মোঃ মোহাইমিনুল।
বাবার সরকারি চাকুরির দরুন কখনও লম্বা সময় গ্রামে থাকা হয় উঠেনি।তারপরেও,বছরের শেষের দিকে অল্প সময়ের জন্য হলেও শিকড়ের সন্ধানে দাদাবাড়িতে একবার ঢুঁ মারা গত সাত-আট বছর ধরে অলিখিত নিয়ম হয় দাঁড়িয়েছিল। তবে গত বছরের শীতের ছুটিটা আমার আমৃত্যু স্মৃতি হয়ে থাকবে।কারণ,আমি সাক্ষী হয়েছিলাম ১৯৭১ সালে নির্ভীকচিত্তে লড়ে যাওয়া এক বীর বাঙালির বীরত্ব কাহিনির। দূর সম্পর্কের দাদা হন তিনি আমার।নাম আব্দুস সোবহান মৃধা।আশির কোঠায় পা রাখলেও তার চালচলনে যুবকের প্রতিচ্ছবি ভেসে বেড়ায় এখনও।মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি পুলিশ বাহিনীতে চাকুরীরত ছিলেন।বদলি ছিলো খুলনা-বাগেরহাট অঞ্চলে।স্মৃতির মেঘলামা পুঞ্জীভূত করে তিনি আমাদের শুনিয়েছিলেন তার এবং তার দলের বীরত্বকাব্য... "বুঝলে নাতি,৭০ এর বন্যার পরে তোমার দাদিকে ঘরে আনি।আমার থাকতে হতো দূরে,শ্বাশুড়ি-বউ মিলে বেশ সুখেই ছিলো।এত বড় বিপর্যয় শেষ হতে না হতেই যুদ্ধের ধামামা বেজে উঠল দেশজুড়ে।দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ থেকে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে নিজেকে বিলিয়ে দিতে মোটেই কুন্ঠাবোধ করি নি।বঙ্গবন্ধুর সেই চিরচেনা দরাজ গলায় যখন বেতারযোগে শুনলাম,"ইহাই হয়ত আমার শেষ বার্তা,আজ হইতে বাংলাদেশ স্বাধীন।.....চূড়ান্ত বিজয় অর্জন না করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাও।" তখনই আমি-সহ সমমনা বেশ কয়েকজন নদী পার হয়ে সুন্দরবনে গিয়ে আশ্রয় নেই।আমরা বুঝতে পেরেছিলাম,পরিকল্পনা মাফিক না এগোলে হানাদারদের রুখে দিতে আমরা কতটা সফল হবো সেটা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাবে!এজন্য দরকার ছিলো দৃঢ় মনোবল এবং পর্যাপ্ত অস্ত্র ও চিকিৎসা সরঞ্জামাদি।যার কোনোটাই আমাদের তখন ছিলো না।সবারই বারবার বাড়ির কথা মনে পড়ছিলো।আর অস্ত্র চিকিৎসা তো প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল। আমাদের সেক্টের দায়িত্বে ছিলেন মোহাম্মদ আব্দুল জলিল।মুক্তিযোদ্ধাদের একত্র করে বেশ কয়েকটি সাব-সেক্টরে ভাগ করে দেয়া হয়েছিলো।আমরা বেশ কয়েকবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিলাম। ছোটো ছোটো দলে ভাগ হয়ে অপারেশনে বের হতাম।তবে,অনেকে খাবারের অভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছিলো।তিনবেলা খাবার জুটানো বেশ কষ্টসাধ্য ছিলো আমাদের জন্য।তাছাড়া কেউ আহত হলে সহজে চিকিৎসাও মিলত না।এমনও হয়েছে,অপারেশনে কারও শরীরে বুলেট ঢুকেছে।কিন্তু,সেই বুলেট বের করা যায় নি।আহত অবস্থায়,বেঁচে থেকেও মৃত মানুষের মতো পড়ে থাকতে হতো।অনেক সময় ক্ষত স্থানে পচন ধরে গ্যাংগ্রিন হয়ে যেতো।দুর্গন্ধে কেউ আর তার কাছেই যেতে পারতো না।এরকম আরও অনেক বিষাদগার কাহিনী আছে।একবার হলো কি শোনো,আমরা খবর পেলাম বড় বোটে করে পাক-হানাদাররা রায়মঙ্গল নদী ধরে ভেতরের দিকে আজ রাতে অগ্রসর হতে পারে।সেটা খুব সম্ভবত আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে।ক্যাম্প থেকে ত্রিশ জনের একটা টিম পাঠানো হলো,তাদের রুখে দেয়ার জন্য।আমরা ৫ দলে ভাগ হয়ে আগে-পিছে ওত পেতে থাকি সারারাত।আমাদের দলে বেশ কয়েকজন তরুনও ছিলো,বেপরোয়া স্বভাবের। দেখলেই মনে হতো,এদের জন্মই হয়েছে কেবল যুদ্ধে জীবন বিলিয়ে দেবার জন্য।এরকম দুজন ভারী মর্টার চালাতো।আমরা ৯ এমএম স্টেন এমজি,পাকিস্তানে তৈরি ৪৪ এমএম হ্যান্ড লাঞ্চার,ভারতে তৈরি ৭.৬২ এমএম এসটিআর ও গোলাবারুদ নিয়ে গিয়েছিলাম।রাত তখন শেষের দিকে,তখনই হঠাৎ করে বোটের শব্দ আমাদের কানে আসে।রেঞ্জের ভেতরে আসা মাত্রই আমরা আক্রমণ শুরু করি।বোধকরি ২৮-৩০ জনের দল এসেছিল যারা কোনো প্রতিরোধ বেস্টনি তৈরি করার পূর্বেই নদীতে তলিয়ে যায়।বলতে গেলে এটাই ছিলো আমার অংশগ্রহণ করা বড় অপারেশন। এছাড়া ছোটো ছোটো আরও অনেক অপারেশনে আমি ছিলাম।নিজের হাতে যে কয়েকটা পাকি মারি নি,সেরকমটাও না।এভাবেই ৭ ডিসেম্বর আমরা মোংলা ও সুন্দরবন হানাদার মুক্ত করতে সক্ষম হই।পরে তো ১৬ ই ডিসেম্বর পুরো জাতি নতুন এক স্বাধীন ভূমির স্বাদ পেলো।আমরা পেলাম শহীদদের রক্ত খচিত লাল-সবুজের পতাকা।পৃথিবীর বুকে জন্ম নিলো নতুন একটি দেশ,বাংলাদেশ!" উন্মুখ হয়ে শুনছিলাম,একাত্তরের এক তরুণের গল্প।যে করে নি কোনো মৃত্যুভয়,যাকে রুখে দিতে পারে নি কোনো পিছুটান।শত্রুর বুলেটের মুখে লড়ে গিয়েছে,শকুনের থাবা থেকে দেশমাতৃকাকে ফিরিয়ে আনতে।বাড়ি ফেরার পথে নিজেকে বারবার প্রশ্ন করছিলাম,যুদ্ধের সময় যুবক হলে আমিও কি এরকম নিজেকে অকাতরচিত্তে বিলিয়ে দিতে পারতাম? মুক্তিযুদ্ধের পরের প্রজন্ম যারা আমাদের মতো,তাদের সকলেরই রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি অগাধ সম্মান এবং ভালোবাসা।দেশ মাতৃকার কঠিন সময়ে যারা নিজেকে বুলেটের সামনে দাঁড় করাতেও পিছপা হয়নি,সেই মানুষগুলোই এক একজন আমার জন্য স্বপ্নের নায়ক;যারা সমস্ত অশুভ শক্তিকে হটিয়ে সামনে এগিয়ে যাবার মূলমন্ত্রে বিশ্বাসী।এই মহান ব্যক্তিরাই আমার অনুপ্রেরণা,এই মহান ব্যক্তিরাই আমার জেগে উঠার অদম্য শক্তির জ্বালানি! স্যালুট!হে সূর্যসন্তান,যারা বাংলার আকাশে বাতাসে মুক্তির গন্ধ ছড়িয়ে দিয়েছেন।আপন করে নিয়েছেন লাল-সবুজের পতাকা।জেগে উঠতে সহায়তা করছেন তরুণসমাজকে!