হালিমা আক্তার তন্বী
চলছে বিজয়ের মাস। এ বছর বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী পালিত হবে। ১৯৭১ সালে সংঘটিত রক্তক্ষয়ী নয়মাস ব্যাপী যুদ্ধের পর অর্জিত বিজয় ছিল ন্যায্য অধিকার আদায়ের, স্বৈরাচারী শাসকদের দাসত্ব থেকে মুক্তির।বাহ্যিক যুদ্ধের যেমন সূচনা আর সমাপ্তি রয়েছে, অভ্যন্তরীণ যুদ্ধের ক্ষেত্রে তেমন নেই। এটির শুরু আছে কিন্তু সমাপ্তি মৃত্যুর আগ অবধি নেই। বাইরের বিজয় অর্জন করা অপেক্ষা শতগুণ জটিল অভ্যন্তরীণ বিজয় অর্জন। পৃথিবীতে আগমনের পূর্বেই মাতৃগর্ভে থাকাকালীন শুরু হয় সেই অঘোষিত যুদ্ধ যা চলমান থাকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। আর সেই যুদ্ধ হলো নিজের সাথে নিজের। নিজের যাবতীয় কু-প্রবৃত্তির সাথে সৎ গুণাবলির যুদ্ধ, মন আর মস্তিষ্কের যুদ্ধ। ইসলামে একে "জিহাদে আকবর" বা বড় জিহাদ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। জিহাদে আকবরে যে বিজয় অর্জন করতে পারবে, সেই প্রকৃত যোদ্ধা, সেই প্রকৃত মানুষ। আমরা মানুষ, কেউই ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে নই। কখনো কখনো নিজের সাথে নিজের এই নিরব যুদ্ধে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়ি। সমাপ্তি টানতে চাই। অনেকে না পেরে উঠে কু-প্রবৃত্তিকে সঙ্গী করে আর কেউ কেউ নিজের জীবনেরই ইতি টানে। আসলে বিষয়টিই যে অনেক দীর্ঘ আর জটিল! পৃথিবীজুড়ে করোনা মহামারির আগমন যেন বিষয়টিতে আরো নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। ঘরবন্দী হয়ে অলস মস্তিষ্ক তার যা করার তাই করেছে।তবে এক্ষেত্রে আমি বলবো, আমার জন্য এই মহামারির দেড় বছর ছিল জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সময়। নিজেকে নিয়ে ভাবার এত অফুরন্ত সময় এর আগে কখনো আমার জীবনে আসেনি। আমার যুদ্ধের এবং বিজয়ের গল্প আরো আগে থেকেই হয়তো শুরু হয়েছে কিন্তু তার পূর্ণতা ঘটেছে এই মহামারিতে। সেসব গল্প বলতে হলে একটা গোটা বই লিখতে হবে। সেসব না হয় আগামীর জন্য তোলা থাক। এবার তাহলে আর গৌরচন্দ্রিকা না করে এবারকার গল্পে ফিরি। আমি যখন স্কুলে পড়তাম তখন থেকেই আমার মধ্যে একটি প্রতিযোগী মনোভাব গড়ে উঠেছিল। বই সংক্রান্ত যেকোনো প্রতিযোগিতা আমার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। এসব প্রতিযোগিতায়+একাডেমিকে আমি বরাবরই ভালো ফলাফল করতাম।নিয়মিত স্কুলে যেতে, পড়াশোনা করতে ভালোবাসতাম। স্কুল, কলেজে শিক্ষকদের কাছে পরিচিত নাম ছিলাম আমি। তারা আমার খুব প্রশংসা করতো। বাকি ছাত্রীদের আমার মত হতে বলত। বিষয়টি ভালোই লাগত। যেকোনো ভালো শিক্ষার্থীর এতে ভালোলাগা কাজ করবে স্বাভাবিক।তখন আমার মধ্যে কিছু ভ্রান্ত ধারণাও জন্মেছিল অবশ্য ঐ বয়সে বুদ্ধি অত পরিপক্ব হবে না স্বাভাবিক। এছাড়া পারিপার্শ্বিক পরিবেশটাই ছিল এমন। আমি মনে করতাম, লেখাপড়ায় যারা ভালো হয়, তারা মানুষ হিসেবেও ভালো হয়। লেখাপড়ায় দুর্বল শিক্ষার্থীরা জীবনে আসলে কিছুই করতে পারে না। যাইহোক, কলেজে প্রবেশের পর আমার ভ্রান্ত ধারণার কিছুটা পরিবর্তন হলো কারণ কিছু আড্ডাবাজ মানুষের সাথে পরিচয় হয়েছিল। জীবনকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে শুরু করল।স্কুলে আমার তেমন আড্ডা দেওয়ার মত বন্ধুবান্ধব ছিল না বা আমি কখনো আড্ডাবাজও ছিলাম না। তো আড্ডাবাজ জীবনের সাথে পরিচয় ঘটার পর লেখাপড়ায় ফাঁকি দিতে শুরু করলাম। যাইহোক, কলেজের পাঠ চুকিয়ে এবার উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের পালা।আমি ভালো ছাত্রী ছিলাম বিধায় পরিবার, আত্মীয়স্বজন তথা নিজেরও নিজের প্রতি একটা বড় রকমের প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল।আমার স্বপ্ন ছিল ঢাবিতে পড়ার কিন্তু উপরওয়ালার পরিকল্পনা হোক আর আমার নিজের যথাযথ পরিশ্রমে ঘাটতি থাকা হোক, যে কারণেই হোক, ঢাবি আমার কপালে জুটল না। এই যে ব্যর্থতা সেটা ক্রমে ক্রমে বিষণ্নতায় রূপ নিল। আমার স্থান হলো খুবিতে। কিন্তু সেই বিষণ্নতা আর কাটল না। ঢাবিতে পড়তে না পারার আফসোস তো ছিলই, সাথে যুক্ত হলো আরো নতুন নতুন বিষয়। সেগুলো হলো-প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির মধ্যে বিরাট ব্যবধান, পড়াশোনায় আগের মত উৎসাহ না পাওয়া, একাডেমিক ফলাফল খারাপ হওয়া, নিজেকে নিজের ভালো না লাগা, অন্যের সাথে সর্বদা নিজের তুলনা করা, ভালো ফলাফলকারীদের প্রতি ঈর্ষাণ্বিত হওয়া, স্যারদের তিরস্কার, পারিবারিক নানা ব্যাপার, নিজের ক্রোধ সংবরণ করতে না পারা, কোথাও মানসিক শান্তি খুঁজে না পাওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। নতুন অনেক অভিজ্ঞতাও হয়েছিল। মৃত্যুকে প্রায় কাছাকাছি দেখার অভিজ্ঞতা।খুবিতে আসার পর ইতিবাচক কিছু যে আমার সাথে ঘটেনি এমন না। কিছু ভালো জিনিসও ঘটেছে যারমধ্যে উল্লেখযোগ্য- খুব ভালো কিছু বন্ধু পেয়েছি এখানে এসে। এছাড়া সবসময় আমার আমার থেকে যারা খারাপ অবস্থায় আছে, সমাজের সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য কিছু করার তাগিদ অনুভব করতাম। এছাড়া নিজের একটা গুপ্ত প্রতিভাও ছিল। একারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটো ক্লাবের সাথে যুক্ত হয়েছিলাম। তবে এতকিছুর পরেও নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম কোথাও যেন! আমার মধ্যে সেই প্রতিযোগী মনোভাব, স্পৃহা হারিয়ে গিয়েছিল। আত্মবিশ্বাস ছিল শূণ্যের কোঠায়।আমি মনে করি, প্রতিযোগী মনোভাব থাকা ভালো যতক্ষণ না সেটা কারো ক্ষতি করে। বাংলাদেশে করোনা মহামারির আবির্ভাবের ঠিক আগে বিশ্ববিদ্যালয় ট্যুরে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম তাতে মানসিক শান্তি মিলবে। সমুদ্র আমার বরাবরই ভালো লাগে তাতে মন ভালো হওয়ার কথা কিন্তু ট্যুর থেকে বাড়ি ফিরে আবার যা ছিলাম তাই হয়ে গেলাম। এরপর ঘরবন্দী জীবন শুরু হলো। ভেবেছিলাম আগে তাও কিছু না কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম তাতে বিষণ্নতা পুরোপুরিভাবে আমাকে গ্রাস করতে পারেনি। এখন তো সারাদিন ঘরে থাকতে হবে! বিষণ্নতা তো এবার গিলে খাবে আমাকে! কিন্তু তখনই ঘটল পরিবর্তন। মহান সৃষ্টিকর্তার পরিকল্পনা আমাদের বোঝা অসম্ভব। ঘরবন্দী এই সময়ে আমি কিছু অনলাইনভিত্তিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ শুরু করলাম নিতান্ত সময় কাটানোর জন্য।কিন্তু পরবর্তীতে এই বিষয়টিই আমাকে এই ক্রান্তিকালে ভালো রেখেছে। এছাড়া নতুন নতুন অনেক প্যাশন যুক্ত হলো। বুক ফটোগ্রাফি এবং কসপ্লে। প্রতিযোগিতা গুলোতে জয়ী হবার মাধ্যমে আমি আমার হারিয়ে যাওয়া উদ্যম, আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলাম। সাথে ছিল সৃষ্টিকর্তার অসামান্য কৃপা। এ কারণে আমার বিষণ্নতা দূরীভূত হতে লাগল। আমার মানসিক শান্তি ফিরে আসতে লাগল। আমার দ্বারা কিছু হবে না এটা মুখে না বললেও মস্তিষ্কে সর্বদা ঘুরপাক খেতো কিন্তু মনের মধ্যে কোথাও যেন একটু আশার আলো ছিল সেই আলো এই মহামারিতে দ্বিগুণ উজ্জ্বলভাবে জ্বলে উঠতে লাগল। মন আর মস্তিষ্কের এই তীব্র যুদ্ধের এবারের মত অবসান হলো, সাথে কিঞ্চিৎ বিজয় লাভ করলাম সকল প্রকার নেতিবাচকতা থেকে। ঈর্ষা, জাজমেন্টাল হওয়া, ক্রোধে হিতাহিত জ্ঞান ভুলে যাওয়া থেকে। আমি মহামারিতে যেসব প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে বিজয়ী হয়েছি তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- নোবিপ্রবি ক্লাব আয়োজিত বুক/মুভি রিভিউ প্রতিযোগিতায় ১ম, মনোসেবা : মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করে এমন একটি সংগঠন। তাদের আয়োজিত প্রতিযোগিতায় ফিরে আসার গল্প সেগমেন্টে ১ম, সময়'২০ আয়োজিত '১৯৯০' প্রতিযোগিতায় বুক ও মুভি রিভিউ দুটো সেগমেন্টে ১ম, বইপল্লব আয়োজিত নজরুল জন্মজয়ন্তী উৎসবে 'নজরুল সাজ' প্রতিযোগিতায় ৩য়, গ্রীণ ফাইটিং মুভমেন্ট আয়োজিত বিশ্ব নদী দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজিত রচনা প্রতিযোগিতা 'তটিনী কল্প-২০২১'-এ ৪র্থ স্থান অর্জন, ইসলামি বই আয়োজিত 'সিরাত বুক প্রিভিউ প্রতিযোগিতা'য় ৭ম স্থান অর্জন, রাবি ক্লাব আয়োজিত প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় ২য় স্থান অর্জন ইত্যাদি। মহামারির পর বিশ্ববিদ্যালয় যখন খুলল তখন জানতে পারলাম, মহামারিতে এসব অর্জনের জন্য আমার বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও আমাকে ক্রেস্ট আর সার্টিফিকেট দেওয়া হবে। এর চেয়ে আনন্দের আর কি হতে পারে! তবে যেকোনো ক্ষেত্রেই বিজয় অর্জনের পথ মসৃণ নয় আবার বিজয় অর্জিত হলেও সেটা ধরে রাখা অনেকক্ষেত্রে সম্ভব হয় না। তাই আমার নিজেকে নতুনরূপে আবিষ্কারের, পুনরায় ফিরে পাবার, সর্বোপরি একজন ভালো মানুষ হয়ে গড়ে ওঠার এই যুদ্ধে এখনো বহুপথ পাড়ি দেওয়া বাকি! দোয়া করবেন যেন, তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দিতে পারি।