নিয়তি

Muntasir Mamun

মাসুমের বয়স ১২ ছুঁই ছুঁই। বছর দুয়েক হয় স্থানীয় একটা ইট ভাটায় কাজ করছে সে।তার দৈনিক ১২০ টাকার মুজুরি দিয়ে পৃথিবীর বুকে প্রাণচাঞ্চল্য ধরে রেখেছে চারটি সৃষ্টির সেরা জীব।মা আর দুটি কোমলমতি ছোটবোন নিয়ে তার পিতৃহীন সংসার।নিয়তি তাকে ক্লাসরুম আর খেলার মাঠ থেকে নিয়ে আছড়ে ফেলছে তপ্ত ইট ভাটায়। মায়াভর্তি গোলগাল একটি মুখে সূর্যের ন্যায় তেজ দীপ্ত দুটি চোখ দিয়ে আলো দিয়ে যাচ্ছে পিতৃহীন পরিবারকে। কচি লাউয়ের ডগার মতো দুটি কোমল হাত দিয়ে আগলে রেখেছে অসহায় পরিবারকে। মাথা থেকে ঝরা পড়া প্রতিফোটা ঘাম জলের মতো প্রাণ সঞ্চার করে চলেছে পিতৃহীন নেতিয়ে পড়া পরিবারকে। কষ্টের নির্মম কষাঘাতে মচকায় সে কিন্তু ভেঙে পড়ে না। সংগ্রামই যার নিয়তি তার কি দমে থাকলে চলে। গ্রীষ্মের প্রখর তাপ দাহে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়, জিহ্বা শুকিয়ে হয় শুষ্ক মাঠ কিন্তু তার দায়িত্ববোধ শুকায় না। শুকায় না পরিবারের প্রতি ভালোবাসা। সে শুধু জানে পৃথিবীর এই জনসমুদ্রে জীবনটা তার ভেলা হাত দুটো তার বৈঠা। আজন্ম পরিবার সহ বেয়ে যেতে হবে এই জীবন-ভেলা। " জানি শুধু চলতে হবে এ তরী বাইতে হবে আমি যে সাগর মাঝি রে।" এটাই তার কাছে জাতীয় সংগীত এখন। মাসুমের বাবা মারা যায় একটি সড়ক দুর্ঘটনায় বছর তিনেক আগে। ছিলেন লেগুনা চালক। মৃত্যুর দূত ট্রাক সেজে এসে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল তাকে। সে থেকেই মাসুমরা হয়ে গেল মূলহীন গুল্মলতা। বৈরী বাতাসে বহুবার সে গুল্ম সদৃশ পরিবার মুখ তুবড়ে পড়েছে।বস্তির ভাড়া বাসা ছাড়তে হয়েছে ভাড়া না দিতে পারায়। মাসুমকে ছাড়তে হলো স্কুল। অসহায় মা সন্তানদের পাখির মতো মুখে করে নিয়ে দিকভ্রান্ত পাখির মতো ডানা ঝাপ্টে দিকবিদিক ছুটে বেড়িয়েছে। অনাহারে ক্লিষ্ট সন্তানের জরাজীর্ণ মুখের দিকে তাকিয়ে অসহায়ের মতো মুখ লুকিয়ে কেঁদেছেন মা। মায়ের চোখের নোলা জলে অদৃশ্যলোকে কত মিঠা পানির হ্রদ লবণাক্ত হয়েছে সে কথা অন্তর্যামী জানে। মাকড়সার মতো নিজেকে সন্তানের মুখে আহারে পরিণত করতে চেয়েছিলো। অন্তর্যামি ছাড়া মর্তের কেউই হয়তো সে কথা জানে না। পথে-প্রান্তরে যাত্রী চাউনিতে, ফুটপাতে আটটি নির্ঘুম চোখ দূর নক্ষত্রের মতো ক্ষীণ আভায় কত রাত যে জ্বলজ্বল করে জ্বলেছে সে কথাও অন্তর্যামী জানে।যে আঁচলে সন্তানকে পরম মমতায় জড়িয়ে রেখেছিলো কিছু দিনের জন্য সে আঁচল ভিক্ষার থালে পরিণত হলো। মায়ের কাছে এই ভিক্ষা লজ্জার নয়। এই ভিক্ষা গৌরবের।অন্ন চিন্তার কাছে অন্য চিন্তা নিতান্তই মামুলি। তাদের এই দুর্দিনে দেবতা রূপে হাজির হলো আজগর সাহেব।বহুদিন ধরে তাদের এই দূর্বিষহ জীবনের চিত্র দেখে আসছে তিনি। একটা ছোটখাটো ভাতের হোটেলের মালিক সে। সন্তানদের নিয়ে একজন মায়ের এমন করুণ জীবন সংগ্রাম আজগর সাহেবের মর্মমূলে আঘাত করে। বিবেকের দংশনে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে বসে থাকতে পারেনি সে। একদিন দুপুরে সে মাসুমদের জন্য কিছু খাবার নিয়ে গেলো। পিতার মতো পরম মমতায় নিজ হাতে খাইয়ে দিলো মাসুমের ছোট দুটি বোনকে। খাওয়া শেষে মাসুমের মায়ের কাছে তাদের বেদনাবিধুর জীবন কাহিনী জানতে চাইলেন। কাহিনী শুনে তাঁর সকরুণ মুখাবয়ব হয়ে উঠল এক খন্ড শ্রাবণের আকাশ। দুচোখ জুড়ে এখনি বুঝি নামবে অঝর ধারায় বৃষ্টি। এই যুগেও এমন মানুষ আছে অন্যের দুঃখ যাদের একান্তই নিজের হয়ে উঠে।সেসকল মানুষে হৃদ্যতার জন্যই হয়তো পৃথিবীটা এখনো মানুষের বসযোগ্য। হাল-বিত্তান্ত শুনার পর তিনি মারজাহান বেগমকে তার হোটেলে বুয়ার কাজ করার জন্য প্রস্তাব দিলেন। মাসুমের মা'র চোখে মুখে আনন্দের হাসি। ভাগ্য বিধাতা এই বুঝি সদয় হলো তাদের প্রতি। খাওয়া শেষে আজগর সাহেব তাদেরকে নিয়ে গেলো তার হোটেলে। সেখানে গিয়েই কাজে নেমে পড়লো মারজাহান। মাসুমও মাকে সাহায্য করতে লাগলো কাজে ।আজগর সাহেব তাদেরকে বস্তিতে একটা খুপরি ঘর ভাড়া নিয়ে দিলেন মাসুমকে কাজ নিয়ে দিলো তার বন্ধুর ইটভাটায়। মাসুমের বোনদের ভর্তি করিয়ে দেওয়া হলো স্বেচ্ছাসেবিদের একটা স্কুলে।এভাবেই চলছে লাগলো মাসুদের জীবন। মাসুমেরও খুব ইচ্ছা স্কুলে যাওয়ার কিন্তু দায়িত্বের কঠিন শিকলে তার হাত পা বাঁধা। ইচ্ছা আর দায়িত্বের বিপরীতমুখী সংঘর্ষে পিষ্ট হলো সে।এখন সে নিজের জন্য না বেঁচে পরিবারের জন্য বাঁচতে শিখে গেছে। এত কম বয়সেও তার এমন দায়িত্ব সম্পন্ন মনোভাব যে কোনো মানুষকেই বিস্মিত করবে।বারো বছরের শিশু হয়েও যেন সে চল্লিশ বছরের দায়িত্ববান পুরুষ।জগত সংসার নিয়ে বিধাতার লীলা খেলা বুঝা বড় দায়! মাসুম এখন স্বপ্ন দেখে একদিন তার বোনরা বড় হবে। উচ্চ শিক্ষিত হবে। তাদের জন্য টাকা জমাতে হবে।ব্যবস্থা করতে হবে বসবাসের উপযোগী একটা আশ্রয়স্থল। মায়ের কষ্টও তার সহ্য হয় না আর। সে চায় তার মা ঘরে থেকে বোনদের যত্ন নিক। কিন্তু তার ক্ষুদ্র আয়ের কাছে এমনটা ভাবা বিলাসিতারই নামান্তর। তাই মনের ইচ্ছা মনেই ডানা ঝাপটাঝাপটি করে। তবুও সে স্বপ্ন দেখে একদিন এ আঁধার ঘুচবে। একদিন তার ইনকামও বাড়বে। মাকে আর কাজে যেতে হবে না তখন। বোনদের মাঝে সে নিজের স্বপ্নের চাষাবাদ করে চলছে। একদিন নিশ্চই সোনার ফসলে তার ঘর ভরে উঠবে। মাসুমের মতো এমন হাজারে শিশু দারিদ্র্যের চরম কষাঘাতে জর্জরিত হয়ে কাজ করে যাচ্ছে বিভিন্ন কলে-কারখানায়। একটাই উদ্দেশ্য সেই হাড়ভাঙা খাটুনির। মা-বাবা ভাইবোন নিয়ে খেয়ে পরে পৃথিবীর বুকে নিজেদের অস্তিত্ব কে জানান দেওয়া। এদেশে শিশুশ্রমের আইন আছে। কিন্তু আইন কখনো পারবে এসব শিশুকে অনিবার্য শ্রম থেকে ফেরাতে? যতই আইন করে শিশুশ্রম বন্ধ করা হোক না কেন খালি পেট তো আর আইন মানে না। ক্ষুধা তো আর আইন মানে না। ক্ষুধার কাছে খাদ্যই জাতীয় সংগিত, খাদ্যই জাতিসংঘ। যে শিশুদের পুরো পরিবারের দায়িত্ব তাদের নিজের ঘাঁড়ে; কে নিবে তাদের এই পুরো পরিবারের দীর্ঘ মেয়াদি দায়িত্ব। দায়িত্ব নেওয়ার মতো এমন সহৃদয়বান মানুষ কজনই আছে সমাজে? যতই আইন থাকুক না কেন মাসুমদের নিয়তি কেউ খন্ডাতে পারবে না। সংগ্রামই তাদের নিয়তি।তাদের সংগ্রাম চলবেই। তাদের খেটে যেতই হবে। খাটতেই হয় তাদের। কপালের লিখন বলেওতো একটা কথা আছে।