KAMRUL HASAN
গল্পটা অনেক সাদামাটা হলেও নিজের জীবনের গল্পটা নিজের কাছে হিরোর মতই মনে হয়। আট দশটা নি¤œমধ্যবিত্ত পরিবারের মতই ছিল আমার পরিবারটা। আমি যখন অষ্টম শ্রেণীতে পড়ি আমার বাবা সৈনিক থেকে অবসরে যান। বেশিদিন চাকুরি করতে পারেন নি। কারণটা হচ্ছে বাবার অসুখ। বাবার বিভিন্ন রকমের অসুখ সারা বছর ধরেই লেগে থাকত। বুঝার বয়স থেকেই দেখে আসছি বাবা অসুস্থ। সত্যিকার অর্থে বাবা কখন সুস্থ ছিল তা কখনোই দেখতে পায়নি। সবসময়ই বাবা অসুস্থ থাকতেন। চাকুরিতে থাকাকালীন সময়েও প্রায়ই তিনি হাসপাতালে থাকতেন। মূল ঘটনায় আসি। অসুস্থতার কারণেই বাবা চাকুরি চালিয়ে যেতে পারলেন না। অবসরে চলে আসলেন। আমি সবার বড় সন্তান। আমরা দুই ভাই এক বোন ছিলাম। বাবা অবসর নিয়ে গ্রামের বাড়িতে চলে আসার পর বাবা পেনশনের টাকা দিয়ে সংসার চালাতেই হিমসিম খেতে হত। বাবা থাকতেন অসুস্থ। উনার প্রচুর পরিমানে ঔষদের দরকার হত। একটা সময় দেখা গেল পেনশনের সিংহভাগই ঔষধ আনার পিছনে ব্যয় হতে থাকে। বাবার অসুখগুলোর বিবরণ দেই তাহলে বুঝতে সুবিধা হবে। বাবার প্রধান অসুখ ছিল শ্বাসকষ্ট, ডায়বেটিকস, হৃদরোগ, দাঁতের ব্যাথ্যা, হাই প্রেসার। তার সাথে বারমাস ঠান্ডা লেগে থাকত। বাবা ছিলেন রাগী। অল্পতেই রেগে যেতেন। আমি তখন নবম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত। অর্থের টানাটানিতে নাজেহাল অবস্থা। পড়াশোনা করব নাকি কাজে লেগে যাব সেই চিন্তা মাথায় সব সময় ঘুরত। পড়াশোনায় ভাল ছিলাম বলে পড়ালেখা ছাড়তে মায়া লাগত। সংসারের অভাবটা দেখলে পড়াশোনা করতে ইচ্ছে করত না। টেবিলে বসে থাকতাম। চিৎকার দিয়ে কাঁদতে পারতাম না। বাবার মেজাজ গরম হয়ে গেলে মারতে আসবেন। অসুস্থ মানুষের মনমানষিকতাও অসুস্থ থাকে। বাবাকে দুষ দিয়ে লাভ নেই। মা কষ্ট করতেন। মা আমার অবস্থা দেখে বললেন, বাবা পড়াশোনা কর। তুই সংসার নিয়ে চিন্তা করিস না। সংসার আমি দেখব। মা বললেই মাথা থেকে চিন্তা সরে যায় না। তখন মনে হতে থাকে অর্থই সবকিছু। অর্থ না থাকলে কিছুই করা যায় না। অর্থের জন্য হন্যে হয়ে কাজ খুঁজতে লাগলাম। অল্প বয়স। নবম শ্রেণীতে পড়–য়া ছেলেকে কেউ কাজ দিতে চায় না। মজুরি খাটব সেই ব্যবস্থাও নেই। মার এতে ঘোর আপত্তি। নি¤œ মধ্যবিত্তের অনেকগুলো দুষের মধ্যে একটা প্রধান দুষ তাদের আত্মসম্মান। আত্মসম্মানের কারণে তারা সব কাজ করতে পারে না। কে কি ভাববে এগুলো অনেক বেশি ভাবায়। ভাবতে ভাবতে আশাহত হতে হয়। কোন কাজই শেষ পর্যন্ত পাওয়া যায় না। আমার অবস্থা ঠিক সেই রকম হয়েছিল। অনেক ভাবনা ভাবার পর শেষ পর্যায়ে মজুরির কাজও পেলাম না। এদিকে সংসারের অবস্থা নিবু নিবু। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে সবার বড় আমি। বাবা অসুস্থ হয়ে সারাদিন বিছানায় পরে থাকেন। মা সারাদিন ঘ্যান ঘ্যান করে। বাবা মার সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রায় সারাদিন ঝগড়া। বিশেষ করে টাকা পয়সা নিয়ে দিন নেই রাত নেই শুধু জগড়া। বাবা যা পেনশন পান এটা দিয়ে বাবারই হয় না। সংসার চলে কিভাবে? সকাল বেলা প্রচন্ড শব্দে ঘুম থেকে উঠতে হয়। গভীর রাতেও মাঝে মাঝে শব্দ শোনা যায়। বাবা মার জগড়া প্রতিদিনকার রুটিন। তখন মনে হত আত্মহত্যা করি। এই জীবন রেখে কি লাভ? পড়াশোনা করতে ইচ্ছে করত না। স্কুলে যেতে ইচ্ছে করত না। কারও সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করত না। মন খুলে কারও সাথেই হাসতে পারতাম না। খেলা ধুলা করতাম না। একটা ধ্যানের মধ্যে সব সময় থাকতাম। মানুষজনের সাথে না মিশার কারণে আমার সাথেও কেউ মিশতে চাইত না। স্কুলের বন্ধুরাও কেউ আমার সাথে মিশত না। আমি ও কারও সাথেই মিশতাম না। কেউ কথা বললে উত্তর দিতাম। আমি নিজ থেকে কোন কথাই বলতাম না। বাড়িতেও কারও সাথেই তেমন কথা বলতাম না। বাবা মার জগড়ার সময়ও আমি কখনোই তাদের সামনে যেতাম না। মা আমাকে বকত আর বকত। আমাকে বলত আমি বোকা। আমি বেকুব। আমি সহজ সরল। মন খুলে কথা না বলার কারণে সবাই আমাকে বেকুব ডাকত। আমার নাকি জীবনে কোন উন্নতি হবে না। আমি নাকি কিছু করতে পারতাম না। এমনটাই সবাই বলত। সংসারের ভয়াবহ হলতের মধ্যেই বাড়িতে শাকসবজি যা উৎপাদন হত তা আমি বাজারে বিক্রি করতাম। বিক্রি করে যা টাকা আসত তা দিয়ে কোন মতে স্কুলের বেতন পরিশোধ করতাম। মার কাছে খাতা কলম চাইলে মা গাছ থেকে বিভিন্ন ফল পেরে বাজারে বিক্রি করে খাতা কলম কিনতে বলতেন। আমি তখন কৃষিকাজে মন দিলাম। বাড়িতে পেঁপে গাছ এনে লাগালাম। পেঁয়েরা গাছ এনে লাগালাম। পেঁপে গাছ গুলো অল্প দিনেই বড় হল। প্রচুর পেঁপে ধরা আরম্ভ করল। আমি কাচাঁ পাকা পেঁপে বাজারে বিক্রি করে স্কুলের বেতন, খাতাকলম কিনতে লাগলাম। এসএসসি পরীক্ষাতে প্রথম বারেই পাশ করে ফেললাম। ছাত্র হিসেবে মাঝারি মানের ছিলাম। ঘর থেকে তেমন কোন উৎসাহ পেলাম না। উৎসাহ পাওয়ার মত পরিবেশও ছিল না। টাকা না থাকলে উৎসাহ আসবে কোথায় থেকে। স্কুলের সেরা রেজাল্ট করলে অনেকেই এগিয়ে আসে সাহায্যের হাত বাড়ায়। মাঝারি মান বা তার চেয়ে ও ভাল রেজাল্ট করলে কেউ এগিয়ে আসে না। তাদের নিয়ে কেউ ভাবে না। অনেক জায়গায় বৃত্তির জন্য আবেদন করলাম। কোন জায়গা থেকেই বৃত্তি পাওয়ার মত আশার বাণী কেউ শোনাল না। বাড়ীতে থাকব না এটাও মনস্থির করে ফেললাম। বাবা মার প্রতিদিনকার জগড়া দেখতে দেখতে আমার অন্তরাত্মা একেবারেই কাঁট হয়ে গেছে। আমার কাছে প্রায়ই মনে হত আমার ঘর আমার জাহান্নাম। দিন রাত চব্বিশ ঘন্টায়ই কোন না কোন বিষয়ে জগড়া লেগেই থাকত। আমি ঘর থেকে নিস্তার পেতে চাচ্ছিলাম। আমি যখন ঘরে শহরে পড়াশোনার কথা বললাম, বাবা মা কেউ কিছু বলল না। বলার মত কোন ভাষাও ছিল না। বাবা মা চান আমি পড়াশোনা করি। কিন্তু অর্থ ছাড়া শহরে পড়াশোনা হয় না। তার অর্থ দিবে কোথায় থেকে। আমি বাড়ি থেকে দূরে কিছুটা গ্রাম্য কিছুটা শহরে একটা কলেজে এইচএসসিতে ভর্তি হয়ে গেলাম। শুরুতে লজিং থাকতে লাগলাম। লজিংটা ছিল ওদের বাড়ির দুইতিন জনকে পড়াতে হবে। ওরা আমাকে থাকতে খেতে দিবে। এটাতেই রাজি হয়ে গেলাম। গ্রামের বাড়ি ছেড়ে দিলাম। বাবা মা থেকে দূরে চলে গেলাম। কিছুদিন ভালই লাগল। কয়েক মাস পরেই সময়টা খারাপ যেতে লাগল। লজিং বাড়িতে রাখতে চাইল না। আমার পড়া নাকি লজিং বাড়ির ছেলে মেয়েরা বুঝে না। তারা অন্য একজন মাস্টার রাখল। আমার থাকা বাতিল হয়ে গেল। কূল কিনারাহীন জীবন নিয়ে অথৈই সাগরে পরলাম। বাড়িতে এসে কয়েকমাস থাকলাম। আবার বাড়ির গাছের পেঁপে, কাঁচামরিচ, শাকসবজি, নারিকেল বাজারে নিয়ে বিক্রি করতাম। যা পেতাম তা মার কাছে কিছু দিতাম। বাকিটা আমার কাছে রেখে দিতাম। কয়েক মাস এই রকম শাকসবজি বিক্রির টাকা নিয়ে কলেজে গেলাম। এতদিন কলেজ বন্ধ করলে কলেজ কর্তৃপক্ষ আমাকে রাখতে চাইল না। প্রাইভেট কলেজ। তাদের সুনামের ক্ষতি হবে। স্যারদের হাতে পায়ে ধরে ভর্তি বাতিল ঠেকালাম। স্যারদের সহায়তায় আবার একটি লজিং বাড়ি পেলাম। পড়াশোনায় খুব যে একটা মনোযোগী হতে পারতাম তা না। তবে পড়াশোনার প্রতি একটা অন্য রকম দরদ ছিল। খেয়ে না খেয়ে এইচএসসিতে মোটামুটি ভাল রেজাল্ট করলাম। আমার মত এই ভাল রেজাল্ট দিয়ে কোন কাজ হল না। প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় না হতে পারলে কোন স্কলারশীপও পাওয়া যায় না। কেউ হাত বাড়িয়ে এগিয়েও আসতে চায় না। আমাকে কেউ হাত বাড়াতে আসল না। আমি বিভিন্ন ব্যাংক, ব্যক্তি বা পত্রিকায় প্রকাশিত সাহায্য দাতা গোষ্ঠীর সাথে যোগাযোগ করেও ব্যর্থ হলাম। আমার এই রেজাল্ট দিয়ে কেউ হাত বাড়াতে এগিয়ে আসল না। আমাকে নিজের পয়সাই চলতে হল। নিজে পয়সা উর্পাজন কিভাবে করব তার কোন ধারণাই ছিল না। সবাই ঢাকা যায় পড়াশোনা করতে। আমিও সবার মত ঢাকাতে গেলাম পড়াশোনা করতে। জীবনে যা আছে তাই হবে। বাড়িতে যাব না এটা ফাইনাল করে ফেললাম। বাবা মার জগড়া দেখতে দেখতে চোখ পচে গেছে। অন্তরটা শুকিয়ে গেছে। শরীল শক্ত কাঠের মত হয়ে গেছে। ঢাকার জীবন আরও কঠিন। জেলা সদর বা থানা সদর এলাকাতে লজিং এর ব্যবস্থা থাকলেও ঢাকা শহরে কেউ লজিং রাখতে চায় না। কোন কূল কিনারাই পাচ্ছিলাম না। চিন্তা করলাম দরকার হলে রিক্সা ভ্যান চালাব। রিক্সা ভ্যান চালাতে গিয়ে দেখি সেখানে ও প্রতিযোগীতার অভাব নেই। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি যুদ্ধে লাখ লাখ ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে আমার জায়গা হল না। আমি ভর্তি হলাম এনইউ এর আন্ডারের কলেজগুলোতে। মনটা একেবারেই ছোট হলে গেল। নিজের জীবন নিয়ে একেবারেই হতাশ হয়ে গেলাম। কি করব তার কোন কূল কিনারা পেলাম না। ভাই বোনগুলোও বড় হয়ে গেল। ওদের খাবার দাবার। বাবার ঔষধ। মা ফোন করে প্রায়ই বলত, বাবা তুই একটা কিছু কর। তুই কিছু না করলে সংসার চলছে না। এভাবে আর কতদিন। আমি কি করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এইচএসসি পাশের যত চাকুরি আছে তাতে ইন্টারভিউ দিলাম। কোন জায়গাতেই চাকুরি হচ্ছে না। চাকুরির জন্য জুতার পাঁয়ের তলি খরচ করে ফেললাম কোন কাজ হল না। কলেজের বন্ধুর সহায়তার একটা টিউশনি পেলাম। সেই টিউশনির টাকা দিয়ে বস্তির মধ্যে ছেঁড়া টিনের ঘরে আশ্রয় নিলাম। একটা টিউশনি থেকে আরেকটা। এভাবে একটা কোচিং সেন্টারেও পড়াতে লাগলাম। এনইউতে প্রতিদিন ক্লাস করতে হত না। তাই টিউশনিতেই বেশি সময় দিতে লাগলাম। কোচিং এ সময় দিতে লাগলাম। নিজের পড়াশোনাটা চালিয়ে যেতে লাগলাম। সাহিত্যের প্রতি ঝোক ছিল। প্রচুর বই পড়তাম। সেই সুবাধে বিভিন্ন পত্রিকায় লেখালেখি করতে লাগলাম। পত্রিকা থেকেও অল্প বিস্তর অর্থ আসত। সেই অর্থ দিয়ে নিজের লেখাপড়া চালিয়ে বাড়িতে কিছু খরচ পাঠাতাম। সেই খরচ মা পেয়ে কে যে কান্না। আনন্দের কান্না। আমি ও মোবাইলের অপর পাশ দিয়ে কাঁদতাম। মায়ের কান্নার শব্দ আমি শুনতে পেলেও আমার কান্নার শব্দ মা শুনতে পেত না। আমি ছিলাম চাপা স্বভাবের। আমি সব কিছু মুখ দিয়ে বলতে পারতাম না। অন্তরে অন্তরে পুরতাম। এভাবে কয়েক বছরের মাঝেই ছোট ভাইকে সাথে আনলাম। ওকে ও পড়াশোনার জন্য চাপ দিলাম। ওর যেন কোন কষ্ট না হয় বা অর্থের জন্য লেখাপড়ায় কোন সমস্যা সৃষ্টি না হয় সেদিকে নজর দিতে লাগলাম। অনার্স শেষ করার সাথে সাথেই বিআইডবিøউটিসিতে হিসাব সহকারীর চাকুরি পেলাম। এর পরে সোনালী ব্যাংকে। বর্তমানে সোনালী ব্যাংকে আইটি অফিসার হিসেবে কর্মরত আছি। আমার বাবা মার জগড়া এখন নেই বললেই চলে। বাবা মা ভাই বোন স্ত্রীকে নিয়ে এখন খুব সুখেই জীবনযাপন করছি। এই ছিল আমার সফলতার গল্প। লেখক: কামরুল হাছান মাসুক গ্রাম/পো: খেওড়া, থানা: কসবা, জিলা: ব্রাহ্মণবাড়িয়া। মোবাইল: ০১৯২৩২৪৪৫২৮, ০১৬৮৪২৫৫১৪৭ ই মেইল: শধসৎঁষথ৪৫২৮@ুধযড়ড়.পড়স