জমিন, কেতন, সাফ

ফাহাদ হোসেন ফাহিম

আমার ঘুম আসে না। চিন্তা হয়। কিন্তু আমার মত এই ছোট্ট মানুষের আবার কিসের চিন্তা! হ্যাঁ, আমি ছোট্ট মানুষ, তবে খুব ছোট নই। বয়স বারো বছর। ত্রসরেণুর মতো আমার চিন্তা জগতে ভাসতে থাকে দুশ্চিন্তার কণাদল। কিন্তু কিসের চিন্তা! মা মাথায় হাত দিতেই শুয়ে পড়ি ঘুমের ভান করে। কিন্তু মা জানে আমার ঘুম আসেনি। কারণ ঘুমে নিমগ্ন থাকলে আমার বুকটা খুব কাঁপতে থাকে। ছোটবেলায় গাছ থেকে পড়ে গিয়ে বুকে ব্যথা পেয়েছিলাম। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মা বলে, " ঘুমিয়ে পড় বাজান, সকালেই তোর জন্য ভাতের ব্যবস্থা করমু।" মায়ের কথা শুনে আমার বুকের স্পন্দন বেড়ে যায়। কিন্তু আমার চিন্তার হেতু যে খাবার না, অন্যকিছু, সেটা আমি কিভাবে বুঝাব মাকে। চিন্তার বিরুদ্ধে গিয়ে অনভিপ্রেত হয়ে ঘুমিয়ে পড়তে বাধ্য হয় আমার মস্তিষ্ক। ঘুমিয়ে পড়ে মা-ও। কিন্তু মনের ঘুম না হলে কি মস্তিষ্কের আর বিশ্রাম নেয়া হয়! চোখবুঁজে একরকম ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি আমি। ভাবতে লাগি সে-ই কথা। কোন সে কথা যা মা'কেও বলতে পারছি না আমি। আর কিসেরই বা চিন্তা! আমার বাবা মারা গেছে সেই কবে। মা'ই আমার বেঁচে থাকার প্রেষণা। মা ছাড়া দুনিয়াতে আর কেউ নেই আমার। অভাবের সংসার। কোনমতে কেটে যায় বেলা, আমার কলিজায় হাতুড়ি মারে অবহেলা। আমার বয়সী ছেলেমেয়েরা যেখানে স্কুলে পড়ে, আমি সেখানে পতাকা বিক্রি করে বেড়াই। মায়ের ইচ্ছা আমাকে শিক্ষিত বানাবে, কিন্তু অভাব যে শিক্ষার অন্তরায়। অবশ্য এতে মায়ের দুঃখ নেই। কারণ মা বিশ্বাস করে দেশ ও দশের জন্য যে কাজ করতে জানে, সেই শিক্ষিত। কিন্তু মায়ের চিন্তা ছেলেটা কাজ করতে পারবে তো দেশের জন্য! হতে পারবে কি শিক্ষিত! ভোর হবার আগেই ঘুম থেকে উঠে পড়ি আমি। ধূসর রঙের থলিটা হাতে নিয়ে তাকিয়ে থাকি আকাশপটে। পেছন থেকে মায়ের হাত পড়তেই সতর্ক হয়ে উঠে। " কি অইছে বাজান, রাইত থেইকা তুই কিসের চিন্তা করতাসস? খিদা লাগছে?" " না মা। খিদা লাগে নাই। খিদা সহ্য কইরা থাহন যায়, কিন্তু দেশের খিদা কি সহ্য করা যায়? " " কি কস, কিসের দেশের খিদা!" " দেশের ও খিদা লাগে মা। দেশের খাবার মানুষের ভালবাসা, দেশপ্রেম। কিন্তু..." " কিসের কিন্তু?" " গতকাল বিজয় দিবস গেছে মা। অনেক পতাকা বেচছি। হেরা আমারে জিগায় পতাকার দাম কত? পতাকার দাম তো অমূল্য মা। তাতেও সমস্যা নাই। কিন্তু বিজয় দিবসের পর যে হেরা সেই পতাকারে জমিনে পাড়ায় মারে। পতাকার দাম কি শুধু একদিন, ২০ টাকা দিয়া শোধ হয়! আমার কষ্ট লাগে মা, হেগো দেশপ্রেমের চেতনা একদিনের আমাগো সারাজীবনের। আমি পতাকা টোকাইতে বের হমু মা। জমিন, কেতন, সাফ করতে হইবো। পতাকারে বাঁচাইতে হইবো পদদলিত হওয়ার হাত থেকে।" মায়ের চোখে জল চলে আসে। মায়ের চোখের জল মুছতে মুছতে আমি বলে উঠি, " জানো মা যখন কেউ লাল সবুজ পতাকায় আঘাত করে মনে হয় যেন আমার শহিদ বাবার শরীরে আঘাত করছে। জমিনে লাল সবুজ কেতন দেকলে আব্বার রক্তের কথা মনে পড়ে যায়।" কাঁদতে কাঁদতে মা বলে, " যা বাজান।" ও বলে উঠে, " কাপড় বেচতে গেলাম মা। পতাকা তো বিক্রি করা যায় না। আর লাল সবুজ দিঘল পতাকাকে বাঁচাবার জন্য এগিয়ে যেতে যেতে আমি বলতে থাকি - " জমিন, কেতন, সাফ; সবুজ পতাকায় বাপ। " একটা পতাকাও যদি আজকে বাঁচাতে পারি, তাতেই আমার বিজয়! তাই নয় কি?