Md Almas Miah
তারা যে বাড়ি এসে ওঠে সেটা ছিল একটা মাটির ঘর। একটা নিরিবিলি বাড়ি। পরের দিন সকালে গ্রামের পাশের পথ দিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের অন্য এলাকায় যাওয়ার কথা। সকালে তাদের আক্রমণ করার সব প্রস্তুতি নিয়ে শুয়ে পড়ে মুক্তিযোদ্ধারা। গভীর রাতে এই গ্রামের হেলালুদ্দিন গোপনে পাকসেনাদের নিয়ে এসে হাজির হয় গ্রামে। সে মুক্তিবাহিনীরা যে ঘরে শুয়ে ছিল সেই ঘরটা দেখিয়ে দেয়। পাকসেনারা ঘিরে ফেলে মুক্তিবাহিনীর আশ্রয় নেওয়া বাড়িটা। গুড়ুম গুড়ুম গুলির শব্দে কেঁপে উঠে গ্রাম। হাহাকার করে উঠে গ্রামের মানুষ। বোধ হয় একটি মুক্তিযোদ্ধাও আর বেঁচে নেই। আসলে একটি মুক্তিযোদ্ধাও তারা মারতে পারেনি সেদিন। কারণ, রাতে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে হেলালুদ্দিনকে গ্রামের দিকে যেতে দেখে ফেলে মুদীর দোকানদার কবীর ভূঁইয়া। তিনি এক দৌড়ে এসে খবরটা পৌঁছে দিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে। মুক্তিযোদ্ধারা সাথে সাথে এ বাড়ি থেকে নিরাপদ জায়গায় সরে গিয়েছিল। গুলিতে বাড়িটা ঝাঁঝরা হয়ে যায়। সেনারা কাউকে না পেয়ে বাড়িতে আগুন লাগিয়ে পুড়ে ছাই করে ফেলে। পরে হেলালুদ্দিনের নেতৃত্বে সেনারা গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে শুরু করে নির্মম অত্যাচার আর জ্বালাও-পোড়াও। হেলালুদ্দিন পাকসেনাদের আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় কাকে ধরবে, কাকে মারবে আর কার করবে সর্বনাশ। সেনারা হেলালুদ্দিনকে সঙ্গে নিয়ে সেই রাতে সারা গ্রামে অত্যাচার ও লুটপাট করে। তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে গ্রামের নিরীহ মানুষের ওপর। গোটা গ্রাম তছনছ করে তারা হেলালুদ্দিনের বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া করে চলে যায়। তখন ভোর রাত। পাকিস্তানি সেনাদের যাওয়ার পথে ‘খালপাড়’ নামক স্থানে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের আক্রমণ করে। শুরু হয় মরণপণ লড়াই। প্রচণ্ড গোলাগুলি। কেউ ঘরের ও গাছের আড়ালে, কেউবা গর্তে এ লড়াইয়ে নিহত হয়। দুই পাকসৈন্য ও আরও দুজন রাজাকারকে ধরে ফেলে এলাকার লোকেরা। বাকিরা কোনোমতে দৌড়ে পালিয়ে বাঁচে। গোলাগুলিতে গ্রামের এক মায়ের একমাত্র ছেলে কিশোর আলাউদ্দিন শহীদ হন। একজন মুক্তিযোদ্ধা তলপেটে ও হাঁটুতে গুলি খেয়ে আহত হন। সেদিন পাওয়া যায়নি হেলালুদ্দিনকে। ঊনিশশো একাত্তর সালের এই ভয়ংকর ঘটনার কথা বলতে বলতে দাদি ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন। তিনি বলেন, আজ তোমরা যাঁকে ‘মুক্তিচাচা’ বলে চেনো, তিনিই সেদিন তলপেটে আর হাঁটুতে গুলি খেয়ে আহত হয়েছিলেন। পরে তাঁর একটি পা কেটে ফেলে দিতে হয়। তাঁর আসল নাম মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর। তখন তিনি ছিলেন আঠারো বছরের টগবগে তরুণ। আজ তাঁর এত বয়স হলো তিনি বিয়ে করেননি। ষোলই ডিসেম্বরে আমরা চূড়ান্ত বিজয় লাভ করি। কিন্তু এই মুক্তিপাগল জাহাঙ্গীরের যুদ্ধ শেষ হয়নি। তিনি পাড়ায় ঘুরে ঘুরে মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলে বেড়ান। হ্যাঁ, মুক্তিচাচা। আমাদের এলাকায় সবচেয়ে প্রিয় একজন মুক্তিযোদ্ধার নাম। আমি ঊনিশশো একাত্তর সালে ঘটে যাওয়া মুক্তিযুদ্ধের অনেক কাহিনি হরহর করে বলতে পারব। শুধু আমি নই, আমাদের এলাকার শুধু শিশুরাই নয়, প্রায় সবাই মুক্তিযুদ্ধের বহু ঘটনার কথা পটাপট বলে ফেলতে পারবে। কারণ মুক্তিচাচা মুক্তিযুদ্ধে পঙ্গু হয়েছেন, তাতে কি! তিনি মুক্তিযুদ্ধের পরও আজীবন চালিয়ে গেছেন মুক্তিযুদ্ধ। তিনি ক্রাচে ভর করে হাঁটতেন। আর বিভিন্ন স্কুলে, মাদ্রাসায় গিয়ে সবাইকে ডেকে ডেকে গোল করে বসাতেন। তারপর তিনি মুক্তিযুদ্ধের কাহিনি বলতেন। এমন করে বলতেন যে মনে হতো আমাদের চোখের সামনে মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে। মুক্তিচাচার কোনো চাকরি বা কাজ ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলাই ছিল তাঁর একমাত্র কাজ। তিনি যেখানে যেতেন, ছেলে-মেয়ে বুড়ো তাঁর কথা শোনার জন্য ভিড় করতো। অনেক মজা করে গল্প বলতে পারতেন তিনি। মুক্তিচাচাকে সবাই আদর করে খাওয়াতেন আর গল্প শুনে সবাই দিত উপহার। খুব চলে যেতো মুক্তিচাচার। মুক্তিচাচা হঠাৎ করে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। সারা এলাকার শিশু থেকে বৃদ্ধ আর নারীরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁকে কবর দেয়া হলো নিজ গ্রামে। হাজার হাজার মানুষ মুক্তিচাচার জন্য দোয়া করেন। এলাকার সব শিশুর ভেতরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগিয়ে দিয়ে গেছেন আমাদের প্রিয় মুক্তিচাচা