Md. Asif Ali
সময়টা তখন ২০১৮ সাল। আমি ক্লাস সেভেনে পড়ি। একদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে গিয়ে দেখি, আমার মা ঘরের ভিতর মরার মতো শুয়ে আছে। বাইরে থেকে দেখেই ভয় পেয়ে যায় আমি। তাড়াতাড়ি ভেতরে ছুটে যায়। ভেতরে ঢুকেই আমার চোখে পড়ে-মা’র মুখটা ভীষণভাবে জখম করা। দেখেই মনে হচ্ছিল যেন- মা আর নেই, আমার মা মারা গেছে। কেমন ছিল সেই সময়টুকুর অনুভূতি, তা এই মুহূর্তে লিখে বোঝানো সত্যিই অসম্ভব আমার পক্ষে। তারপর জানিনা কতক্ষণ বসে ছিলাম মায়ের পাশে। অতঃপর একসময় জেগে উঠলো মা। বললো- -তুই এসেছিস? -হ্যাঁ মা, আমি এসেছি। -আমি তোর নানির বাড়ি চলে যাচ্ছি। তুই কি যাবি, নাকি থাকবি তোর বাপের কাছে? সে সময় বেশিকিছু ভাবিনি। তাছাড়া ছোট্ট মগজে বেশি কিছু ভাবনাও আসেনি আমার। তাই সেদিন একবাক্যেই রাজি হয়ে গিয়েছিলাম মায়ের সঙ্গে যেতে। তারপর প্রায় খালি হাত আর গায়ে যা ছিল তা নিয়েই চলে গিয়েছিলাম নানির বাড়িতে। আমার জন্ম হয়নি কোনো বড়লোকের ঘরে, আর আমার মায়ের ক্ষেত্রেও ছিল তাই। অর্থাৎ আমার নানিও আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী ছিলেন না। শুধু নানি বললাম এ কারণেই যে, আমার নানা মারা গেছেন। আবার আমার নানার আগেও মারা গেছেন আমার দুই আপন মামা। আমার নানির ছিল বলতে শুধু দু’টি কুঁড়েঘর। তাই নানির বাড়িতে গিয়ে শুধু মাথা গোজার মতো ঠাঁই-ই হয়েছিল আমাদের। আমার মায়ের ওমন অবস্থা দেখে সেসময় এলাকার সবারই একটু করুণা জন্মেছিল মনে হয়, তাই যে যেভাবে পারে সে সেভাবেই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল আমাদের দিকে। আগেই বলেছি, আমরা শুধু আমাদের গায়ে যা ছিল তা নিয়েই নানির বাড়ি গিয়েছিলাম। তারপর সেখানে একটা কাজও পেয়ে যায় আমার মা। আমি দেখেছি, আমার ঘুম থেকে ওঠার আগেই আমার মা কাজে চলে যেত আর ফিরতো ঠিক সন্ধ্যার সময়। ভাগ্য ভাল ছিল যে, আমার নানির বাড়ি আমার বাবার বাড়ি থেকে মাত্র সাড়ে চার কিলোমিটারের মতো দূরে ছিল। তাই সেখান থেকেই স্কুলে যাওয়া-আসা সম্ভব ছিল আমার পক্ষে। কিন্তু প্রয়োজন ছিল একটা সাইকেলের। আমার মা তার কাজের প্রথম টাকাটা পেয়েই কিনে দিয়েছিল একটা বাইসাইকেল। তারপর সেখান থেকেই আমি লেখাপড়াটা চালিয়ে যেতে থকি। আমি যখন ক্লাস নাইনে উঠি, অর্থাৎ প্রায় দুই বছর পরে, ভাগ্য কেন জানি আবারও টেনে আনে আমাদেরকে আমার বাবার বাড়িতে। দীর্ঘদিন বাবা একা একা ছিলেন, তারপর হাত পুড়িয়ে রান্নাবান্না করতে হতো, তাই আমরা আবার ফিরে আসাতে প্রথম প্রথম একটু ভালো ব্যবহারই শুরু করেন আমাদের সাথে। কিন্তু একট সময় এসে দেখি, আগে যা ছিল তার থেকেও বেশি নিচে নেমে গেছে আমার বাবা। চিন্তায় পড়ে যাই আমি আর মা। দুই বছর আগে আমি অনেকটা ছোট ছিলাম, বুদ্ধি ছিল না খুব একটা। তাই মায়ের কথা শুনে মায়ের হাত ধরেই চলে গেছিলাম সেসময়। কিন্তু এখন আমার বয়স আর একটু বেড়েছে। আর তাছাড়া, দীর্ঘ দুই বছর বাবা ছাড়া একা একা চলতে চলতে মনে হয় একটু আগেই ম্যাচিউরিটি চলে এসেছিল আমার মধ্যে। তাই বেশি চিন্তা না করে মাকে বললাম- -মা, এভাবে তো আর থাকা যায় না। এখান থেকে চলে যেতে হবে আমাদেরকে। আমার কথা শুনে মা বললো- -কিন্তু যাব কোথায়? তোর নানি বাড়ি গেছিলাম, কিন্তু থাকতে পারলাম না তো সেখানে। যেখান থেকে একবার চলে এসেছি দ্বিতীয়বার তো আর সেখানে যাওয়াও যায় না, আর তাছাড়া আমি যেতেও চায় না আর সেখানে। তার ওপর আবার এখন চারিদিকে করোনার লকডাইন ঢাকতেও তো যাওয়া যাবে না! -মা, তুমি ঠিকই বলেছো। আমিও তা করতে চায় না। তবে আমার মাথায় আরেকটা বুদ্ধি এসেছে। -কী বুদ্ধি? -আমরা এখান থেকে চলে গিয়ে বাসা ভাড়া করে থাকতে পারি। মা সেদিন আমাকে আর বেশি কিছু বলেনি। শুধু এতটুকুই বলেছিল যে, তুই যেখানে থাকবি, আমিও সেখানেই থাকবো। তারপর আরও আনেক ইতিহাস ঘটে গেছে। যা এই ছোট্ট গল্পে কোনোভাবেই সম্পূর্ণভাবে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব নয়। যাহোক, একসময় সত্যি সত্যিই আমি আর আমার মা চলে আসি সে বাড়ি থেকে। শুরু হয় আমাদের জীবনের আরেক নতুন অধ্যায়। সত্যিই, স্রষ্টা বলে একজন আছেন। যিনি সবার অগোচরে থেকেই যার যা প্রয়োজন তাকে তাই নিঃস্বার্থভাবে দিয়ে যান। আমি এখন ক্লাস টেনে পড়ি। অর্থাৎ, বাবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার আরও এক বছর পেরিয়ে গেছে আমার। স্রষ্টার অশেষ রহমতে আমি আমার মাকে নিয়ে সত্যিই এখন অনেক ভাল আছি। তাই আমার কাছে মনে হয়- আমার জীবনের প্রত্যেকটি দিনই আমার বিজয়ের দিন, আমার মায়ের বিজয়ের দিন। এ বিজয়, আমাদের বাবার সেই অমানবিক আচরণ থেকে বেঁচে নতুন জীবন পাওয়ার বিজয়। এ বিজয়, আমাদের প্রত্যেকটা দিন কঠিন পৃথিবীর কঠিন বাস্তবতার সাথে লড়ে দিনশেষে আরেকটি নতুন দিন পাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ঘুমাতে যাওয়ার বিজয়।