Lamisa Sanjana
বাংলাদেশ নামক এই মাতৃভূমি, যার শুরুটা থেকে শেষ অব্দি পর্যন্ত সংগ্রামের ছিঁটে ফোঁটা রক্ত দিয়ে লেখা সাহিত্য গড়া, সেই মায়ের কন্যা হয়ে আমাকে যে সংগ্রাম করতে হবে না এটা কি ভাবা যায়! মানুষের জীবনে সব থেকে বড় সংগ্রামই হয় নিজের সাথে নিজের। আমার সংগ্রামও ঠিক তেমনি। সবসময়ই নিজের সাথে নিজের বা নিজের সাথে ভাগ্যের সংগ্রাম করতে হয়েছে আমাকে । সমাজ সমাজিকতা বা অন্য কোন কিছুর সাথে সংগ্রাম করতে হয় নি কখনোই কারণ আমার বাবা আমার সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছেন সব সময়। যেমনটা দেশ এবং দেশের মানুষের সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আমি আমার বাবা মায়ের সর্বপ্রথম সন্তান। পলকে তুলে লালিত পালিত সন্তান। সময়টা ২০১৮ সাল, ফেব্রুয়ারি মাস। মাতৃভাষা দিবসের মাস। প্রায় দুই মাসের মত সময় আছে এইচ এস সি পরীক্ষা দেওয়ার। খুব করে পড়া লেখা চলছে। বাবা ভাবলেন একটা কোচিং সেন্টারে ভর্তি করিয়ে দিলে, ভালো হবে। তাই, মাসের প্রথম সপ্তাহে আমাকে ভর্তি করা হলো। ছোটবেলা থেকে এখন অব্দি আমাকে বাবাই নিয়ে যাতায়াত করেন। পরীক্ষা হোক, বা ঘুরতে যাওয়া, একা ছাড়ার প্রশ্নই আসে না। কলেজে থাকতে বাবা মা দুইজনেই হজ করতে যাবেন তাই অনেকদিন একা যাতায়াত করতে হয়েছিল। কলেজে বন্ধুবির সাথে যেতাম। কলেজের পথেই সেই কোচিং। প্রতিদিন বাবা নিয়ে যেতেন। আমার স্পষ্ট মনে আছে, সেদিন ১৭ই ফেব্রয়ারি বিকেল ৪:০০ টায় আমি একাই বেরিয়ে পরি কোচিং সেন্টারে যাওয়ার জন্য, কারণ বাবার সেদিন কাজ পরে গিয়েছিল খুব। বাসা থেকে বেরিয়ে রিক্সা নেই। সেদিন খুব সুন্দর আবহাওয়া ছিলো। রিক্সা চলছে, আমি দেখছি পথের গল্পগুলো যারা প্রতিনিয়তই গড়ে উঠে, জীবনযাত্রার মাধ্যমেই। হঠাৎই একটা গাড়ি খুব জোড়ে আমাদের দিকে ছুটে আসল, আমি দেখছি সেই গাড়িটা আসছে, আমি শক্ত করে ধরে রেখেছি রিক্সার হ্যান্ডেল। কয়েক মিনিট পর কি হলো বুঝতে পেলাম না। চোখের সামনে অন্ধকার চেয়ে গেছে। পুরো দেহ কেমন দুর্বল হয়ে গেল। চারপাশে মানুষের কোলাহল শুনতে পারছি। চোখ খুলে দেখলাম, আমাকে ঘিরে মানুষের ভীড়। আমি মাঝ রাস্তায় পড়ে আছি। দুটো আপু আমাকে সাহায্য করেছিলেন উঠে দাঁড়াতে। আমি উঠে দাঁড়াই। আমি কিছুটা অন্যরকম অনুভব করতে পারলাম। ভেবে নিচ্ছিলাম, হয়তো আমি পরে যাওয়ার কারণে এমন লাগছে। আমাকে রাস্তার পাশে নিয়ে গিয়ে বসানো হলো। পানি খাওয়ানো হলো। আমার কাছে সেদিন মোবাইলও ছিল না। আমি স্পষ্ট কথা বলতে পারছিলাম না, কেমন যেন কথাগুলো জড়িয়ে যাচ্ছিল। তবুও বললাম, "আমার বাবাকে একটা কল দিবো"। ঐ দুজন আপু থেকে একজন আমাকে ফোন দিলেন। আমি বাবাকে কল করছি। কিন্তু বাবা ধরছিলেন না। ' কী করবো এখন! ভাবতে ভাবতে মনে হলো রিক্সা করে চলে যাই বাসায়। সেই আপুকে বলল আমাকে একটা রিক্সা করে দিতে। আপু একটা রিক্সা ডাকলেন। আমি রিক্সায় উঠতে গিয়ে বুঝতে পারলাম, আমার ডান হাত যেন নেই। কোন বোধগম্য নেই। হাতটা উঠিয়ে যে রিক্সা ধরবো তাও পারছি না। আমার বুঝতে আর বাকি রইলো না। আমি আপুর সাহায্যে খুব কষ্ট করে এক হাত দিয়েই নিজেকে সামলে নিয়ে রিক্সাতে উঠে বসি। বারবার বাবাকে কল করছি। আমাদের রিক্সা মাঝপথে তখন বাবা ফোন ধরলেন। আমি শান্ত গলায় বললাম, " বাবা, আমি অ্যাকসিডেন্ট করেছি। বাসার দিকে আসছি।" বাবা বললেন, " আমি রাস্তাতেই আছি তুমি আসো।" সেদিন প্রথমবারের মত পঙ্গুত্বের অনুভূতি আমি অনুভব করেছিলাম। বাবা পথেই ছিলেন। মাঝ পথ থেকেই আমাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। ডাক্তাররা বললেন এখনই এক্স রে করতে। সঙ্গে সঙ্গে এক্স রে করে নিয়ে যাওয়া হলো। তা দেখে বললেন, বাহুর হাড় তিন টুকরো হয়ে গেছে। খুব বাজে ভাবে ভেঙেছে। এখন দুটো উপায় আছে। এক হলে হাতের অপারেশন করা লাগবে দুইদিনের ভেতর নয়তো হাত কেটে ফেলতে হবে। স্বপ্ন ছিল আর্মি অফিসার হবো। আর্মির পোশাক পরে বাবা মা কে সেলুট করবো। আমার মৃতদেহের উপর লাল সবুজের জাতীয় পতাকা দেয়া হবে। এসব স্বপ্ন নিমিষেই সব ভেঙ্গে গেলো। আমি সাহসী ছিলাম। এক বিন্দুও কাঁদি নি সেদিন। বাসায় গেলাম। মা দেখে সেই কি আর্তনাদ। তাঁর আর্তনাদ দেখে আমি নিজের ব্যাথা ভুলে গেছি যেন। একটা ভাঙ্গা হাত কতটা যন্ত্রণা দেয়, তা অন্য কেউ অনুভব করতে পারে না। যার হয় সেই জানে। সেই রাত আমার জীবনের সব থেকে বড় এবং ভয়ানক রাত ছিলো। একদিকে হাতের যন্ত্রণা অপর দিকে মনের যন্ত্রণা। একদিন পরই আমার অপারেশন হলো। প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলাম সেদিনও। ডাক্তাররা বলেছিলেন "আপনার মেয়ে অনেক সাহসী"। কেন বলেছিল আমি জানি না। হাতে প্লাস্টার নিয়ে পাঁচদিন পর বাসায় আসি। আর মাত্র এক মাস। তারপর পরীক্ষা। সবাই বলেছিল পরীক্ষা না দিতে স্বাস্থ্য সবার আগে। বাবা এক কথাই বলেছিলেন," ওর যদি মনে হয় ও পরীক্ষা দিবে তাহলে দিবে।" বাবার আমার প্রতি এতো বিশ্বাস দেখে আমি সেদিন অবাক হয়েছিলাম। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম পরীক্ষা দিবো। বাবা ডাক্তারদের সাথে পরামর্শ করলেন। একুশ দিনের মাথায় আমার হাতের প্লাস্টার খুলে দেয়া হলো। কিন্তু হাত এখনো অচল। যেমন শিশু জন্মের পর তাকে হাঁটা শেখানো হয়, কথা বলা শেখানো হয় তেমনি অবস্থা হয়ে গিয়েছিল আমার। একই অবস্থা হাত থাকতে থাকতে সেই হাত কোন ভাবেই সোজা করা সম্ভব হচ্ছিল না। মা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন আমার হাতের মুভমেন্ট ফেরানোর জন্য। সারাদিনের মধ্যে বেশির ভাগ সময় আমার পাশে বসে,গরম পানি দিচ্ছেন হাতে,থেরাপি দিচ্ছেন। অনেক কষ্ট হতো হাত নাঁড়াচাড়া করতে। আমি যদি এখন এই হাত দিয়ে সব কিছু করতে পারি তার একমাত্র কারণ আমার মা। অন্যদিকে বাবা টিচারদের সাথে কথা বলে পরীক্ষার সময় বাড়ানোর ব্যবস্থা করতে লাগলেন। প্রায় প্রতিদিন বোর্ড অফিসে যাচ্ছেন। কথা বলছেন। কাগজ নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছেন। শেষমেশ আমি ভাঙ্গা হাত নিয়েই পরীক্ষা দিলাম। ফলাফল নিয়ে অনেক মতামত ছিল। আমার বাবা ধরেই নিয়েছিলেন আমি বুঝি ফেইল করবো। মা এইক্ষেত্রে বেশ বিশ্বাসী ছিলেন,যে তার মেয়ে খারাপ করতে পারে ফেইল করবে না। তাই হলো ৪.০৮ জিপিএ নিয়ে পাস করে ফেললাম। এই সব কিছুর মাঝে যখন আমার অপারেশন হলো, আমি নিজের কাজ নিজে করতে পারতাম না। নিজের হাতে খাবার খেতে পারতাম না। মা খাওয়ি দিত। রিক্সায় উঠতে পারতাম না, বাবার কাঁধে ভর দিয়ে উঠতে হতো। সচরাচর জীবনের প্রতিটা কাজ বাবা মা করে দিত। আমি প্রতি রাতে কাঁদতাম। যে বয়সে বাবা আমার কাঁধে ভর দিয়ে হাঁটবেন কি, উল্টো আমি তাঁর কাধে ভর দিয়ে হাঁটি। যে বয়সে আমি মায়ের সেবা করবো কি, মা আমার সেবা করেন। এগুলো ভেবে ভেবে নিজেকে খুব অসহায় লাগতো। নিজেকে পঙ্গু মনে হতো। মনে হতো কেন আমাকে জীবিত রাখা হলো? বাবা মায়ের বোঝ হয়ে থাকার চেয়ে বেশি ভালো হতো আমি মরে যেতাম। মানসিকভাবে পুরোপুরি ভেঙ্গে যাই। প্রতিদিন প্রার্থনা করতাম যেন, সৃষ্টিকর্তা অনেক তুলে নেন। আমি এই জীবন চাই না। আমার স্বপ্ন নেই, আমার আশা নেই। আমি কারো বোঝ হয়ে বাঁচতে চাই না । এইভাবে নিজের সাথে নিজে অনেক দিন যুদ্ধ করি। তারপর সব কিছু ঠিক হয়ে আসতে শুরু করলো। নিজেকে এমন ভাবে গড়ে তুলতে শুরু করলাম যেন কারো বোঝ হয়ে থাকতে না হয়। এখন আমি যা করছি, যেমন করছি, অনেক ভালো আছি। সন্তুষ্ট আছি। ২০২১ শেষ হতে চলেছে এখন আমি যখন পেছনে ফিরে তাকাই তখন মনে হয় একটা কথা আছে না "Time heals everything" কথাটা খুব সত্য। সময় সবকিছু ঠিক করে দেয়। তবে যখন প্রতিদিন খবরে, পত্রিকায় দেখি সড়ক দুর্ঘটনায় কতশত মানুষের মৃত্যু, মনটা পুরো ভেঙ্গে যায়। এই ভেবে, আমরা সেই ১৯৭১ সালে স্বাধীন হয়েছি। পাকবাহিনীর ভয় থেকে সাথে স্বাধীন হয়েছি। হিংস্রতা থেকে স্বাধীন হয়েছি। পাকবাহিনীর অত্যাচার, ধর্ষনের কামনা থেকে স্বাধীন হয়েছি। তবুও এই ২০২১ সালে এসেও বাড়ি থেকে বের হতে হয়। যদি পথে কোন ধর্ষকের চাহনি পথ রুখে দেয়? যদি কোন ড্রাইভার মামা আমার উপর বাস ছড়িয়ে দেয়? যদি কোন ক্ষমতাশীল সন্তানের দামী গাড়ির তলে আমার মাথার রক্তাক্ত ছিন্নভিন্ন খুলি পরে থাকে? আমার বাবা মায়ের কি হবে তখন? এই স্বাধীনতার কি হবে তখন? মনে প্রশ্ন জাগে আমরা কি আদৌ স্বাধীন? ১৯৭১ সালে আমাদের মনে ভয় ছিলো ভিনদেশীদের নিয়ে। ২০২১ সালে আমাদের মনে ভয় জন্মায় আপন মাটির মানুষদের নিয়ে। এটাই কি স্বাধীনতা? আমার মত কত জীবিত গল্প পরে আছে এই দেশের আনাচে কানাচে যেগুলো কোন খবরে আসে না। কিন্তু আমাদের মৃত স্বপ্নগুলো দায়ভার কে নেবে?