Razoana Shik Anta
"তিশাদের বসার ঘরে অপেক্ষা করছি, তিশার বাবার জন্য। ওনার থেকে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনবাে।যদিও চাচা নিজে যুদ্ধ করেনি, তবুও তার পরিবারের সকলেই যেনো যোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধে সে সব হারিয়েছে। "এসব ভাবছিলাম আমি। হঠাৎ তিশা আর তার বাবা আসলেন, তিশা আমাকে দেখিয়ে বললো " বাবা!ও হচ্ছে মিতু।আমরা একসাথে পড়ি।ওকে যুদ্ধের গল্প শোনাও, বেচারি বিদেশে থাকতো তাই ধারণা কম বিজয়ের ইতিহাস নিয়ে। আমি চাচাকে সালাম দিয়ে বললাম, "চাচা ভালো আছেন? " চাচা হেসে বললো,"জ্বি আম্মা।" তিশা বললো, "তুমি গল্প শুরু করো, আমি চা নিয়ে আসি। " চাচা জানালার কাছে চেয়ারে বসলেন আর বললেন, "দেশের এখনকার অবস্থা দেখলে যুদ্ধের ত্যাগের কথা বলতেও শরম করে।তবুও তোমরা আগামীর ভবিষ্যৎ আর জানতে চাইসো তাই বলা তো উচিত। তবে শুনো মা!১৯৭১ সালে আমি ক্লাস ফোরে পড়তাম, আর আমার বড় আপা সেভেনে আর ছোডো বইন ১ মাসের। আমার আব্বার হাটে দোকান ছিলো, সুখের সংসার। হঠাৎ যুদ্ধ শুরুর দিন থেকে আব্বা মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিলো।১বা ২ মাস পর একবার দেখা করতে বাড়ি আসতো।মা, আপা আর আমি ডরে থাকতাম, কখন জানি খারাপ খবর আসে। আমার ছোটো বইন আসার ১ মাস পর আব্বা আসলো,বইনের চান্দের মতো মুখ দেইখা কি খুশি সে।বাড়িত সে দিন ঈদ আছিলো বলতে গেলে।রাইতে রানতে গিয়া আম্মা দেখলো লবণ তখন সে আমারে কয়েক মিটার দূরে দোকানে পাঠাইলো।লবণ নিয়ে বাড়ির কাছে আসতেই দেখি গুলির আওয়াজ, বুঝলাম নিশ্চয়ই কোনো সমস্যা। বাড়ির পিছনের ঝোপ দিয়া বাড়ির ভিতর উঁকি দিয়া দেখি, আব্বার নিথর দেহ মাটিতে আর রক্তে লাল চারদিকে। বড় আপার কোল থেইকা ছোটো বইনরে খাটে ছুড়ে দিলো।বড় আপারে নিয়া যাইতাসে, আম্মা পা ধরে আটকালে তারেও লাথি দেয় শয়তান মিলিটারির দল।আপারে নিয়া গাড়িতে উঠলে, আমিও পিছু নিই।হঠাৎ নদীর উপর ব্রিজ পার হওনের সময় দেখলাম গাড়ি থেকে কেউ নদীতে ঝাপ দিলো,ওড়না দেখেই বুঝলাম এটা আপা। সম্মান বাঁচাতে জীবন দিলো।এতো স্রোত ওর কোনো চিহ্ন ও দেখলাম না।চোখের পানি আটকায়া বাসায় আইসা দেখি মা আর ছোটো বইন হাসপাতালে, বাপজানরে দাফনের ব্যবস্থা করতাসে।আব্বার কবর দিয়া হাসপাতাল যেয়ে শুনি আম্মা বোধশক্তি হারাইসে কথা কয় না,কথা শুনেও না।আমার চান্দের মতো বইনরে ওরা ছুড়ে ফেলার জন্য সেও মস্তিষ্কে রক্ত ক্ষরনে হারাইসে মানসিক ভারসাম্যতা।সেই রাতে আমি হারাইসি আমার সব কিছু, চোখের পানিও আসে নাই এতো দুঃখে।"এক দীর্ঘশ্বাস দিয়ে কথা শেষ করলেন। আমি নির্বাক হয়ে গেলাম সমস্ত ঘটনা শুনে। তারপর সামলে নিয়ে বললাম,সরকার থেকে সাহায্য পাননি? মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা তো মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট দিয়ে অনেক সুবিধা পাচ্ছে।আমি তো কখনো তিশাকে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ব্যবহার করতে দেখিনি।আপনি সার্টিফিকেট নেন নাই? চাচা হেসে বলে,"একবার আব্বারে বলছিলাম যুদ্ধ করলে কি লাভ?আব্বা কইলো," দ্যাশ আর মায়ের জন্য কিছু করলে লাভ খুজতে হয় না,শুধু ভালোবাসা রাখতে হয় খাঁটি। সাচ্চা দেশপ্রেমিক স্বার্থ ছাড়া জীবন দেয় তার মায়ের মতো দ্যাশের জন্য। "আমিও এটাই মানি।সার্টিফিকেট দিয়া আমি হয়তো কয়টা সুবিধা পামু কিন্তু আমার আপনজন পামু না,ঐ সার্টিফিকেট লাগবো না,মা! সার্টিফিকেট দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা প্রমাণ হবার চেয়ে, সাচ্চা দেশপ্রেমিক হওয়া অনেক বেশি দরকার। " এমন সময় তিশা আর তার মানসিক ভারসাম্যহীন ফুপি আসলো। তার ফুপিকে দেখে মনে হলো, সকল প্রতিবন্ধকতা তুচ্ছ করে সটান দাড়িয়ে আছে আমাদের বাংলাদেশ। অনেক অপ্রাপ্তি থাকুক, তবুও আমরা কৃতজ্ঞ বাংলার প্রতিটি ধূলিকণার কাছে।এই দেশমাতার মমতায় আমরা চিরঞ্জীব। এই পৃথিবী জানুক,তুমি আমার বাংলা