রাজাকার

নাসরাতুল হোসাইন নিশান

জয় বাংলা....জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু.... জয় বঙ্গবন্ধু! জয় বাংলা....জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু.... জয় বঙ্গবন্ধু! শীতের কনকনে হাওয়ায় আমার শিরদাঁড়া খাড়া দিয়ে যাচ্ছিলো। ইচ্ছে হচ্ছিলো আমিও তাদের মিছিলে সামিল হই। কিন্তু আমার বয়স ছিলো মাত্র ৭। আম্মুর কাছে বায়না ধরছিলাম কিন্তু আম্মু বললো কিছুক্ষণ পর বাবা আসবে। তবুও আমিও চিৎকার করতে থাকলাম ঘর থেকে এই ভেবে আমার ধ্বনি ও যাতে তাদের সাথে মিলিত হয়। জয় বাংলা- জয় বঙ্গবন্ধু! আম্মু আমার দিকে তাকিয়ে হাসছিলো। মুহুর্তের মধ্যেই গোলাবারুদের শব্দ শুনতে পেলাম। লাগাতার গুলিবর্ষণ আর আর্তনাদের শব্দ। আমার জয় বাংলা যেনো ধুলোয় মিশিয়ে গেলো। মা আমার মুখ চেপে ধরলো। আমার গায়ের শিরদাঁড়া গুলো আবার দাঁড়িয়ে গেলো। কিন্তু এবার বাংলার ধ্বনিতে নয়। একটু পর মা মুখ ছেড়ে দিলো। নিস্তব্ধতা যেনো চারিদিক ছাড়িয়ে গেছে। দরজায় কে ঠকঠক করছিলো। আমি মা'র দিকে তাকিয়ে থাকলাম। মা আমায় ইশারায় চুপ থাকতে বললো। দরজা খোলার পর কয়েকজন লোক মা'কে ধাক্কা মেরে বাসায় ঢুকে গেলো। তাদের হাতে মস্ত বড় বড় বন্দুক ছিলো। আমি তা দেখে মিলিটারি বলে চিৎকার করলাম। একজন বন্দুক বের করে আমার মাথায় ঠেকালো।মা'র তারা বন্দী করে রাখাতে চিতকার ব্যতীত কিছুই করতে পারছিলেন না এ দৃশ্য দেখে। আমার বন্দুকের প্রতি খুব আগ্রহ ছিলো। আমার মাথার উপর বন্দুক থাকা সত্ত্বেও আমি তা ধরে দেখতে চেয়েছিলাম। আচ্ছা ৭ বছর বয়সে মৃত্যু জিনিস টা কে উপলব্ধি করতে পারে? বন্দুকের দিকে হাত বাড়ালাম। কে যেনো দৌড়ে এসে বাসায় ঢুকলো। আমার বাবা। তিনি বললো, “সাহাব, রুকিয়ে রুকিয়ে। ইয়ে হামারা বাচ্চা হে,অর ইয়ে হামারা বিবি।" মিলিটারি বললো,“ ইয়ে জয় বাংলা কিয়ুন বোলা?"বাবা বললো, “ইয়ে আভি বাচ্চা হে,বাডা হোতে হোতে সিখ জায়েগা।" মিলিটারি হেসে বললো,“ঠিক হে,সিখা দেনা। অর বিবি কো ভি সিখা দেনা। অর তুমহারি বিবি কো সামহালকার রাখনা।" “ঠিক হে", বাবা যেনো আকাশ থেকে পড়ে আবার দাড়িয়ে গেলো। “চলো বাবা, আমরা আর এখানে থাকবো না, চলো শান্তা ওরা আমাদের থাকার ব্যাবস্থা করে দিয়েছে,"এ বলে বাবা আমাদের নিয়ে বের হয়ে গেলো। বের হয়ে দেখি পুরো রাস্তা লাল রঙে রঞ্জিত। মিলিটারিরা পরিস্কারের কাজে ব্যাস্ত। যেতে যেতে মাকে বলছিলাম,“মা,আমাদের নতুন বাড়ির উঠান টা কি লাল রঙের হবে? আসার সময় লাল রাস্তা টা দেখেছো? অনেক সুন্দর না?" মা চুপ করে রইলো। মিলিটারিদের দেওয়া ঘরে আমরা খুবই ভালোই দিন কাটাচ্ছিলাম। আমরা আগে যে ঘরে থাকতাম তার চাইতেও ভালো। উঁচু দালানে টিন শেডের মতো যেমন বর্ষার পানি পরার সুযোগ নেই তেমনি শীতের কনকনে হাওয়ায় ও আমাদের গা স্পর্শ করতে পারে না। কিন্তু আমায় আঘাত করতো “রাজাকার"নামের শব্দটি। স্কুলে যাওয়ার পথে সবাই আঙুল তুলে দেখিয়ে দিতো রাজাকারের ছেলে বলে। বাড়ির উঠান ছাড়া কোনো জায়গায় এর রেহাই নেই।মার কাছে আমায় রাজাকারের ছেলে কেনো ডাকে যদি উত্তর চাইলে তিনি এড়িয়ে যেতেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ই ডিসেম্বর...... আমার বয়স তখন ৯। চারিদিকে লাল সবুজের পতাকা উড়ছিলো। “এবারের সংগ্রাম আমার মুক্তির সংগ্রাম,এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম.......জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু "। পুরো বাংলা সেদিন জয়জয়কার করছিলো। সেদিন আমায় কেউ আটকাতে চায়নি আর চাইলেও পারতো না। কোনো দ্বিধা ছাড়াই ছুটে চলে গেলাম। মাথায় একটা কাপড় বেধে দিলাম এক ঘোড়- দৌড়। “জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু" “জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু" বাকি শব্দগুলো আমার মুখে আসছিলো না। কিন্তু আমার শিড়ায় ঠিকি লাগছিলো। কিছুদুর যেতে না যেতেই আমার স্কুলের কিছু সহপাঠীদের দেখতে পেলাম। তাদের মিছিলে দেখে আমি আরো খুশি। কিন্তু তারা আমায় দেখে মোটেও খুশি ছিলো না। তারা আমায় মিছিল থেকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দিলো রাজাকারের ছেলে বলে। আমি যেতে না চাইলে তারা ছোট ছট ইট ছুড়ে মারা শুরু করে। আমার তখন বাবার প্রতি খুব ঘৃণা হচ্ছিলো। কাদঁতে কাদঁতে বাড়িতে গেলাম। আজ জবাব দিতেই হবে। কেনো ওরা এমন বলে আমায়! কি করেছে আমার বাবা! বাসায় গিয়ে দেখি মা মেঝেতে শুয়ে কাদছে। মায়ের কান্না দেখে আমি চোখমুখ মুছে ফেললাম। তাকে জিজ্ঞেস করলাম,“মা, কেনো কাদছো"? তিনি আমায় বুকে টেনে এনে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। “তোর বাবা আর নেই।" “নেই মানে? কি হয়েছে"? “মারা গেছেন, পাকিস্তানি মিলিটারিরা তাকে মেরে ফেলেছেন।" তখন আমি একটু একটু মৃত্যুর কষ্ট বুঝে উঠতে পেরেছিলাম। আমি মায়ের কোলে বসে ছিলাম। চোখ দিয়ে অল্প খানেক অশ্রু ঝরে পড়ছিলো। কিন্তু মায়ের চোখ টলটল করছিলো অশ্রুর ঢেউয়ে। একটু পর মাকে জিজ্ঞেস করলাম,“মা,সবাই কেনো বাবাকে রাজাকার বলে?" মা দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করে বলেন, “ স্বাধীনতা জিনিস টা সহজ নয় রে বাবা। একটা দেশের স্বাধীনতা আসে অনেক কষ্ট আর আত্নত্যাগের বিনিময়ে। আর আমার এই দেশের স্বাধীনতার মুল্য অনেক- অনেক বেশি। যা তোমার বাবা সর্বদা দিতে প্রস্তুত ছিলেন। আর এ যুদ্ধে নেমেছিলেন একমাত্র ব্যাক্তি হয়ে। যা তোমার-আমার মতো সাধারণ মানুষ কখনো ধারণা ই করতে পারে না।" আমি ভেবেছিলাম স্বাধীনতা মানে সুখ। স্বাধীনতা মানে মাথায় লাল সবুজের পতাকা বেধে জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু বলে দৌড়ে বেড়ানো আর চিৎকার করে আকাশ পাতাল উড়িয়ে দেওয়া। হয়তো সেদিন বাবাও দৌড়ে স্বাধীনতার পাহাড়ের চুড়ায় পৌছে গিয়েছিলেন। হয়তো আমার মতোই তাকে স্বাধীনতার মিছিল থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হয়েছিলো।