ফুরকান উদ্দিন
রানুর আজ কোন কাজ নেই,কাজ থাকলেও কোন কিছু করবে না বলে ঠিক করেছে।সকাল থেকে আকাশ ভেঙে থেমে থেমে বৃষ্টি পড়ছে।মনে হয় আকাশ রানুর ভেতরের কষ্টটা বুঝতে পেরেছিল,তাই অবিরাম ঝড়ছে। একটা পোল্ট্রি মুরগি রান্নার জন্য চুলায় চড়িয়েছে রিয়া। রিয়া রানুর দ্বিতীয় মেয়ে।তার জন্মের পর থেকে রানুর কপালে দুঃখ শুরু হল। একটি ছেলের আশায় মোহন অনেক স্বপ্ন দেখেছিল,কিন্তু রানু সেই স্বপ্নে পানি ঢেলে দিল রিয়াকে জন্ম দিয়ে। সেই থেকে অন্য ছেলেমেয়েদের মধ্যে রানু অবহেলিত রিয়াকে একটু বেশিই ভালবাসে। শুরু থেকেই মোহন কাজের প্রতি অনিহা থাকায় সংসারের ঝামেলা কমতো না,সবাই ভাবত ছেলেমেয়ের মুখ দেখলে এমনেই কাজে মন দিবে,ভবঘুরে স্বভাব পরিবর্তন আসবে,কিন্তু হল তার উল্টো। ঝুম বৃষ্টিতে পাতি হাসগুলো উঠানের কাদামাটিতে খাবারের খুজে নোংরা করে যাচ্ছে।রানুর মনটা খুব খারাপ।আজ রাত তিনটার আইতলায় করে ভৈরব যাবে,সেখান থেকে ঢাকা। দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে মন্টা উদাস হয়ে যায়,চোখ দুটো ঝাপ্সা হয়ে যায়। দু'বছর হল বাবাকে হারিয়েছে,তাই অন্য কোন উপায় না পেয়ে জীবিকার খুজে গার্মেন্টস তার একমাত্র ভরসা। বাবা থাকলে যেতে দিত না,বলত,"আমি মরলে ঢাকা গিয়ে গার্মেন্টসে কাজ করে পেট চালাবি, আমি বেচে থাকতে তুদের যেতে দিতে পারি না"। কিন্তু এখন এই কথা বলার কেউ নাই,চোখের জল টপ টপ করে পড়ছে,রানু আনমনে অদূরে তাকিয়ে আছে। স্বামী যদি কর্মঠ হত আজ তাকে বাড়ি ছেড়ে যেতে হত না। সম্মান নিয়ে দু'মোটো খেয়ে জীবন চালাতে পারত। চারটি সন্তান নিয়ে অকুল সাগরে একাই তরী টেনে নিচ্ছে। যদিও বাড়ি ছাড়তে কোন ইচ্ছা নাই,কিন্তু মোহন প্রতিদিন একই কথা,অত্যাচার, মারপিট আর সহ্য হচ্ছে না। এমনকি মেয়েরাও তার মানসিক নির্যাতন থেকে রেহায় পাচ্ছে না। ঘুটঘুটে আধারে রানু ঘরের বাহিরে পা ফেলতেই হাওমাও করে মরা কান্না শুরু করল,তার বাবা মারা যাওয়ার দিনও এমন করে কাঁদে নি। তার ঘুনে ধরা কুঠির খানা ছেড়ে যেতে কলিজা ছিড়ে যাচ্ছে। গভীর রাতে কান্নার শব্দে পড়শি সবাই ভির জামাইছে এবং তাদের উদ্দ্যেশ করে রানু তার বড় মেয়ে এবং দু'ছেলেকে শপে গেল। আগে আল্লাহ পাছে তোমারা একটু খেয়াল কইরো। কলিজার টুকরো ছেলেমেয়ে গুলোকে ফেলে যেতে তার আর সহ্য হচ্ছে না। মোহন বার বার স্বান্তনার বানী শুনিয়ে যাচ্ছে আর মাঝে মাঝে রাগে তার প্রতি তেড়ে যাচ্ছে। একজন পরশি বলে উঠল,"তুই কি কোন দিন মানুষ হবি না?" রানু ঢেকুর তুলে কাঁদতে কাঁদতে ছেলেমেয়েদের বুকে নিয়ে আদর করে, মাথা হাতিয়ে নৌকার ঘাটে ধীর পায়ে ছুটে চলল। যেন খুব মন থেকে চাইছিল কেউ একজন বলুক,ফিরে চলে আসো, ঢাকা যাওয়া দরকার নাই। কিন্তু কেউ সেই কথাগুলো বলে নি। নৌকা গুলো বাজারের মালামাল টানার কাজে ব্যবহার হয়,তাই এখানে ভাল করে বসে বা শুয়ে সময় কাটানোর কোন জায়গা পেল না। একধারে হেলান দিয়ে রাতটুকু পার করে সকাল দশটা অব্দি এভাবেই ঘুমহীন কাতর মনে সময় পার হল। মনটা আনছান করতেছে, কি করছে ছোট্ট ছেলেমেয়ে গুলো।কি খাবে,কিভাবে রাধবে,কে বিছানা করে দিবে,কে গোছল করাবে,সন্ধ্যায় কে ঢেকে ঘরে ফিরাবে। হাজারো প্রশ্ন রানুর মনটাকে তছনছ করে দিচ্ছে। বারবার এদিক থেকে সেদিকে মোর নিচ্ছে। রিয়া মায়ের মনের অবস্থা বুঝে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে নিজেই কেঁদে ফেলল। বড় মেয়ে পাপিয়া কাজে কর্মে একটু অলস। প্রথম সন্তান তাই একটু বেশি আহ্লদে অলস হয়েছে,কিন্তু পড়াশোনায় তার যথেষ্ট আগ্রহ থাকায় সে ঢাকা যায় নি।ছোট ভাইদের নিয়ে বাড়িতেই থেকে গেল। মোহন পাঠাতনে গামছ বিছিয়ে আরামে ঘুমাচ্ছে। আফসোস বা কষ্টের গ্লানিবোধটুকু তার নাই।পৃথিবীতে কিছু মানুষ সবসময় সব পরিবেশে সুখি ও স্বাধীন থাকে,কোন পিছু টান তাকে ঘায়েল করতে পারে না। মোহন সেই টাইপের মানুষ পরিবারের সংকট তাকে কখনোই স্পর্শ করতে পারে না। সে নিজেই রানু'র জীবনে একটা মহামারী সংকট হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। হাড়িপাতিল,বিছানাপত্র,কাপড় চোপড় সব মিলে তিনটি বস্তা তাদের সাথে আছে।মোহন একটি বস্তা কাধে অন্য একটি হাতে নিয়ে গাড়ির দিকে এগুচ্ছে।পেছনে রিয়া এবং রানু ধরাধরি করে অন্য বস্তাটি টানতেছে। মোহন বার বার চেচাচ্ছে সাবধানে আনো,দেখ ফেলে দিও না। রানু টানতে পারছে না,অনেক কষ্ট করে হাই হুতাশ করে বাসের নিকটে নিয়ে এল। মোহন বলে, এই বস্তাটা আনতে এত পেরেশানি, ঢাকা গিয়ে কাজ করবে কিভাবে! তার প্রতিটা কথা কলিজায় সুচের মত খুচা দেয়। বাসের মধ্যখানে পাশে একটা বস্তা নিয়ে রানু জানালা দিয়ে বাহিরে নির্জীবের মত তাকিয়ে আছে। দেহ টা বাসের খুপড়ির মত সিটে থাকলেও মন টা গ্রামে ফেলে আসা ছেলেমেয়েদের কাছে পড়ে আছে।বাস আধা ঘন্টা চলতে না চলতেই রানু এবং রিয়া বমি করতে শুরু করল। মোহন কিছু আমড়া যোগার করে দিল,রিয়া কে খুব ক্লান্ত মনে হল। রানু রিয়ার মাথা হাতাইয়া দিচ্ছে। কিন্তু কিছু বলতেছে না,ফেলফেলিয়ে অসহায় নয়নে তাকিয়ে আছে। বিকালের মধ্যেই চিটাগাংরোড পৌঁছে গেল। নতুন জায়গায় নতুন পরিবেশে রানু খুব অস্বস্থি লাগতেছে। এখানের সবাই অভাবি হলে ও, সবাই মধ্যেই যথেষ্ট পরিমান মমতার অভাব লক্ষ করা যায়। মানবতার খুব করুন পরিনতি। এর মধ্যেই পাশের এক রুমের সনিয়ার সাথে রানুর সখ্যতা গড়ে উঠে। বিপদে আপদে পরামর্শ দেয়,কাজ যোগাড়ে সহায়তা করে,রানু বাসার ঝিয়ের কাজ করে। রিয়া অনেক বলে কয়ে এক লোককে দু'হাজার টাকা দিয়ে গার্মেন্টসে কাজ শুরু করল। কিছু ভালই যাচ্ছে,কিন্তু মোহন প্রতিদিন নতুন নতুন ইস্যু তৈরি করে রানুর সাথে সন্ধ্যায় ঝগড়া করে যা রিয়ার খুব খারাপ লাগে। তার প্রেস্টেজে লাগে। সারাদিন মন খারাপ হয়।কাজে মন বসে না।বাবাকে অনেক বলে কয়েও মন গলাতে পারে নি। খাবার,ঘুম নিয়ে লেগেই থাকে। সামান্য দোষে রানুর উপর চড়াও হয়ে যায়। বাড়িওয়ালা কয়েকবার সতর্ক করার পরেও তাকে থামাতে পারে নি। বাড়িওয়ালা কথাগুলো রিয়ার মনে প্রচন্ড আঘাত লাগে। রানুর মাথা কাজ করছে না। অভাবে দেশ ছাড়লাম,এখন এই কোন বিপদে পড়লাম।গ্রামে ছেলেমেয়েদের রেখে এলাম,এখানে ও আমার শান্তি নাই। আল্লাহ আমার মরন দেয় না কেন।মরে গেলেও ছেলে মেয়ে গুলোরে যে কেউ ডাক দিবে সেই দরদি নাই এই চান্দের তলে। আজ সকালে রিয়া কাজে যায় নি,তার কয়েকজন সহপাঠী এসে খুঁজে গেল,কিন্তু প্রচন্ড জ্বর আর দূর্বলতা তাকে বিছানায় শুইয়ে দিল। সারটাদিন মেয়েটা এত পরিশ্রম করেও মোহনের কাছে কোন আদর পায় না,উল্টো বকাঝকা মারামারি অতিষ্ঠ করে ফেলে। জ্বরের ঘোরে বলতে থাকে,আমি মরলে যদি তোমাদের শান্তি হয়। যেমন মা,তেমন মেয়ে বলে মোহন রিয়াকে বহুবার খুটা দিয়েছে। সেই কথাগুলো বারবার বকতেছে। কিছু ডাক্তারি চিকিৎসা ও করা হয়েছে। একটু জ্বর থেকেছিল,আবার আগের মত বেড়ে গেছে। সন্ধ্যায় ঔষধ খাওয়াতে পারে ন,কথাগুলো অস্পষ্ট। ওষুধ খাওয়াতে গেলে মায়ের প্রতি বিরক্ত হয়ে যায়। রানুর মনটা মেয়ে কে নিয়ে একটু বেশিই উদ্ভিগ্ন। সনিয়ার সাথে চোখের পানি টপটপ করে ফেলে অস্পষ্ট সুরে বলেও ফেলল,আমার রিয়া কি বাচবে না। মোহন রানুকে সান্ত্বনা দিল,আল্লাহ অসুখ দিয়েছে আল্লাহ সারাবে। কিন্তু তার কোন যত্ন বা ডাক্তার দেখানোর প্রয়োজন তার মধ্যে লক্ষ করা গেল না। রাত ১১.৩০ বেজে গেল। রানুর খাওয়া দাওয়া নেই। আজ কাজেও যায় নি। সারাদিন খাওয়া নেই।শরীর টা আর চলতেছে না। মেয়েটাকে রেখে দূরে যেতেও মন চাইতেছে না।চোখের জল মুছে,আর মেয়েটার প্রাণহীন চেহারার দিলে তাকিয়ে কাদে। রিয়া তাকে খাবারের জন্য কয়েকবার তাগিদ দেওয়ার পরেও রানু শুনে নি। এবার একটু শক্তি নিয়ে রিয়া বলতে লাগল,মা আমি ভাল হলে বাড়ি চলে যাব। এখানে তোমার কষ্ট বেশি হয়। বাবাও পাশে কেউ নেই এই সুযোগ পেয়ে তোমার প্রতি খারাপ আচরণ বেশি করে। বাড়ি থাকলে এক বেলা খেয়ে থাকব। আমি ভাল হলে, এই মাসের বেতন পেয়েই আমরা চলে যাব। এখানের পানি ভাল না,আমি খাইতেই পারি না। আমরার গ্রামের মসজিদের পানি মধুর মত মিঠা লাগে। রানু বলল,এত কথা কইস না মা। একটু ঘুমা। রিয়া বলল,সারাদিন শুইয়া থাইকা আমার আর ভাল লাগে না, মা। রিয়া একটু পানি চাইল এবং রানু খাওয়ালো। মুটামুটি কিছুটা ভরসা করা যায়। তারপরেও রানু মোহনকে জাগালো, বলল রিয়া একটু বেশিই কথা বলতেছে।আমার ভাল লাগতেছে না। তুমি উঠো না? মোহন কোন সারা না দিয়ে অন্য পাশ হয়ে শুয়ে পড়ল। রানু বাম হাতটা গালের উপর ভর করে দগ্ধ হৃদয়ে উদাসী নয়নে অসহায়ের মত কাদতে লাগলো। কোন সময় তার চোখ দুটি লেগে এসেছে বলতে পারে নি। ক্লান্ত চোখ,ক্লান্ত মন,ক্লান্ত দেহে ঘুম ছাড়ে না।রাতে না খাওয়াতে পেট পিঠ একসাথে লেগে গেছে। ভোরে ঘুম ভাঙতেই ছটফট করে অপরাধীর মত রিয়ার মুখের কাছে ছুটে গেল। ঠান্ডা কপালে হাত রাখতে চিৎকার দিয়ে রানু মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। "মা'রে তুই কই গেলি? ও মা কথা ক? ও আল্লাহ আমার কি সর্বনাশ অইল!"