Adil Mahbub
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় তরগাঁও সৈয়দ বাড়ি মুক্তিযোদ্ধাদের এক অস্থায়ী ঘাঁটিতে পরিণত হয়। (তরগাঁও বর্তমান গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া উপজেলার একটি গ্রাম। তথ্যসূত্র: সৈয়দা সালমা আহমেদ)। রাত–বিরাতে মুক্তিযোদ্ধারা এই বাড়িতে আসতেন, খেতেন, বিশ্রাম নিতেন আবার রাতের আঁধারে গা ঢাকা দিয়ে চলে যেতেন। সৈয়দ বাড়ির কাজ ছিল, আগত এই মুক্তিযোদ্ধাদের দেখভাল করা, তাদের খানাপিনার ব্যবস্থা করা, তাদের সেবা করা। কিশোর আলমের বয়স ছিল তখন বারো বছর। এই বালককে বাড়ির বড় কর্তা এহসান মাস্টার খুঁজে পেয়েছিলেন গিলাপুরা গ্রামের একটি মাঠে। তার মা–বাবা কোথায় সে জানে না। সে তার বাবা–মাকে খুঁজে পাচ্ছে না। ধারণা করা হয়, পাকিস্তানি বাহিনী আর স্থানীয় রাজাকার বাহিনীর অত্যাচারে ওর বাবা–মা হয়তো কোথাও পালিয়ে গেছে। কিন্তু চেষ্টা করেও হয়তো তাদের ছেলেটাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারেননি। এহসান মাস্টার ছেলেটিকে নিজের ছেলের মতো আদর করে বাড়ি নিয়ে এলেন। সেদিন থেকেই আলম সৈয়দ বাড়ির একজন হয়ে গেল। আলমের কাজ বাড়ির ফুট ফরমাস আর মুক্তিবাহিনীর কোনো দল এদিকে এলে তাদের সাহায্য–সহযোগিতা করা। একদিনের ঘটনা। মুক্তিযুদ্ধের একটি দল কোনো একটি অপারেশন শেষ করে সৈয়দ বাড়ির অন্ধকার বাংলা ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছিল। আলম সেই বাড়িতেই মাটিতে একটি চাটাই বিছিয়ে ঘুমাচ্ছিল। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ঘটনা ঘটল তখনই। মুক্তিবাহিনীর কাছে খবর এল, স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দল গোপন খবর পেয়ে সৈয়দ বাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে। এমন ঘটনায় স্বাভাবিকভাবেই সৈয়দ বাড়ির শান্তশিষ্ট রূপ হঠাৎ করেই রণক্ষেত্রে পরিণত হয়ে গেল। খবর পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ত্বরিত গা ঢাকা দিল। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তান বাহিনীর যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরপরই গোলার আওয়াজ কানে আসছে। সৈয়দ বাড়ির সবাই ভয়ে মাটির বাংকারে আশ্রয় নিয়েছে। হঠাৎ সবার টনক নড়ল। আরে আলম কোথায়? আলম কোথায়? আলমকে তো দেখতে পাচ্ছি না! না, আলমকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আবার এদিকে বাড়ির বাইরে আলমকে খোঁজার অর্থ নির্ঘাত মৃত্যু। কিছুক্ষণ পর গোলাগুলি একটু থেমে যাওয়ার পর হঠাৎ দূরে একটি চেনা কণ্ঠ শোনা গেল। হ্যাঁ, তাইতো এইতো আমাদের আলম! বাড়ির ছোট বউ সালমা আহমেদ আলমকে জড়িয়ে ধরলেন। কিন্তু আলমের কথা শুনে সালমার চোখ আকাশে উঠল। ‘একটা দা অথবা বটি লাগবে, গুলির বাক্সটা খোলা যাচ্ছে না। একটা দা খুঁজে দেবেন?’ আরে আলম, তুই গুলির বাক্স খুলবি? বলিস কী? হ্যাঁ, এটাই আমার কাজ। কিন্তু কয়েকটা বাক্স খুলতে পারছি না। একটা দা অথবা বটি দিতে পারবেন?’ সালমা খাতুন অনেক খুঁজে একটা বটি আলমের হাতে তুলে দিলেন। আলম সেটি নিয়ে এক দৌড়ে আবার হারিয়ে গেল সেই রণক্ষেত্রে। না, আলম আর ফিরে আসেনি। কী হয়েছিল আলমের? সে কী মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে অন্যত্র চলে গিয়েছিল? সেও কী পাকিস্তানি হানাদারদের আক্রমণে শহীদ হয়েছিল? কী হয়েছিল আলমের? নাকি আলম বেঁচে আছে? এখনো বেঁচে আছে! যুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল ১২ বছর। যদি বেঁচে থাকে এখন তার বয়স নিশ্চয়ই একষট্টি!