ছুটির ঘণ্টা

খায়রুল আলম রাজু

পুকুরের ছোট ছোট ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে আছে আবির। মনে মনে ভাবছে, ক্ষুদ্র আয়ুর জীবনে কত না দুখের ঢেউ বয়ে গেছে মনের নদীতে। দাঁড়িয়ে থাকা আবির বসে পড়ল পুকুর পাড়ের সবুজ ঘাসে। জীবনের হিসেবের খাতাটা খুলে আবির বুঝতে পারল, জীবন ছোট হলেও অনেকটাই বড় আর বিচিত্র । পৃথিবীতে মণিখালা ছাড়া কেউ ছিল না তার। কোথাও নেইও কেউ। অসুখের তাড়না ছাড়াই একদিন সেও চলে গেল। অচিন কোনো এক নাম না জানা তারার দেশে। শেষবারের মত মণিখালার একটা কথাই তার কানে বাজে, একদিন আমিও আসব। সবাই হাসবে, তুইও হাসবি। আনন্দ-খুশির সেই উৎসবে বেদনাদের ছুটি হবে। ছুটি হবে সকল হাহাকার আর ধোঁয়া উড়া অগ্নির। আবিরের মতে পৃথিবীতে এই বাক্যের শব্দে শব্দে মিশে আছে মমতা আর ত্যাগের মহিমা। মা ও একদিন আবিরকে ফেলে এভাবেই চলে যান দূরের রাজ্যে। আবিরের মা বড় একটা অসুখে পরে ছিলেন । মীর পাড়ার বড় কবিরাজ দেখিয়েও রোগটার নিঃশেষ হয়নি। টাকা-পয়সার অভাবে ঠিকমত ঔষধও কিনতে পারেনি আবির। যেখানে তারা কোনো কোনো দিন পেট ভরে খেতেই পায়নি, সেখানে ঔষধ কেনা বিলাশীতাই বটে। একদিন খোদার মানত হিসেবে সর্দার বাড়ির বড় বউ আবিরের মা রাহেলাকে একটি মুরগি দিলেন। লাল মুরগি। রাহেলা মুরগিটি নিয়ে ধীর পায়ে হাঁটছেন আর ভাবছেন, মুরগিটি রান্না করে ছেলেটাকে দুপুরে পেট ভরে খেতে দিবেন। অসুস্থ শরীরে হাঁটার ফলে রাহেলা বানুর অসুখটা তীব্র মাত্রায় বেড়ে উঠে। ঘরে ঔষধও নেই। রোদে ঘেমে আসা রাহেলার মলিন মুখের ঘাম মুছে দেয় আবির। ছেলের নরম হাতের পরশে ঘামের সাথে চোখের জল মিশে একাকার। ছোট এতটুকুন ছেলে পরম যত্নে রাহেলাকে খাটে শুইয়ে দিল। মায়ের অসুখের কষ্ট তার সহ্য হয় না। তারও ইচ্চে হয় মায়ের মত শব্দ করে লুকিয়ে কান্না করতে। কিন্তু আবির তা পারে না। ছেলেটা বোবা বলে কান্নাও আসে না তার। চোখ থেকে শুধু শীতল জলের নদী বয়ে যায়। মনে দুঃখ আর মায়ের হাসি দেখার সুখে গ্রামের হাটে বেচে দিল, ঔষধ কেনার জন্য সর্দার বাড়ির বড় বউয়ের দেওয়া লাল মুরগিটি। ঔষধের পুঁটলি হাতে ফিরে এসে দেখল, ঘরে অনেক লোকের ভীড়ে খাটের উপর চাদরে ঢাকা মায়ের শীতল দেহ। আকাশ সমান এত দুঃখ পেয়েও আবির কান্না করতে পারছিল না। তবে তার চোখ থেকে ঝর্ণার মত ঝরছিল জলরাশি! সেই থেকে ছোটবেলায় বাবা না থাকায় পৃথিবীতে মণিখালাই ছিল তার সবকিছু। ভাবতে ভাবতে হাতের কাছে থাকা ছোট ছোট পাথরের টুকরো একে একে পুকুরে ফেলে আবির। সেই পাথরের টুকরোরা পুকুরে কৃত্রিম ঢেউ সৃষ্টি করে। একটা ঢেউ শেষ হতেই পাথরের আঘাতে জলে নতুন ঢেউ খেলে যায়। আবিরের জীবনেও গতরাতে নির্দয় এক ঢেউ বয়ে গেছে। ভাবতেই তার ছোট দেহের ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে ওঠে। চোখের পাতায় ভেসে উঠে মণিখালার রূপবতী রাজকন্যার মত মায়াবী চেহারার ছবি। সেই রাতে কালো প্লাজুর সাথে সাদা কামিজে মণিখালাকে দারুণ সুন্দর লাগছিল। হিন্দি ছবির নায়িকা রাণী মূখার্জীর মত। ঘুমুতে যাবে ঠিক তখন দরজায় কড়া নাড়ে কেউ। ভয়ে আর আতঙ্কে ক্ষীণ গলায় মণিখালা কে বলতেই ওপাশ থেকে উত্তর আসে, আমি হান্নান ফকির। দরজাটা খুলো। মণিখালা ছোট শিশুর মত থেমে থেমে বললেন, এত রাতে দরজা খুলা যাবে না। দেশের অবস্থা থমথমে। দেশ জুড়ে স্বাধীনতার যুদ্ধ। কাঁপাকণ্ঠে হান্নান ফকির সাহায্য চেয়ে বলল, আমার এখন অনেক বিপদ। কিছু মিলিটারি আমার পিছু নিয়েছে। আমাকে সাহায্য কর। আমাকে বাচাঁও। মণিখালা দরজা খুলে সরে আসতেই ঘরে ঢুকে হান্নান ফকির সহ দু দু-জন পাকিস্তানি মিলিটারি। ষোল বছরের সাদা পরীর মত সুন্দর মণিখালা ভয়ে আঁতকে উঠেন। ছোট আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদো কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, আমাদের মের না। আমাদের বাঁচতে দাও। রাগে আর ক্ষোভে হান্নান ফকির মণিখালার থেকে আমাকে টেনে আলাদা করে নেয়। আর সেই দুজন মিলিটারি একে একে ঝাঁপিয়ে পরে মণিখালার সুন্দর দেহের উপরে। আবির শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে হান্নান ফকিরের হাত থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করেও পারল না। ততক্ষণে মণিখালার চিৎকার আর অদ্ভুত রকমের কত শত আকুতি মাখা গলার স্বরও থেমে গেছে। মণিখালার সেই সুন্দর রূপবতী চেহারায় আর শরীরে নোখের আছড়। পুরো শরীর রক্তাক্ত আর অচেনা। দৈত্যদের সেই ক্ষুরধার আক্রমণ থেকে আবির বেঁচে গেলেও চিরদিনের মত মণিখালাকে সে হারিয়ে ফেলল... সেই রাতে ভরা জোছনা থাকলেও আবিরের চোখে তা কেবলই ঘন কুয়াশায় ঢাকা। রাতের বিচিত্র সেই স্মৃতির পাতা পড়তে পড়তে হাতের কাছে থাকা নড়ি পাথুরগুলি ফুরিয়ে এসেছে। আবির উঠে দাঁড়াল আর কমরে গুঁজে রাখা পুরনো ছুরিটা দেখল। ধারাল ধবধবে সাধা ছুরিটা সে হান্নান ফকিরের বুকে বিঁধে তাকে মেরে ফেলবে। ছুরি হাতে ধীর পায়ে আবির হেঁটে যায় হান্নান ফকিরের বাড়ির পথে। বড় রাস্তার মোড় পেরিয়ে হান্নান ফকিরের বাড়িতে এসে আবির দেখল, সে বাড়ি থেকে বের হবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বউকে বিদায় বলে মাঝরাস্তায় আসতেই আবিরের ধারাল ছুরির আঘাতে মাটিতে শুইয়ে পড়ে হান্নান ফকিরের বিশাল দেহ। জল থেকে ডাঙায় আনা মাছের মত অল্প সময়ে দেহ থেকে প্রাণটা চলে যায় হান্নান ফকিরের। তখন গাঢ় নীল আকাশ কালো হয়ে মাটিতে পড়ছিল বৃষ্টির জল। আবিরের চোখের পাতায় ভেসে উঠে রাতের বিচিত্র সেই স্মৃতি, চোখে তার বর্ষার জল আর মনে পড়ল— এই বুঝি বেদনাদের ছুটির ঘণ্টায় আনন্দ-খুশির উৎসবে মণিখালাও এসেছে।