মেহেদী হাসান
ডিসেম্বর মাস। বার্ষিক পরীক্ষা শেষ। তাই মায়ের সাথে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যাবে সানম। সানমের মামার বাড়ি হবিগঞ্জ জেলার জলসুখা গ্রামে। যদিও সানম ছোটবেলা থেকেই সিলেটে থাকে কিন্তু সুযোগ পেলেই গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে চলে যায়। সানমের গ্রামের বাড়ির প্রতি এত টান এই কারণে যে, সেখানে তার দাদু থাকে। দাদুর প্রতি সানমের অনেক ভালোবাসা। এর একটা বিশেষ কারণও আছে। সানমের দাদু একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তাই দাদুর কাছে বাংলাদেশের ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধের অনেক গল্প শোনার জন্য সানম একেবারে পাগল হয়ে যায়। সে অপেক্ষা করে থাকে কখন স্কুল বন্ধ হবে আর দাদুর কাছে চলে যাবে। সেই অপেক্ষার প্রহর শেষে ডিসেম্বর এলো। তাই সানম তার মাকে নিয়ে পাড়ি দেয় গ্রামের দিকে। রাস্তায় মায়ের সাথে অনেক গল্প করে সানম। দাদুর সাথে মজা করব, গল্প শুনব, যুদ্ধের কথা শুনব। অবশেষে দাদুর বাড়ি এসে পৌঁছে সানম ও তার মা। বাড়ির উঠোনে পৌঁছেই সানম দৌড়ে দাদুর ঘরের দিকে যায়। কিন্তু ঘরে কেউ ছিল না। সানম নিরাশ হয়। মন খারাপ করে আবার মায়ের কাছে ফিরে আসে। দাদি সানমের মুখ এমন শুকনো দেখে প্রশ্ন করে, ‘কী হয়েছে দাদুভাই? মন খারাপ কেন? দাদুভাইকে ঘরে পাওনি? উনি তো বাজারে গেছেন। তোমরা আসবে জেনে উনি নিজে গেছেন বাজারে চিংড়ি আনতে। তোমার না চিংড়ি খুব পছন্দ?’ সানম মাথা নাড়িয়ে সায় জানায়। মন খারাপ করে ঘরে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর দাদু চলে আসেন। সানম দৌড়ে দাদুর কাছে যায়। দাদু ব্যাগ রেখেই সানমের হাত ধরে চলে যান তার কক্ষে। সানমের প্রতি দাদুরও ভালোবাসা অনেক। তিনিও সানমকে খুব আদর করেন। দাদু বসে পড়েন তার বেতের তৈরি পুরনো চেয়ারে। আর পাশের চেয়ারে বসে সানম বলে, ‘দাদু আজ কী গল্প শোনাবে বলো।’ দাদু বলে, ‘দাদুভাই তোকে গল্প শোনাতে আমার খুব ভালো লাগে। শোন, আজ তোকে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনাব। এ অবশ্য গল্প নয়, বাঙালির এক সোনালি ইতিহাস। সেই ইতিহাস যা পৃথিবীর বুকে নতুন একটি ভূখণ্ডের জন্ম দেয়। তোকে তো আগেই বলেছিলাম ১৯৫২ সালের সেই আন্দোলনের কথা?’ ‘হুম দাদু। ভাষা আন্দোলনের কথা বলেছিলে একদিন। পৃথিবীতে আমরাই একমাত্র জাতি যারা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে। মায়ের ভাষার জন্য বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছে। সেই গল্প আমাকে অনেক অনুপ্রেরণা দিয়েছে দাদু।’ দাদু বলেন, ‘হ্যাঁ দাদুভাই। সেই আন্দোলনের পর থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালিদের ওপর আরও অত্যাচার আর নির্যাতন চালাতে থাকে। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা দাবি পেশ করেন। পরবর্তীতে পাকিস্তান সরকার ১৯৬৮ সালে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে। শুরু হয় ছাত্র আন্দোলন। বঙ্গবন্ধুর ওপর মিথ্যা মামলা সরিয়ে নেওয়ার আন্দোলন।’ সানম বলে, ‘তারপর কি বঙ্গবন্ধুকে ছেড়ে দিয়েছে দাদু?’ ‘হ্যাঁ, ছাত্রদের আন্দোলনের তীব্রতা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। অবশেষে ওরা বঙ্গবন্ধুকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু তথা সারা বাংলার মানুষ সেদিন নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ হয়। কিন্তু পাকিস্তান সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি। উল্টো ঘুমন্ত বাঙালিদের ওপর শুরু করে গুলিবর্ষণ।’ দাদু বলতে লাগলেন। সানম জিজ্ঞাসা করে, ‘দাদুভাই, ওরা কি মানুষ না? মানুষ হয়ে মানুষের ওপর অত্যাচার করে এভাবে?’ দাদু বলেন, ‘ওরা পিশাচ। ওরা সর্বদাই বাঙালিদের ওপর এমন করে এসেছে। তাই তো বঙ্গবন্ধু সাতই মার্চ এক ঐতিহাসিক ভাষণে সমগ্র বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। ১৯৭১ সালের ছাব্বিশে মার্চ তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তারপর শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ।’ সানম বলে, ‘দাদু তুমিও কি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছ?’ দাদু বলেন, ‘কী যে বলো দাদুভাই, বঙ্গবন্ধুর সেই আহ্বানে সাড়া না দিয়ে থাকতে পারে কেউ? সকল তরুণ, যুবক, কৃষক, পুলিশ, ছাত্র যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আমিও ভারতে গিয়ে ট্রেনিং নিয়ে আসি। তারপর যুদ্ধে যাই। নিজের হাতে বারোজন পাকিস্তানিকে গুলি করে মেরেছি আমি। আমার মতো হাজারো যোদ্ধা নিজের জীবনের চিন্তা না করে সেদিন যুদ্ধে গিয়েছিল। স্বপ্ন একটাই, ওদের হাত থেকে মুক্ত করতে হবে এ দেশ। অবশেষে সেই দিন এলো। ডিসেম্বরের ১৬ তারিখ। পাকিস্তানি বাহিনী ৯৩ হাজার সৈন্যসহ সেদিন আত্মসমর্পণ করে। আমরা যুদ্ধে জয়লাভ করি। জন্ম নেয় নতুন এক রাষ্ট্র। বাংলাদেশ।’ সানম বলে, ‘বাংলাদেশের জন্ম কত কষ্ট করে হয়েছে তাই না দাদু?’ ‘হুম দাদুভাই। এই দেশ আনতে ত্রিশ লাখেরও বেশি মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে। দুই লাখ মা-বোন হারিয়েছে তার সর্বস্ব। রক্তের নদী বয়ে গেছে। সবুজ বাংলাদেশ রক্তে লাল হয়ে গেছে সেদিন। কিন্তু কেউ পিছপা হয়নি। জয় ছিনিয়ে এনেছি আমরা।’ সানম বলে, ‘আমি অনেক গর্বিত এই কারণে যে আমার দাদু একজন মুক্তিযোদ্ধা আর আমি বাংলাদেশের সন্তান।’ দাদুভাই, ‘এ গল্প প্রত্যেককে জানতে হবে। এ আমাদের পিতৃপুরুষদের গল্প। মুক্তিযুদ্ধের গল্প। আমাদের বিজয়ের গল্প।’