এইতো বেঁচে আছি...... এটাই চূড়ান্ত বিজয়

মোঃ রুহুল আমিন

প্রতিটা শিশুর আগমন সেই পরিবারের অদম্য এবং বাধভাঙ্গা উল্লাসের কারণ। কেনই বা হবে না, একটা নতুন অতিথিকে পেতে যে তাদের কতই না কষ্ট এবং সংগ্রামের ইতিহাস লিখতে হয়। আমি নিজেও সাক্ষী। যখন একটা নবাগত শিশুর জন্ম হয় তখন সেই পরিবারের কত যে উল্লাস পরিলক্ষিত হয় সেটা বলার অপেক্ষা রাখেনা। প্রতিটি শিশু সুস্থ এবং স্বাভাবিক হয়ে জন্মলাভ করুক এটাই সকলের প্রত্যাশা। আমার বেলাও আমার বাবা-মায়ের প্রত্যাশার কমতি ছিল না। তাদের কতই না স্বপ্ন ছিল সুস্থ এবং স্বাভাবিক বাচ্চা হবে, আমাদের ঘরকে খুশির জুয়ারে ভরিয়ে দিবে। তাহলে আমি কি সত্যি সুস্থ এবং স্বাভাবিক নই? নাকি আমি বেঁচে নেই? এঁ, তাহলে গল্পটা লিখছে কে? হ্যাঁ তাইতো- আমি যদি এখন মাটির গহীন অন্ধকারে থাকি তাহলে গল্পের মূল লেখক কে? সত্যি, জানি আপনাদের মনেও একই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। চলুন ভিতরে যাওয়া যাক…. আজ থেকে অনেক দিন আগের কথা। ১৯৯৬ সাল। ১৯৯৬ সালের ১৮ তারিখ। ১৯৯৬ সালটি ইতিহাসে নানা কারণে বিখ্যাত হলেও আমার কাছে বিখ্যাত আমার জন্মসাল হিসেবে। আমার কাছে এই সালটি চির স্বরণীয়। যেখানে সবাই ভেবেছিল মৃতপ্রায় বাচ্চা সে কিভাবে এখনো জীবিত! হ্যাঁ, আমার নাম মোঃ রুহুল আমিন। আমার যে দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। যে ইতিহাস আমার কাছে জগত বিখ্যাত ইতিহাসেরই অনুরূপ । আমি আমার মায়ের পেটের ভিতর আছি, সময় প্রায় আট মাস, হঠাৎ আমার মায়ের পেটে জটিল পীড়া দেখা দেয়। বাবা, মাকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নিয়ে যায়। ডাক্তারেরা চিকিৎসা শুরু করেন। একপর্যায়ে তারা মেডিকেল বোর্ড গঠন করেন। মেডিকেল বোর্ডের প্রধান বাবার নিকট আসলেন। বাবা, আমার বড় ভাইকে কোলে নিয়ে দণ্ডায়মান। তখন আমার বড় ভাইয়ের বয়স ২ বছর। ছোটো মানুষ, মায়ের আদর স্নেহ পেতে চায়। কিন্তু মা তো তখনও চিকিৎসারত। বাবার কাছেই শুধু কান্না করছেন। ডাক্তার আসলেন, উনার অসহায় মুখ দেখেই বাবার হৃদয়ে মোচড় দিলো! ডাক্তার বল্লেন- আমরা দুঃখিত। এই রোগীকে বাচানো যাবেনা। আপনি বাড়িতে নিয়ে যান। রোগী যা ভালো মনে করে সেগুলো খাওয়ান। বাবার হৃদয়ে তখন দুঃখের, কষ্টের তরঙ্গ বহমান। আকাশ ভেঙে পড়ার অবস্থা! বাবা শুধু আমার ভাইটির দিকে তাকান আর ক্রমশ অশ্রু বিসর্জন দেন। এই ছেলের কি হবে! আমাদের ভবিষ্যত কি হবে! এমন হাজারো শঙ্কায় বাবা মাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে। পাড়া প্রতিবেশী সবাই নিস্তব্ধ! হাসপাতাল থেকে ফিরে দেয়া হয়েছে। নিশ্চিত মৃত্যু যখন আসন্ন। সবাই মৃত্যুর প্রহর গুনছে। হয়তো আর সামান্যই এই পৃথিবীর বুকে থাকবে আমার মা। আর আমি? সেতো অবশ্যম্ভাবী মৃত্যু। হয়তো মায়ের পেটেই আমার মৃত্যুর ঠিকানা। কত স্বপ্ন ছিল বাবার, অনাগত অতিথির জন্য কতই না প্রতিক্ষায় ছিল। কিন্তু সে প্রতিক্ষা যে আনন্দের না হয়ে বিষাদে রূপান্তরিত হবে এমন কথা যে স্বপ্নেও ভাবেনি কেউ। একদিন এক দাদা আমার বাবাকে বলেছিল, পরেশ বাবু নামে এক হিন্দু ডাক্তার আছে। শুনেছি উনি বেশ ভালো চিকিৎসা দেন। তুমি একবার সেখানে যেতে পারো। বাবা সেই দাদার কথা মতো চলে গেলো পরেশবাবুর কাছে। ষাটোর্ধ বয়স! পরেশবাবু সবকিছু শুনে বললেন, আমি আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করবো, মালিক যদি চান তাহলে শুধু একজনকে বাচাতে পারবো। আর যদি না চান কাউকেই সম্ভব না। বাবা বললেন, হ্যাঁ, সন্তানের মাকে বাচানোর চেষ্টা করেন। যেহেতু আমার বড় ভাই রয়েছে। তাকে দেখাশোনা করার জন্য হলেও আমার মার বাচা খুব প্রয়োজন। আমি তখন আমার মাকে বলেছিলাম, মা, যেহেতু কঠিন রোগ আপনার। তাহলে আপনি সুস্থ হোন। একজনকে বাচাতে পারবে পরেশবাবু। আপনার বাচতে হবে, ঐ যে দেখেন ক্রমাগত বড় ভাইটি কাদছে। আপনার ভালোবাসা ওর জন্য খুব প্রয়োজন। মা আমার কিছু প্রতিউত্তর না করে ক্রমশ অশ্রু বিসর্জন দিয়েছিল। কি নির্মম পরিণতি!! এক ছেলের ভালোবাসা অব্যাহত রাখতে আরেক ছেলেকে বিদায় নিতে হবে! এই ভেবে হয়তো সেদিন আমার মায়ের কলিজায় কি পরিমাণ আঘাত লেগেছিলো সেটা হয়তো মা ছাড়া আর কেউ বুঝবেনা। চিকিৎসা শুরু হলো। অনেক পাওয়ারের ওষুধ দিচ্ছেন পরেশবাবু। এতো টাই পাওয়ারের যে ওষুধের প্রভাব আমার মায়ের উপর পড়লো। মায়ের উপর পড়া মানে আমার উপর। আমি একদম ক্ষীণ হতে লাগলাম। খুবই ক্ষীণ। কিন্তু বাহিরের সবাই ধারণা করলো বাচ্চা নষ্ট হয়ে গেছে। হয়তো মায়ের পেটে বাচ্চা নেই। আমি ক্রমাগত চিৎকার করে বুঝাতে চাচ্ছিলাম যে আমি বেচে আছি। আমি নড়াচড়া করছি। আমার মাকে উদ্দেশ্য করে কষ্টদায়ক কোন কথা বলোনা প্লিজ। কিন্তু ওই!! আমি ক্ষীণ। আমার কন্ঠ তাদের কানে পৌছলোই না। মা আমাকে আশ্বস্ত করলেন। বল্লেন, বাবা তুমি কষ্ট পেওনা। তুমি তো আছো আমি জানি। মায়ের কথায় একটু শান্তি পেয়ে ঘুমাতে গেলাম। এভাবে চলতে লাগলো। প্রসব বেদনার দিন। ১৯৯৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারী। মা রমজানের রোজা রেখে, এশার নামাজ এবং তারাবী পড়ে ঘুমাতে যাবে। হঠাৎ প্রসব বেদনা শুরু!! চারদিকে বৃষ্টি, এবং বিদঘুটে অন্ধকার! বৃষ্টি মানে প্রবল বৃষ্টি। আমার মায়ের আত্ম চিৎকারে আসমান কেঁদে দিয়েছে। আমার দাদি শুধু মায়ের কাছে। বাবা মাদ্রাসায় চাকরি করেন পাশের উপজেলায়। হয়তো তিনি আসবেন অচিরেই। কিন্তু আজই যে প্রসব বেদনা উঠবে সেটা ভাবেন নি তিনি। পাশের ঘরের সবাই তখন ঘুমন্ত। বৃষ্টি তাদের ঘুমকে আরো প্রগাঢ় করেছে। দাদি বৃষ্টির মাঝেই আমার এক ফুফুকে ডেকে তুললেন। তাকে পাঠালেন দাঈ (দাদি)কে ডেকে আনতে। বৃষ্টির মাঝে তাকে নিয়ে আসলেন মায়ের কাছে। যথারীতি তিনি তার কাজ শুরু করলেন। রাত্রী ১২ টা, পৃথিবীর বুঁকে ভূমিষ্ট হলাম। পরদিন সকাল বেলা। মুহুর্তে আমার খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো। নানা জায়গা থেকে মানুষ আসা শুরু করলো। আমি অবাক হলাম! কেন এতো মানুষ? বাচ্চাতো শুধু আমি নই, অন্য অনেক বাচ্চাও তো ভূমিষ্ট হয় কই এতো লোক তো আসেনা!! আমি যে আর দু একটা বাচ্চার মতো নই। আমি অনেক ছোটো হয়েছিলাম। আমার হাত মুখ সারা শরীর অনেক ক্ষীণ হয়েছিলো। কেউ হাতের তালু দিয়ে আমার পুরো শরীর ঢেকে রাখতে পারতো। সকলের মুখে একই বাণী না হয় “পাত্তাই একদিন বোয়াল হবে” আবার পরক্ষণেই বলতো এই মরে সারছে। শুধু শোক দিতে আসছে। সেই আমি মোঃ রুহুল আমিন। জীবনের ২৬ তম বছরে পদার্পণ। জীবন এখনো চলছে। সেই আমি এখনো ভূপৃষ্টে বিদ্যমান। আমার বিজয়ের গল্প আমি এখনো জীবিত। আমার বিজয়ের গল্প, আমি এখনো পড়াশোনার মাঝে আছি। আমার বিজয়ের গল্প, আমি ক্লাস ওয়ান থেকে টেন পর্যন্ত রোল এক ছিলাম। বৃত্তি পেয়েছিলাম। এস এস সি এবং ইন্টারে গোল্ডেন এ প্লাস পেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছি। দেখতে দেখতে অনার্সও শেষ করলাম। জীবন যুদ্ধে অনেক সংগ্রাম করেছি। হাল্কা-পাতলা গড়নের বলে অনেক জায়গায় উপেক্ষিত হয়েছি। কত জন কত কটু কথা শুনিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। মাঝেমধ্যে তীব্র মন খারাপ হতো। মনে হতো জীবন যুদ্ধে এক পরাজিত সৈনিক আমি। মাঝেমধ্যে নীরবে নিভৃতে কত যে অশ্রু বিসর্জন দিয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। তবে আমার সৃষ্টিকর্তার প্রতি কোন অভিযোগ নেই। আমাকে এখন অব্ধি বেঁচে রেখেছি তার জন্য অশেষ শুকরিয়া হে মহান রব। আল্লাহ আমাকে অনেক বিজয় দান করেছেন। আমি লেখালেখি করি। আমার মা আমাকে অনেক সাপোর্ট দিতো। ভাই, বোন, বাবা সবাই আমাকে ভালোবাসে। তাদের মুখে এক চিলতি হাসি ফুটানোর জন্যই আমি কষ্ট সংগ্রামে অবতীর্ণ হই। আমার কো-কারিকুলার অ্যাকটিভিটিস অনেক ভালো লাগে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ বছর জীবনের সেরা প্রাপ্তি ৩০ এর অধিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে পুরস্কার জিতে নেয়া। তমুদ্দুন মজলিস কর্তৃক দু দুবার রচনা প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হই। আমার ভালো লাগে গল্প লিখতে, মশাল নামক সংগঠন কর্তৃক গল্প লেখায় চ্যাম্পিয়ন হই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল কর্তৃক আয়োজিত রচনা প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় হই। নোয়াখালী বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে রচনা প্রতিযোগিতায় ২য় হই। সিরাজগঞ্জ জেলা পরিষদ কর্তৃক প্রেজেন্টেশন প্রস্তুত প্রতিযোগিতায় ২য় হই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাহিত্য সংসদ কর্তৃক আয়োজিত রচনা প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় হই। স্যার এ এফ রহমান হল কর্তৃক আয়োজিত কুরান তেলাওয়াতে চ্যাম্পিয়ন হই। এভাবে আরো অনেক রয়েছে যেগুলো না বলা গল্প হিসেবেই জমা থাক। আমার বিজয়, মানুষের খুশিতে, মানুষের উপকারে। করোনার মাঝে গ্রামে তরুণদের প্রতি ক্যাম্পেইন করেছি। কুরান শিক্ষা দিয়েছি। শিশুদের, তরুণ এমনকি বয়স্কদের কুরান হাদিসের জ্ঞান বিতরণ করেছি। তরুণরা মসজিদ মুখী হয়েছে এটা আমার বড় বিজয় প্রাপ্তি। তরুণদের লেখাপড়ার প্রতি যত্নবান হওয়ার উদ্দেশ্য কাউন্সিলিং করিয়েছি এটা আমার বড় প্রাপ্তি। আমার লক্ষ্য সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য কিছু করা। আশা করি সেটাও করে ফেলবো। হয়তো কিছু সময় বাকি। জমা থাকলো বাকি বিজয়ের গল্প বলার। আশা করি অপেক্ষা নয় বরং প্রতিক্ষায় থাকবেন। আমি ছুটছি আমার বিজয়প্রান্তে………