Gazi Arif Mannan
বাবর সাহেব শিক্ষকতা পেশায় যোগদান করেছেন কিছু দিন হলো। তাকে প্রধান শিক্ষক পদে পোস্টিং দেওয়া হয়েছে তাঁর উপজেলার একদম সীমান্তবর্তী গ্রামে। সচরাচর সেখানে কেউ যেতে চায় না, ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক দিয়ে জন্মলগ্ন থেকেই চলছিল বিদ্যালয়টি। বাবর সাহেব শহরের নামীদামী কলেজে পড়ালেখা করলেও গ্রামের মা-মাটি ও মানুষের সাথে থাকতে চান। তাই তিনি কোন ধরনের টানা পড়েন ছাড়াই মনের আনন্দে অজপাড়াগাঁয়ের সেই বিদ্যালয়ে যোগদান করেছেন। তিনি বিদ্যালয়ে যোগদানের পর থেকে পারিপার্শ্বিক অবস্থান বিবেচনা করে বিদ্যালয়ের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করেন এবং সে অনুযায়ী নানাবিধ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেন। বাবর সাহেব দেখলেন যে বিদ্যালয়ে প্রায় শিক্ষার্থী অনিয়মিত থাকে, তিনি বিষয়টি কমিটির সদস্যদের সাথে আলোচনা করে শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে নিয়মিতকরনে উৎসাহিত করার উদ্যোগ নেন। আবার অভিভাবকরাও যাতে শিক্ষার্থীদের নিয়মিত বিদ্যালয়ে পাঠায় সে ব্যাপারে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। আরেকটি বিষয় বাবর সাহেবের নজরে পড়েছে এবং তা হলো শিক্ষার্থীদের সুনির্দিষ্ট ইউনিফর্মের সমস্যা। ধনী গরীব বৈষম্য দূরীকরণ ও দৃষ্টিনন্দনের জন্য নির্দিষ্ট ইউনিফর্ম প্রয়োজন রয়েছে বলে সবাইকে জানান। শিক্ষার্থীদের ড্রেস নির্ধারণে দেশের জাতীয় পতাকার রঙ লাল সবুজ রঙটা নির্বাচন করেন সবার সাথে আলোচনা মাধ্যমে। এই একমাসের মধ্যে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ইউনিফর্মের সাজ লাল সবুজে রূপান্তরিত হয়। শিক্ষার্থীদের দেখতে খুব চমৎকার লাগছে এখন, বিদ্যালয়ে যাওয়া আসার সময় গ্রামের মানুষজন তাকিয়ে দেখে। যেখানে আগে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা আসতেই চাইতো না, আজ দল বেঁধে সব একসাথে বিদ্যালয়ে যাতায়াত করে। অভিভাবকরাও সবাই এখন খুব খুশি শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়মুখী করতে পেরে। এখন নভেম্বর মাস চলছে, বিদ্যালয়ের চারপাশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্নকরণ ও সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ চলছে। এইসব কাজে প্রধান শিক্ষককে সহায়তা করছেন সহকারী শিক্ষকবৃন্ধ ও শিক্ষার্থীরা। বিদ্যালয়ের চারপাশে খালি জায়গায় বিভিন্ন প্রজাতির ফুলের চারা রোপণ করা হয়। শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে নিয়মিত পানি ও আগাছা পরিষ্কার করায় দিনে দিনে ফুলগাছগুলো বড় হতে শুরু করে। মাত্র দুই মাস আগের বিদ্যালয় আর পরের বিদ্যালয়ের সৌন্দর্য স্পষ্ট হয়ে উঠে। লাল, হলুদ, সাদা ও নীল ফুলে ছেঁয়ে গেছে পুরো বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ। বিদ্যালয়ের এইসব কর্মকাণ্ডের সাথে পড়ালেখার সুন্দর পরিবেশ তৈরি হওয়ায় সারা গ্রামে প্রধান শিক্ষকের সুনাম অতি অল্প সময়ের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। বাবর সাহেবের চমক এখানেই শেষ নয়, যেহেতু সামনে ডিসেম্বর তথা বিজয়ের মাস। তিনি কমিটির সদস্যদের সাথে আলাপে একজন মুক্তিযোদ্ধার খোঁজ চান, কমিটির সদস্যরা গ্রামের প্রবীণ মুক্তিযোদ্বা আজমত আলীর সন্ধান দেন। পরবর্তীতে প্রধান শিক্ষক তাঁর স্বপ্নের কথা কমিটির সদস্যদের জানান, তিনি বলেন আগামী ১৬ই ডিসেম্বরের অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের সামনে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে প্রধান অতিথি করে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনাতে চান এবং তাকে বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দিতে চান। তিনি প্রত্যাশা করেন সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একটি সুন্দর অনুষ্ঠান শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসীকে উপহার দিতে পারবেন। এতো বড় আয়োজনে কমিটির সদস্য, শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও প্রধান শিক্ষক সেচ্ছায় মনের আনন্দে নিজ দায়িত্বে কাজ করছেন। দেখতে দেখতে অনুষ্ঠানের দিন তারিখ চলে এলো, বিদ্যালয়ে সাজ সাজ রব, সবাই পরিপাটি হয়ে আজকের অনুষ্ঠানে এসেছে। শিক্ষার্থীদের মুখে শুনে অভিভাবকরাও আজকের অনুষ্ঠান দেখতে এসেছেন, গ্রামের শত বছরের ইতিহাসে এমন আনন্দময় অনুষ্ঠান কখনো কেউ দেখেননি কিংবা শোনেননি বলা যায়। অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগেই শিক্ষার্থীদের লাইনে দাঁড় করানো হয়। সবার হাতে ফুলের পাপড়ি, রাস্তার দু'ধারে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে শিক্ষার্থীরা। এদিকে উৎসুক জনতা এই সকল কর্মকাণ্ড উপভোগ করছে এবং হাততালি দিচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আজকের অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি বীর মুক্তিযোদ্ধা জনাব আজমত আলী আগমন করেন, শিক্ষার্থীরা ফুল ছিটিয়ে অতিথি বরণ করে নেন। অনুষ্ঠানস্থলের মঞ্চে স্বাগত জানানো হয় এবং আসন গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করা হয়। শিক্ষার্থীরা মুহুর্মুহু করতালির মাধ্যমে উৎসব আয়োজন সার্থক করে তোলেন। অতিথিকে শিক্ষার্থীদের সামনে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। প্রধান অতিথি আজমত আলীর হাতে স্মারক ক্রেস্ট তুলে দেওয়া হয়। প্রধান অতিথি বক্তৃতা দেওয়ারকালে মুক্তিযুদ্ধের সংক্ষিপ্ত কাহিনি শিক্ষার্থীদের সামনে তুলেন ধরেন। ১৯৭১ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে আমরা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছি। আমরা যে যার মতো করে বিভিন্ন দল ও উপদলে বিভক্ত হয়ে লড়াই চালিয়েছি। মুক্তিবাহিনীর হয়ে ছোট বড় অনেকগুলো দুঃসাহসিক সম্মুখ যুদ্ধ লড়াই করেছি। সেইরকম আমাদের বাহিনীর সদস্যরাও পাঁচ-ছয় জন মিলে একেকটা ঝুঁকিপূর্ণ অপারেশন সফলভাবে করে ফেলতে পারতো! এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য এসব গেরিলা অপারেশনের মাধ্যমে বাহিনী পাকসেনা এবং তাদের এদেশীয় দোসরদের মধ্যে চরম আতংক ও ভীতির সঞ্চার করে তুলতে সক্ষম হয়। দফায় দফায় হামলার পর, পাকবাহিনী ঝটিকা অভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকজন গেরিলা যোদ্ধাকে ধরে নিয়ে যায়। তাদের ধরে টর্চার সেলে নিয়ে নির্মমভাবে অবর্ণনীয় অত্যাচার চালানো হয়। নিষ্ঠুর টর্চারের মুখোমুখি হয়েও তারা একজনও মুখ খুলেননি এবং নতি স্বীকার করেননি! পরবর্তী সময়ে এই সাহসী মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে কয়েকজনের আর কোন খোঁজই পাওয়া যায়নি! আমাদের স্বাধীনতার আস্বাদ পাইয়ে দিতে গিয়ে তারা চিরতরে হারিয়ে গিয়েছেন কালের অতল গর্ভে! একের পরে এক সম্মুখ যুদ্ধে ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যাই আমি। বোমার স্প্রিন্টারের আঘাতে ক্ষত বিক্ষত হয় পুরো শরীর, আহত অবস্থায় উদ্ধার করে সহযোদ্ধারা, এখনো শরীরে ক্ষত চিহ্ন রয়েছে। কিন্তু এখনো আপসোস হয় প্রিয় সহযোদ্ধাদের জন্য। যাদের রক্তের বিনিময়ে পেয়েছি আমার সোনার বাংলা। উপস্থিত অনেকেই এইসব কথা শুনার পরে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি। তিনি বলেন আমরা টগবগে তরুণ বয়সে দেশ প্রেমে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছি, তোমাদেরও সেভাবে তৈরি হতে হবে। দেশ বিনির্মানে সবার সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে হবে, তার আগে চাই ভালোভাবে পড়ালেখা। আমরা মুক্তির সংগ্রামে ছোট বড় সবাই মিলে যুদ্ধে শত্রু মুক্ত করেছি, একটি স্বপ্নের বাংলাদেশ পেয়েছি। তিনি বলেন আজ আমি খুবই আনন্দিত ও গর্বিত একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে শিক্ষার্থীদের সামনে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বলতে পেরে। পরবর্তীতে সভাপতির ভাষণে প্রধান শিক্ষক বলেন, আজ শিক্ষার্থীদের সাথে মুক্তিযুদ্ধের গঠনার স্বাক্ষী বীর মুক্তিযোদ্ধা জনাব আজমত আলীকে পরিচয় ও তাঁর কাছ থেকে যুদ্ধের বর্ণনা শুনতে পেরে আমরা আনন্দিত এবং একই সাথে বিদ্যালয় থেকে সম্মান ও সংবর্ধনা দিতে পেরে গর্বিত। এভাবে বাবর সাহেবের একটি স্বপ্ন ও বীর মুক্তিযোদ্ধা'র সংবর্ধনা অনুষ্ঠান সফলভাবে শেষ হয়।