আমি স্বাধীনতা দেখেছি,,!

মিলাদ হোসেন সুজন

নামঃমিলাদ হোসেন সুজন। একাদশ শ্রেণি। কুলাউড়া সরকারি কলেজ, কুলাউড়া। গল্পের নামঃআমি স্বাধীনতা দেখেছি। গভীর রাত, ঝিঁ ঝিঁ পোকার সূরেলা ডাক, দূরে কোথাও শোনা যাচ্ছে কটা'খেক শেয়ালের ডাক, সবাই প্রকৃতির কোলে মাথা রেখে তন্দ্রায় লুটে পড়েছে। আদিলের চোখে ঘুম এসে ধরা দিচ্ছে না। একটি কথাই বার বার ভাবিয়ে তুলেছে আদিল কে! চারিদিকে খবর ছড়িয়েছে দেশে নাকি যুদ্ধ হবে। ঢাকায় শুরু হয়েছে মিছিলের পর মিছিল,, শুরু হয়েছে আন্দোলন। আদিল ভাবছে সত্যিই কি যুদ্ধ হবে ? যুদ্ধ হলে আমরা কি করব?কি করতে হবে আমাদের? ভাবতে ভাবতে এক সময় ভাবনা বিশাল ভাবনায় রুপ নিল । বাবা ঢাকায় একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন ওখানেই থাকেন। ৫-৬ মাসে এক- দু বার বাড়িতে আসেন। যদি যুদ্ধ শুরু হয় আমি কি করে মা, ছোট বোন,, কে নিয়ে একা বাড়িতে থাকবো? ভাবতে ভাবতে রাতের শেষ প্রহরে ঘুমিয়ে পড়ে ১৪ বৎসরের আদিল।, হঠাৎ তার কর্নকোহরে এসে ধাক্কা খেলো ,,, মুয়াজ্জিন এর মধুর সুরের,, আসসালাতু খাইরুমমিনান নাউম,,,ধ্বনি টি,,। আবার দেখা হবে বলে ঘুম তার দখলকৃত চোখের পাতা ছেড়ে পালিয়ে গেল। চোখ থেকে ঘুমের বোঝা সরে যেতেই খুলে গেল তা। চোখের অনুসরনে মুখ ও খুলে দিল তার বন্ধ কপাট,,,বেরোলো আলহামদুলিল্লা হিললাজিআহয়ানা,,,,,,,,,,,,।বাড়ির পাশাপাশি ই মসজিদ,, আদিল তাড়াতাড়ি পাঞ্জাবি হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো মসজিদের দিকে ,, মসজিদের পুকুরে অযু সেরে খোলা আকাঁশের দিকে তাকিয়ে,শাহাদা বাক্য পাঠ করে মসজিদে ঢুকে গেল,,,। নামাজ শেষে,, ইমাম সাহেব এলান দিলেন,সবাই যেন দেশের জন্য দোয়া করে। যে কোনো সময় যুদ্ধ শুরু হতে পারে। সবাইকে প্রস্তুতির কথা ও জানালেন ইমাম সাহেব,,। নামাজ শেষে বরাবরের মতো আদিল,, তার দাদা- দাদির কবর জিয়ারত করলো।, বাড়িতে এসে বাবাকে নিয়ে কথা হলো,, মা রেহানা পারভিন,, বলেলেন ওসব তুই চিন্তা করিস না,, কালকেই ইয়াকুব ভাইয়ের সাথে দেখা হয়েছিলো উনি বলেছেন যুদ্ধ শুরু হলে তারা দুজনই একসাথে বাড়িতে ফিরে আসবেন,, ইয়াকুব ভাই আজ আবার চলে যাচ্ছেন ঢাকায়।,, আদিলের মন কিছুটা শান্ত হলো,,। কয়েকদিন আগে আদিল আর তার বন্ধুরা মিলে রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর ভাষন শুনেছিলো । আস্তে আস্তে যুদ্ধের ঘন্টা বেজে উঠছে ,,। চারিদিকে শুরু হয়ে যায় গোলযোগ,,, বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দেন যে স্কুল, কলেজ,সব ধরনের সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়ার জন্য। যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকতে,,। এর মধ্যে কয়েকদিন চলে গেল। আজকেই আদিলের বাবা আসার কথা,, সবাই অপেক্ষায় অপেক্ষমান,বিশেষ করে আদিলের ছোট বোন, নতুন কথা বলা শিখেছে,, আব্বু আব্বু বলে ডাক পাড়ছে ।কিন্তু সেই অপেক্ষার অবসান হলো না। আদিলের বাবা আজও আসেন নি। কয়েকদিন ধরে তারা অপেক্ষায় আর ভয়ে দিন কাটাচ্ছে,।যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে,,। মিলিটারিরা সকল স্কুল, কলেজ তাদের ক্যাম্প হিসাবে ব্যবহার করছে। গ্রামের লোকেরা সবাই গ্রাম থেকে চলে যাচ্ছে অন্য কোথাও ।, মিলিটারিরা গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে,, সামনের সাপ্তাহে নাকি পাশের গ্রামে আক্রমণ করবে। ঐদিকে মুক্তিবাহীনিরা ইন্ডিয়া থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছে । মিলিটারিরা যার ঘরে সুন্দর যুবতি পাচ্ছে তাকেই ধরে নিয়ে ধর্ষন করছে।, আদিল, মিমি তাদের বাবার জন্য এখনো অপেক্ষমান।, গ্রামের লোকেরা আদিলের মাকে বলছে,, আর তার জন্য অপেক্ষা করে লাভ নাই। হয়তো মিলিটারীরা মেরে টেরে ফেলে দিয়েছে। কিন্তু আদিলের মা তা বিশ্বাস করতে রাজি নয়। তার পুরো বিশ্বাস আছে যে তার স্বামী ফিরে আসবেই,,। অন্ধকার রাত, মিমি ঘুমিয়ে পড়েছে,, টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছে,,,, আদিল আর তার মায়ের চোখে ঘুম নেই এখনো ভাবনায় কখন ফিরবে প্রান প্রিয় স্বামী, তার সাথে ভয় কখন জানি মিলিটারী এসে যায়। হঠাৎ দরজায় টুক!টুক!, শব্দ হলো,, আদিল খুব ভয় পাচ্ছে । আদিলের মা আদিলকে বললেন তুই মিমিকে কোলে তুলে নে আমি দরজা খুলছি,,। বলে মহান রাব্বুল আলামিন এর কাছে হাত তুললেন,,, আর মনে মনে দরুদ পাঠ করে, চুপিচুপি গিয়ে দরজার কড়া খুলতেই তাড়াতাড়ি রাইফেল হাতে দুজন লোক ঘরে প্রবেশ করলো,, একজন কালো রেইনকোট পরেছে। আরেকজনের মাথায় হেলমেট,। আদিল চিৎকার করার আগে আগে তার মায়ের বুঝতে বাকি রইলো না যে রেইনকোট পরা পুরুষটি আর কেহ নয় তার প্রান প্রিয় স্বামীই। আর হেলমেট পরা লোকটি আর কেহ নয়, ইয়াকুবই। স্বামী ঘরে ঢুকেই স্ত্রী কে জড়িয়ে ধরলেন। ঐদিকে মিমিরও ঘুম ভেঙ্গে গেছে। আদিলও বুঝতে বাকি রইলো না যে,, উনি তার বাবা। আদিল পেছন থেকে এসে জড়িয়ে ধরলো বাবাকে,, বাবা মা ছেলে তিনজনই কাঁধছে,, ঐদিকে এমন মায়াময়ী দৃশ্য মিমি খুব সুন্দর করে দেখছে, তার সাতে ইয়াকুব ও । বাবা তারপর গিয়ে জড়িয়ে ধরলো তার মেয়ে মিমিকে কপালে, গালে, মুখে মায়া ঝেড়ে দিলো। মিমি ও আব্বু আব্বু ডাক শুরু করলো,,। আদিলের বাবা জয়নাল সাহেব বললেন ঘরে কিছু থাকলে আমাদের খেতে দাও খুব খিদে পেয়েছে। আদিলের মা, পারভিন তাড়াতাড়ি খাবার রেড়ি করলেন, ,, এখন মিমি, তাদের হাতের রাইফেল গুলাদিয়ে খেলা করছে,,, আদিল ও বোনের সাথে খেলা করছে,,। আদিলের মা ভাত বেড়ে দিচ্ছেন আর বলছেন ইয়াকুব ভাই তো সেদিন বলেছিলেন যে, যুদ্ধ শুরু হলে আপনারা বাড়িতে চলে আসবেন। আসলেন না কেন?? ইয়াকুব আলী বললেন কি করে আসবো বলো?আমার দেশের এমন বিপদে যদি জন্মভূমির পাশে না তাকি তবে নিজেকে মানুষ ভাবতে কষ্ট হবে,। কি আর করবো দেশের মায়ায় মাটির মায়ায়,, রাইফেল হাতে নিতেই হলো,,।হাত গুটিয়ে বসে থাকতে,,নিজেকে পশুর মতো লাগবে ভেবেই পারি নি। দেশ স্বাধীনএর জন্য হাতে তুলে নিয়েছি রাইফেল,,।জয়নাল সাহেব বললেন এখন গল্প করার সময় নয় তাড়াতাড়ি খেয়ে নিন । তাড়াহুড়া করে খাওয়া শেষ হলো।। জয়নাল সাহেব দুহাত তুলে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া জানালেন। বললেন এতো দিনে বিবির হাতের রান্না তৃপ্তি করে খেলাম। আল্লাহ জানেন আর কবে খাওয়া হবে।। আদিল উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করলো বাবা,,, বাবা,আর কতদিন যুদ্ধ করবেন ? যুদ্ধ কি আর শেষ হবে না? উনি বললেন আমরা শেষের দিকে চলে এসেছি বাবা,।হয়তো আর কিছুদিন চলবে,, আর কিছু দিন পরেই স্বাধীনতার পতাকা উড়বে ইনশাআল্লাহ। , আদিল তা শুনে বেশ খুশি হলো,, মুচকি মুচকি হাসতে থাকলো,,। আদিল বললো বাবা তোমাদের কি আবারো যেতে হবে যুদ্ধে ,?? উনি বললেন হ্যাঁ বাবা যেতে হবে। তবে খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসবো। নয়তো আর আসবো না! এ কথা শুনে আদিলের মা খুব ভয় পেলেন,, বললেন এমন কথা বলো না গো,, আল্লাহ আমাদের রক্ষা করবেন,,। এই বলে তারা বিদায় নিতে লাগলো। তখনই, দরজায় আবার টুক!টুক! শব্দ,, আদিলের বাবা, জয়নাল , আর ইয়াকুব তাড়াতাড়ি রাইফেল হাতে নিল । আদিলের মা ভয়ে ভয়ে বললেন কে,,? বাইরে থেকে কেউ একজন বয়স্ক কন্ঠে বলে উঠলো আমি বলছি গো। মা,,দরজাটা খুলো দেখিনি। বড় বিপদে পড়ে আসছি মা! আদিলের বাবা ইশারা করলো দরজাটা খুলে দাও। হয়তো মুক্তি বাহিনী হবে। আদিলের মা দরজা খোলার সাথে সাথে বৃষ্টির মতো গুলি পড়তে লাগলো ঘরের ভেতরে। আদিলের বাবারও গুলি করছে,।,সংঘর্ষ এক সময় থেমে গেল তবে রক্তের বন্যা বইছে,,। আদিল ভয় পেয়ে মিমিকে নিয়ে খাটের নিছে লুকিয়ে পড়ে। কিন্তু যখন বের হলো দেখলো তার মা- বাবার সাথে ইয়াকুব চাচাও মাটিতে পড়ে আছে। মা, আর ইয়াকুব চাচা দুজনেই বেছে নেই। শুধু তার বাবা চিৎকার করে বলছেন,, বাবা তুই আমার মেয়েকে দেখে রাখিস বাবা,,।আদিলের বাবা কে কেমন জানি দেখাচ্ছে,, চোখ দুটো অনেক বড় বড় অনেক লাল হয়ে আছে,,। আদিল মিমিকে তার বাবার পাশে নিয়ে এলো,, বাবা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বললেন বাবা আমার মেয়েকে তুই দেখে রাখিস বাবা, আমরা স্বাধীনতা দেখিনি তো কি হয়েছে? তোরা তো দেখবি,,,,বাবা,, তোরা তো দেখবি! তার পর নিজের মুখেই পড়তে লাগলেন কালিমা। জয় বাংলা বলে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন। আদিল চিৎকার করতে লাগলো হে আল্লাহ,, রাব্বুল আলামিন একি হলো আমাদের সাথে,, হে মাবুদ,,,তুমি আমাদের সাথে এরকম করতে পারো না,,, এরকম করতে পারো না,,,,, আল্লাহ,,,,বলে কাঁদতে লাগলো,,,,। ঘরের দরজায় যে কড়া নাড়ছিলো তারও লাশ পড়ে আছে দরজার বাইরে,,। তার সাথে তিন জন মিলিটারিরও লাশ পড়ে আছে,, বাকিরা সব চলে গেছে। যে দরজায় কড়া নাড়ছিলো সে ছিলো তাদেরই প্রতিবেশী গোপাল মিত্র । সে রাজাকারের খাতায় নাম লিখিয়েছে। আদিল তাকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগলো হে জানোয়ার তুই এই দেশের একজন মানুষ হয়ে কিভাবে দেশের সাথে বেইমানি করতে পারলে। কিভাবে দেশের মাটির সাথে বেইমানী করতে পারলে,,, ,,,,বলে ঐ লাশের উপর লাথি মারতে লাগলো। মিমিকে জড়িয়ে ধরে আদিল কাঁদতে লাগলো,,, এমন সময়,,, মুক্তি বাহিনীরা এসে আদিল ও মিমিকে নিয়ে গেল সুরক্ষাগারে,, দুই দিন চলে যাবার পর শুনা গেল দেশ নাকি স্বাধীন হয়েছে,,, বাংলার আকাঁশে লাল সবুজের পতাকা উড়ছে,,,, পাখিরা মুক্ত আকাঁশে উড়াউড়ি করছে। দেশ স্বাধীন হয়েছে খবরটি শুনে আদিল আকাঁশের দিকে থাকিয়ে চিৎকার করে বলতে লাগলো,,, আমরা স্বাধীনতা দেখেছি আমরা স্বাধীন হয়েছি ,,বাবা,, আমরা স্বাধীনতা দেখেছি,,,,। (আমি স্বাধীনতা দেখেছি,,,,,,,)।