মো. শামীম হোসেন
"Human beings are restrained by chain; some of them can break it, some cannot." মানুষের সহজাত প্রবণতায় যখন অদম্য ইচ্ছাশক্তি ধরা দেয় তখনই কেবল সকল শৃঙ্খল, অশুভ শক্তি এবং আত্মশক্তির বিরুদ্ধবাদকে পরাজিত করা সম্ভব। কেউ কেউ পেরে ওঠে না জীবনের নানাবিধ প্রতিকূলতার সাথে; আবার কেউ কেউ প্রবল ইচ্ছাশক্তিতে বলিয়ান হয়ে জয় করে সকল প্রতিবন্ধকতা, হয় বরেণ্য এবং অনুকরণীয়। আমার জীবনের গল্পটা অতটা সাফল্যমণ্ডিত জয়ের উপাখ্যানে সমাদৃত নয়; তবুও গল্পটা জীবনের প্রথম স্বপ্ন জয়ের দৃশ্যপটে রচিত বিধায় বার বার উঁকি দেয় মনের ছোট্ট এক খুপরিতে। "বিজয়ের মাসে" তাই নিজের ছোট্ট এ জয়টা ফুটিয়ে তোলার অনুর্বর চেষ্টা। সময়টা ২০১৮ সালের মে মাস। আমি তখন দ্বাদশ শ্রেণিতে অধ্যয়নরত। নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান হিসেবে যেভাবে দিনাতিপাত করা সমীচীন ছিল ঠিক সেভাবেই সবকিছু পরিচালনার চেষ্টা করতাম। পরিবারে অভাব থাকলেও না খেয়ে কোনোদিন থাকতে হয়নি। বাবা ছিলেন (এখনও আছেন) একজন গার্ড বা প্রহরী। তার মাসোহারায় আমাদের চলে যেত মোটামুটি। বাবার বয়স বাড়লেও পাঁচ সদস্যের পরিবার সাথে আমার পড়াশোনার খরচ টেনে নিতে হতো অক্লান্ত পরিশ্রমে। আমাদের মুখের দিকে চেয়ে সব কষ্ট ভুলে যেতেন এবং এখনও ঠিক তাই করে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। সমাজের নির্মম কুঠারাঘাতে বহুবার বিশ্বস্ততায় প্রতারিত হয়েছেন; তবুও দমে যাননি, সৎ পথের সারথি হয়ে অন্যায়কে রুখেছেন; শিক্ষা দিয়েছেন সততার, নিষ্ঠার এবং মানবিক মূল্যবোধের। তিনিই আমার চূড়ান্ত আদর্শ এবং মহানায়ক। আসল কথায় ফিরি। এভাবে বিস্তারিত লিখতে গেলে উপন্যাস হয়ে যাবে হয়তো। ক্ষুদ্র জয়টাকে ক্ষুদ্র রচনায়ই লেখার চেষ্টা করি। সময়টা ২০১৮ সালের মে মাস। এক বিকেলে কলেজ থেকে ক্লাস করে বাসায় ফিরছিলাম। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই কেমন যেন মনে হতে লাগলো মানুষ আমার দিকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখছে। বিপদ যে একটা ঘটেছে তার কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলাম। ক্লান্ত দেহ আর ম্লান মন নিয়ে যখন বাড়িতে পা বাড়ালাম তখনই শোরগোল আর বিকট কান্নার শব্দ শুনতে পেলাম। আমাদের বাড়ির উঠোনটা তখন মানুষের সমাগমে টইটম্বুর। কাছাকাছি গিয়ে দেখলাম বোনেরা কান্নাকাটি করছে। কান্না বিজড়িত কণ্ঠে ছোট আপুকে জিজ্ঞেস করলাম, "কী হয়েছে, আপু?" উত্তরে ছোট আপু তখন যা বলল এখনও তা মনে পড়লে আমার পুরো ঘটনাটা মিথ্যে মনে হয়। আপু কাঁদতে কাঁদতে বলল, "শাওন রে (আমার ডাকনাম) আমাদের সবকিছু শেষ রে শাওন! আল্লাহ এ কি বিপদে ফেললো রে শাওন! মা তো আমাদের পথে বসিয়ে দিল রে শাওন! উনি (মা) ঋণ করতে করতে এখন তা প্রায় দশ লাখ টাকার সমান হয়ে গেছে রে ভাই! কী করবো এখন? আল্লাহ রে, ও আল্লাহ এরকম বিপদ কেন দেখাইলি রে, আল্লাহ…!" অর্থাৎ আমার মা ঋণ করতে করতে সুদে-আসলে এখন সেই ঋণের পরিমাণ প্রায় দশ লক্ষ টাকা! শুনে মনে হলো আমার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেছে। কী করবো বুঝতে পারছিলাম না, শুধু চোখেমুখে বিপদের ঘনঘটার ছাপ ফুলেফেঁপে উঠছিল! বাবা যেখানে সামান্য বেতনের একজন প্রহরী; তার টাকায় যেখানে আমাদের সংসারই ঠিকভাবে চলছিল না সেখানে দশ লক্ষ টাকা আমাদের কাছে চাঁদ হাতে পাওয়ার সমতুল্য বিপরীতে সেই টাকার ঋণ পরিশোধ করা ছিল নরকতুল্য এবং কল্পনারও কোটি কোটি গুণ বাইরে! জায়গা-জমি কিছুই ছিল না যে তা বিক্রি করে ঋণ শোধ করবো। বাবা এটা শুনে রীতিমতো অজ্ঞান হওয়ার যোগাড়! তিনি হতবাক এবং নিস্তব্ধ! পরিবারের সবারই প্রায় তখন একই অবস্থা! অভাব থাকলেও সমাজে আমাদের সম্মানের জায়গাটা ছিল সবার উপরে। কিন্তু এখন তার কী হবে? আর কীভাবেই বা এত ঋণ পরিশোধ হবে? অন্যদিকে চারদিকে মানুষের কটূক্তি শুরু হয়ে গেছে। পাওনাদাররা দল বেঁধে আসতে শুরু করেছে। তখন কেবলই মনে হতে লাগলো মাঝ সমুদ্রে একটি তলায় ছিদ্র বিশিষ্ট ডিঙি নৌকায় আমিসহ আমার পুরো পরিবার ডুবে যাওয়ার অন্তিম মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছি! পাওনাদাররা আসতেই থাকলো। তাদেরকে বুঝ দেওয়ার আর কিছুই অবশিষ্ট রইলো না। ঘর থেকে বের হতেও মন সায় দিত না। পথে বেরুলেই মানুষের হরেক রকম কথা শুনতে হতো। উপায় না পেয়ে আসবাবপত্রস ঘর বিক্রি করে দেওয়া হলো! দাদার আমলে যে একটু জমি ছিল তা বিক্রি করে দেওয়া হলো। সব বিক্রি শেষ কিন্তু ঋণের দশ ভাগের এক ভাগও হলো না! আর কোনো উপায় না পেয়ে বাবা বাড়ির কয়েকজন মুরুব্বিসহ পাওনাদারদের নিয়ে বসলেন। সময় নিলেন তিনি প্রত্যেকের টাকা ধীরে ধীরে পরিশোধ করে দিবেন। অনেক কথাই রয়ে গেছে, তবে একটা কথা না বললেই নয়- আমাদের এই মহাবিপদ কিংবা ঋণটা ছিল গ্রামের কিছু মানুষের লোভের ফসল। অর্থাৎ তাদের লোভ আমাদের বোঝা! আমরা হয়ে গেলাম ঘরছাড়া। বিশেষ করে আমি হয়ে গেলাম নীর হারা পাখির মতো। যাওয়ার কোনো জায়গা ছিল না। আপন আত্মীয়, দূর আত্মীয় সবাই কেমন যেন পর হয়ে গিয়েছিল! কথায় আছে, "বিপদে পড়লে আপনজনও পর হয়ে যায়!" এটা তখন নিতান্ত সত্য বলে প্রমাণিত হলো। এবার একটু কয়েক বছর আগে ফিরি না হলে "জয়" শব্দটা আমার সাথে কীভাবে জড়িয়ে ছিল সেটা অনুধাবন করতে কষ্ট হবে। দশম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত অবস্থায় প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত "ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে" পড়ার তীব্র বাসনা এবং স্বপ্ন ছিল। কীভাবে এই স্বপ্নটা পূরণ হবে জানতাম না তবে ইচ্ছাশক্তি ছিল যে যত কষ্ট কিংবা ত্যাগের বিনিময়েই হোক আমাকে "ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে" চান্স পেতেই হবে। আমি কল্পনায় হেঁটে বেড়াতাম এই ইতিহাস-ঐতিহ্য সমৃদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি রাস্তায়, প্রতিটি কোণায়। মনন জগতে নিজেকে "ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের" একজন ছাত্র হিসেবে পরিচয় দিতে আনন্দ পেতাম। মনীষীরা বলতেন, স্বপ্ন ছাড়া মানুষ নাকি তার উদ্দেশ্য সাধন করতে পারে না। তাই, আমিও দেখতাম এবং প্রথম স্বপ্ন জয়ের কষ্টের জন্য প্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু হঠাৎ আসা হড়কা বাণ সবকিছু দুমড়ে-মুচড়ে দিলো! সব স্বপ্ন মনে হলো সুনামির ঢেউ ভাসিয়ে নিয়ে গেলো। যেখানে থাকার জায়গাই নেই সেখানে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া এবং "ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে" পড়া বিলাসিতা ছাড়া আর কিছুই নয়। কয়েকবার আত্মহত্যার কথা যে মাথায় আসেনি তা নয়, কিন্তু বার বার জীবনের কাছে হেরে যেতাম; হেরে যেতাম স্বপ্নের কাছে। বাবাকে বললাম, "বাবা, এখন তো আর পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব না, দেখ আমার জন্য ছোটখাটো একটা কাজ যোগাড় করতে পারো কিনা।" বাবা রাগান্বিত হয়ে বলল, "আমি মরে গেলেও তুই পড়াশোনা ছাড়বি না। তুই শুধু তোর ক্যারিয়ার নিয়ে ভাব।" আর কী চাই, এটাই তো প্রকৃত অনুপ্রেরণা। কিন্তু থাকবো কোথায়? এই চিন্তাটাও মাথা থেকে সরিয়ে দিল এক বন্ধু। তার কাছে থেকে নিজের পড়াশোনাটা চালিয়ে যেতে থাকলাম যদিও নিজের পড়াশোনার সময় খুব কমই পেতাম। যাইহোক, জীবনই যার কষ্টের তার কাছে কষ্টেরা সব তো জড়ো হবেই। এইচএসসি পরীক্ষা দিলাম ২০১৯ এ এবং জিপিএ - ৫.০০ সহ আমার উপজেলায় আমার বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করলাম। এর তিনমাস পর "ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের" ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলো। যতটুকু প্রস্তুতি নিয়েছিলাম ঐ প্রস্তুতি দিয়েই পরীক্ষায় অংশ নিলাম এবং আল্লাহ তায়ালার অশেষ মহিমায় খুব ভালো পজিশন পেয়ে আমার পছন্দের বিষয়ে (ইংরেজি) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেলাম। শুধু তাই নয়, আরও পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে সবগুলোতেই প্রথম সারিতে অবস্থান রাখতে সক্ষম হয়েছিলাম। লক্ষ্য ছিল "ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়" তাই এখন সেখানেই আছি সাথে আছে জীবন সংগ্রাম এবং নিজেকে নিজের মতো করে জয়ের আকুলতা। গল্পটি যখন লিখছি তখন আমি "ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের" কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে। জীবন চলছে, আমরণ চলতেই থাকবে। ঋণের বোঝাটাও বয়ে নিতে হচ্ছে, হবে শেষ না হওয়া পর্যন্ত। আল্লাহ বিপদ তাকেই দেন যে সহ্য করতে পারে - হয়তো আল্লাহ সেই পরীক্ষাটাই করছেন। এ স্বপ্ন জয়টা অনেক ক্ষুদ্র হতে পারে কিন্তু আমার কাছে এ জয়টা সাগর সমতুল্য। কেননা, এ জয়টা ছিল আমার নিজের বিরুদ্ধে নিজের। অবশেষে প্রথম স্বপ্ন জয় করতে পেরেছি তাই আপাতত বহু কষ্টের মাঝে সেটাই কিছুটা তৃপ্তি, কিছুটা প্রেরণা। তিন বছরের সংগ্রামটাকে এক ঘণ্টায় ফুটিয়ে তোলা সম্ভব না, তাই পারিনি। বিজয়ের মাসে সকল স্বপ্নসারথী পাক বিজয়ের দেখা সেই কামনা রইলো। "Everyone is controlled by others, until he/she cannot control himself/herself and be the ruler of his/her own Kingdom."