিষয় নিয়ে আলোচনা হতো। আন্দোলন যখন বিফলে গেল, তখন আমরা ভাবলাম গ্রুপটাকে এভাবে বন্ধ হতে দেয়া যাবে না। সবাই মিলে একত্রে ভালো কিছু একটা করলে কেমন হয়? ভালো কাজের উদ্দেশ্যে, মেসেঞ্জার গ্রুপের সবাই মিলে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন শুরু করলাম। আমি সংগঠনের নাম দিলাম "অনুপ্রয়াস"। ঠিক করলাম, নিজেদের ক্ষুদ্র প্রচেষ্টায়, অসহায় এবং সাধারণ মানুষকে সাহায্য করাই আমাদের আসল উদ্দ্যেশ্য হবে। আমাদের তৈরী করা সংগঠন অনুপ্রয়াস এর মাধ্যমে, ২০১৫ সাল থেকে আজ পর্যন্ত অসংখ্য সেবামূলক কাজ সম্পন্ন করেছি। ক্ষুধার্ত,শীতার্ত কিংবা বন্যার্ত, জরুরী প্রয়োজনে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছি । মেধাবী দরিদ্র শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার খরচ দিচ্ছি। ইয়াতীম বাচ্চাদের জন্য নতুন পোষাক এবং শিক্ষাসামগ্রী বিতরণ করেছি। সবচেয়ে বেশি কাজ করতে পেরেছি করোনকালীন সময়ে। লকডাউনে যখন দরিদ্র মানুষেরা কর্মহীন হয়ে পড়লো। তখন আমরা প্রায় ৫০০ পরিবারের মাঝে খাদ্য ও স্বাস্থ্যসামগ্রী বিতরণ করেছি। প্রায় ১০০০ মানুষের মাঝে মাস্ক বিতরণ করেছি। করোনাসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয়ে অনলাইন এবং অনলাইনে কয়েক হাজার মানুষকে সচেতন করেছি। করোনার টিকা নিতে উদ্ধুদ্ধ করেছি এবং প্রায় ৩০০ সাধারণ মানুষকে টিকার জন্য রেজিস্ট্রেশন করে দিয়েছি। এ বছর যখন করোনায় আক্রান্তের হার খুব বেশি বেড়ে গেলো। তখন করোনায় আক্রান্ত মানুষের জন্য, আরেকটি সংগঠন, সংযোগ - কানেক্টিং পিপল এর সাথে যুক্ত হয়ে বিনামূল্যে অক্সিজেন সেবা দিয়েছি। প্রায় ১০০ জন করোনায় শ্বাসকষ্টে থাকা মানুষকে জরুরী অক্সিজেন সেবা দিয়েছি। আমরা বেশ কয়েকজন মেডিকেল স্টুডেন্ট হওয়ায় "অনুপ্রয়াস" এর মাধ্যমে ফরিদপুরের বেশ কয়েকটি বিদ্যালয়ে প্রাথমিক এবং জরুরী স্বাস্থ্য সেবা সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের শিখিয়েছি এবং এখনো শিখিয়ে চলেছি। প্রায় ৬ বছর ধরে আমার স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন অনুপ্রয়াস, ফরিদপুরে নানাবিধ সেবা এবং সচেতনতামূলক কার্যক্রম করে আসছে। এখন অবধি প্রায় ৫০+ ইভেন্ট এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষাভাবে প্রায় ৪০ হাজার মানুষকে সহযোগিতা করতে পেরেছি। স্বেচ্ছাসেবী কাজে অবদান রাখার জন্য জাতীয়ভাবে পেয়েছি বেশ কিছু সম্মাননা। জাতিসংঘ স্বেচ্ছাসেবক এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় থেকে পেয়েছি আইভিডি ভলান্টিয়ার এওয়ার্ড -২০২০। এছাড়াও কোভিড-১৯ হিরো এওয়ার্ড, ভলান্টিয়ার এক্টিভিজম এওয়ার্ড, ইয়ুথ স্পিরিট এওয়ার্ড সহ পেয়েছি আরো নানাবিধ সম্মাননা। ভাগ্যের কি পরিহাস! ২০২০ সালে এসে প্রমাণিত হলো, ২০১৫ সালের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। ( সূত্র : প্রথম আলো এবং সময় টিভি) আর আমাদের সেই ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের বিরুদ্ধে আন্দোলনের গ্রুপ আজ দেশের অন্যতম স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন "অনুপ্রয়াস"। মহান আল্লাহর ইচ্ছায় আমিও চিকিৎসক হওয়ার পথে। আল্লাহ চাইলে ৩/৪ মাসের মধ্যে আমার নামের সামনে চির কাঙ্খিত ডাক্তার নাম বসবে। মানুষের সেবা করার জন্য চিকিৎসক হতে চেয়েছিলাম। একটি দুর্ঘটনায় সরকারি মেডিকেল কলেজে পড়তে না পারলেও বেসরকারি মেডিকেল কলেজে পড়ে একজন চিকিৎসক হওয়ার দ্বারপ্রান্তে এবং চিকিৎসক হওয়ার আগেই অনুপ্রয়াস এর মাধ্যমে হাজার হাজার মানুষকে সেবা করার সুযোগ পাচ্ছি। এখন, চিকিৎসক হয়ে আরো নতুন উদ্যমে আরো বেশি মানুষের পাশে থাকতে চাই, তাদের নিঃশর্তভাবে সেবা করে যেতে চাই। একটি প্রশ্নফাঁস এবং কিছু স্বপ্নভঙ্গ। কিন্তু সেই ভগ্নস্বপ্নকে জয় করাটাই আমার কাছে আসল বিজয়। আজ আসিফ ইকবালের গানের লাইনের মতোই বলতে চাই, "যদি লক্ষ্য থাকে অটুট, বিশ্বাস হৃদয়ে, হবেই হবে দেখা, দেখা হবে বিজয়ে।"