তাজুল ইসলাম অপু
মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ থেকে কয়েদি নম্বর ২৯১৭ বলছি। ২০১৭ সাল থেকে শুরু হয় এই কয়েদ জীবন।অনেক সময়ই নিয়তির সাথে অভিমান করতাম তখন।বারবার মনে হতো কি পাপের দায়ে আমার এই সাজা!ব্যক্তিগতভাবে বলতে গেলে,আমার আর একটা মুরগির মাঝে খুব বেশি তফাত ছিল না।অবশ্যই ফার্মের মুরগি,দেশি হওয়ার জো নেই।ফার্মের মুরগিও এক জায়গায় খায়,ঘুমায়,হাগু করে;আমিও বলতে গেলে সেসবই করতাম।তবে এক জায়গায় হাগু করাটা ছাড়া! বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার হাতছানি পেয়েছিলাম জীবনে।ষষ্ঠ শ্রেণিতে থাকাকালীন যখন কোচিং করতাম, তখন মেয়েদের কাছে অন্যতম আকর্ষণ ছিলাম আমি।তবে সেটা আমি না,আমার গড়ন।শাড়ি পরে গেলে মানুষ বোধহয় পোয়াতিই ভাবতো আমায়।মেয়েরা হয়তো কোন এক কল্পনার জগতে সেই দৃশ্যের কথা চিন্তা করেই হাসিতে মেতে থাকতো। যাই হোক,স্বভাবে ডিমবিহীন মুরগি হলেও পড়াশোনায় কিন্তু খুব বাজে ছিলাম না।সেটার জন্যই বোধহয় চিড়িয়াখানায় আমার আর স্থান হয়নি।তবে যদি যাদুঘরের লোকেরা খোঁজ নিত,তবে নিশ্চয়ই 'বিরল প্রজাতি' মনে করে তারা আমায় নিয়ে যেত। জানতাম,পড়াশোনায় ভাল করলে নাকি পুরস্কার দেয়া হয়।কিন্তু কিসের জন্য বিধাতা আমায় সাজা দিলেন সেটা আমি তখন বুঝতেই পারিনি।এত ভালভাবে ভর্তি পরীক্ষা দিলাম কয়েদ জীবন যাপনের জন্য? যাই হোক,ক্ষোভ প্রকাশ করাটা অনর্থকই হবে।২০১৭ সালের মার্চ মাস থেকেই শুরু হয় সেই কয়েদ জীবন।তবে কয়েদ হলেও খানিকটা উন্নত কয়েদ ছিল অন্তত!মানুষ রাতে ঘুমাতে যায় হাজারো স্বপ্ন নিয়ে।আর আমি ঘুমাতে যেতাম একটাই আশা নিয়ে-যদি আর ভোর না হতো!বাপরে বাপ!সকাল ৫টায় উঠতে হয়!জীবনে নিজের বাপকেও দেখিনি ৫ টায় উঠতে।অবশ্য দেখবো কিভাবে?আমি নিজেই ১২ টায় ঘুম থেকে উঠে দেখতাম বাসায় বাবা নেই।যাই হোক,৫ টায় উঠাটা নাহয় মানলাম(?)।কিন্তু তারপর যুদ্ধে কেন যেতে হবে?ভাইরে ভাই!টানা ৪০ মিনিট পিটি।যেই আমি কিনা স্বপ্নেও দৌড়ানোর সাহস করতাম না,সেই আমাকেই সকালে ৩কিমি দৌড়াতে হতো!ভাবা যায়!অবশ্য,জীবনে একটা জিনিস শেখার বাকি ছিল(?),সেটা প্রতিদিন সকালেই অনুশীলন করতাম।হ্যাঁ,অভিনয়!পা খোঁড়ানোর অভিনয়ে অস্কার পাওয়ার দাবিদার আমি!পা-সহ শরীরের বিভিন্ন জায়গার ব্যথার নাম করে কেটে পড়তাম।কিন্তু শেষ রক্ষা আর হতো না।কখনো অভিনয়ে ধরা পড়লেই দ্বিগুণ -তিনগুণ সাজা বয়ে যেত আমার উপর দিয়ে! এক পর্যায়ে নিজের উপরই জেগে বসলো এক ক্ষোভ।আর কত!মুরগি হয়ে থাকতে আর ভাল লাগে না।মুরগিও তো ডিম দেয়,আমি তো সেটাও পারি না!মুরগিও তো মানুষের অনেক উপকারে আসে,আমি তো সেটাও পারি না!এরকমই নানান তুলনা আর ক্ষোভ এসে ভর করতো আমার মনে।ধিক্কার!নিজের উপর ধিক্কার! যাই হোক,এক পর্যায়ে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী বানিয়ে নিলাম একটা দেশি মুরগিকে।তবে সেটা কল্পনায়!যখন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে দৌড়াতাম,তখন নিজের চোখের সামনে ভেসে উঠতো সেই মুরগির ছবি।আর বারবার চেষ্টা করতাম সেই পাজি মুরগিটাকে টপকাতে!এভাবেই সেই 'মুরগি মিশন' এর ইতি টানলাম ৩ কিমি এর বদলে ৫ কিমি দৌড়িয়ে!হায় হায়!এ যে আমূল পরিবর্তন!নিজেকেই যেন নিজে বিশ্বাস করতে পারলাম না!মাত্র(?) তিনমাসের মধ্যেই মুরগি থেকে মানুষ হওয়ার পথে অগ্রসর হতে লাগলাম। সেই যাত্রাটায় নিজের মধ্যে কিছু পরিবর্তন আমায় আজও তুষ্ট করে।যেই আমি আগে কথা বলতে পারতাম না,সে আমিই আজ কলেজে বাংলা উপস্থিত বক্তৃতায় প্রথম হই!শুধু কলেজেই নয়,বরং কলেজের বাইরেও 'Literature to Live' কর্তৃক আয়োজিত বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় আমি প্রথম স্থান অর্জন করি(২০২০)।ক্যাডেট কলেজে আসার আগে আমি লেখালেখিতে খানিকটা কাচাই ছিলাম বলা চলে।অথচ এখন আমি বেশ কয়েকটি জাতীয় পর্যায়ে আয়োজিত রচনা প্রতিযোগিতায় প্রশংসনীয় স্থান অর্জন করি।উদাহরণস্বরূপ বলা চলে 'ASD' and 'DHR Project' কর্তৃক আয়োজিত রচনা প্রতিযোগিতায় ২য়(২০২১),'YLCCF' কর্তৃক আয়োজিত রচনা প্রতিযোগিতায় ১ম(২০২১),'শহীদ রুমী দিবস' উপলক্ষে আয়োজিত রচনা প্রতিযোগিতায় ১ম(২০২১), ইত্যাদি।এছাড়াও কলেজের বিভিন্ন সাময়িকীর পাতায় এখনো দেখা যায় আমার আবেগঘন শব্দমালা! আমি আজীবন মায়ের হাতের ছেলে!শাসন খুব কমই করা হয়েছিল আমায়।অবশ্য করা হবেই বা কেন!এরকম নাদুসনুদুস মোটাসোটা গোলগাল গড়নকে বকা দিতেও তো মায়া লাগার কথা!কিন্তু কয়েদ জীবনে তো মা নেই!আমার কী হবে এখন! কিন্তু মা না থাকলেও রাক্ষসী তো আর নেই!বরং এমন কয়েকজনের সান্নিধ্য পেয়েছি যারা মা-বাবার চেয়েও কোন অংশে কম ছিলেন না।এখানে শিক্ষকদের কথা না বললেই নয়!ফুলের পাঁপড়ি যেমন গর্ভাশয়কে আগলে রাখে,তেমনি ভাবে তাঁরাও আমাদের পরম যত্নে আগলে রাখতেন।যাক বাবা!কয়েদজীবনে অন্তত একটা শান্তির ছায়া মেলল। একবার সমাজ ক্লাসে স্যার বলছিলেন,"বিভিন্ন পুরাকীর্তি বহুবছর পর উদ্ধার করা হলে প্রত্নতাত্ত্বিকরা বলতেন যে অমুক সভ্যতার মানুষরা ছিল অত্যন্ত সভ্য.........।কিন্তু কখনো যদি ক্যাডেট কলেজ মাটির নিচে তলিয়ে যায়,আর হাজার বছর পরে তার উদ্ধার মেলে,তখন হয়তো প্রত্নতাত্ত্বিকরা বলবেন যে এই সভ্যতার ক্যাডেটরা ছিল অত্যন্ত অসভ্য!".... অবশ্য না বলার তো কোন কারণ দেখছি না।স্বভাবতই সারাদিন আমাদের জুতা বদল করতেই পার হতো।একেক কাজের জন্য একেক জুতা।পিটির জন্য এক জোড়া,তো গেইমসের জন্য আরেক জোড়া,প্যারেড আর ক্লাসের জন্য আবার অন্য প্রজাতির জুতা!জীবনটা যেন জুতাময়ই ছিল।তো বারবার জুতার সাথে ছিল হরেক রকমের মোজা।এখন সারাদিনের ঘামের সাথে মোজাও প্রচণ্ড নোংরা হয়ে যেত। দুইদিন মোজা না ধুলেই গন্ধে আর থাকা যেত না।আমি তো আবার জন্মগত অলস।রুমের বাকিদের আমার মোজার গন্ধে বমি আসলেও আমার কোন ভ্রূক্ষেপই ছিল না।তারপরেও অগত্যা।ক্লাসমেটদের পচানি আর পীড়াপীড়িতে বাধ্য হয়েই একদিন মোজা ধুতে হলো।তা কোনরকমে মোজাগুলো ধুয়ে বাইরের তারে নেড়ে দিলাম.....। হঠাৎ করেই কিছুক্ষণ পর হাউস বেয়ারা ভাইয়ের হাঁকডাক পড়লো।কি হয়েছে দেখার জন্য গেলাম।গিয়ে দেখলাম যে আমার মোজাজোড়া যেখানে নেড়েছিলাম,তার পাশেই একটা সদ্যমৃত কাক পড়ে আছে!হায়রে!কাক পরিবারের কাছেও আর মুখ দেখানোর উপায় রইল না! কিন্তু এটা আমার প্রচণ্ড গায়ে লাগলো।আমার অপকর্মের জন্য একটা নিরীহ প্রাণি আত্মত্যাগ করলো!সেই থেকে আরেকটা মিশনে নামলাম-পরিষ্কার থাকার মিশন! ক্যাডেটদের লুকিয়ে লুকিয়ে করা অপকর্মের মধ্যে আরো ছিল আম-কাঁঠাল চুরি,বৃষ্টিতে ভেজাসহ আরো কত কী!এমনকী রাতের আঁধারে পুকুরের মাছ চুরি করেও পুড়িয়ে খায় এই প্রাণিরা! এসব করতে করতে কীভাবে কীভাবে জানি শেষ হয়ে যাচ্ছিল কয়েদজীবন।এগুলাই এক পর্যায়ে হয়ে উঠলো নিত্যদিনের কাজ।এক জীবনে এত আনন্দ বোধহয় আর সইবার নয়!ক্যাডেট কলেজে পাওয়া শ্রেষ্ঠ উপহার আমার ৫০ জন ক্লাসমেট।বিধাতা বোধহয় কোনকালে আমার উপর খুশি হয়েছিলেন,আর সেই সুবাদেই হয়তো তিনি আমায় এতগুলো স্বর্ণ দান করেছিলেন!ক্যাডেট কলেজ বলতে আমি এখন আমার ওই ৫০টা আত্মাকেই বুঝি,যারা আমায় ঘিরে রেখেছিল এক দেয়ালে,ভালবাসার দেয়ালে,কেয়ারিং এর দেয়ালে!ইট-পাথর-কাঠ থাকলেই অবকাঠামো বানানো যায়,কিন্তু বন্ধুত্বের ভালবাসা না থাকলে কখনো দেয়াল তৈরি হয় না!এখনো যদি কখনো মনে হয় যে এই দেয়াল না থাকলে আমি থাকবো কীভাবে!বিধাতাই ভাল জানেন!আমার দৌড় কেবল ওই 'মুরগি-মিশন' পর্যন্তই। প্রকৃতপক্ষে 'বিজয়' এর স্বাদ কেমন তা হয়তো আমার এই ক্ষুদ্র জীবনের পরিসরে এখনো আস্বাদিত হয় নি।কিন্তু আমার কাছে আমি এখনো বিজয়ের পথেরই বাসিন্দা।'মুরগি' থেকে 'মানুষ' হওয়া,'বোবা' থেকে 'বাগ্মী' হওয়া,আর কলম না ধরা থেকে 'কলামিস্ট' হওয়া,'সভ্য' থেকে 'অসভ্য' হওয়া,'অপরিষ্কার' থেকে 'পরিচ্ছন্ন' হওয়া,'অনুভূতিহীন' থেকে আবেগবান' হওয়া-এগুলোই আমার বিজয় যাত্রার এক একটি সিঁড়ি। তবে হোঁচট খেতে হয়েছে বারবার,কিন্তু আমরা হারতে জানি না,বা হারতে পারি না!কিন্তু হারাতে পারি অবশ্যই।আর তাইতো প্রতিবারই নিজেই নিজেকে হারাই,আর এটাই বিজয়ের সুখ!তবে আমার সবথেকে বড় বিজয়-"আত্মোপলব্ধি",যা আমায় প্রতিনিয়ত প্রেরণা যোগায় -"আমিও পারি!" বেশ কাটলো আমার ৪ বছর।এখনো সেই কয়েদজীবনের দুই বছর অবশিষ্ট আছে।জানি না দুই বছর বাঁচবো কি না!এটাও জানি না যে দুই বছর পর দেয়াল আর স্বপ্ন ছাড়া আমি বাঁচবো কীভাবে! এ যে আমার সাধনার ধন,সম্পত্তি নয়,এ জীবন আমার কাছে সম্পদ।হয়তো এখন আর সেই 'মুরগি বৃত্তান্ত' খাটবে না আমার জন্য।এককালে ভাবতাম কী অপরাধের দায়ে আমার এই কয়েদজীবন।আর এখন ভাবি কী পূণ্যের জন্য আমার এই অসংজ্ঞায়িত সুখ!এককালে আমিও রাতে ঘুমাতে যেতাম এক আশা নিয়ে,যদি ভোর না হতো।এখনো আমি রাতে ঘুমাতে যাই ওই আশা নিয়েই,'ইশ!যদি আর কখনোই ভোর না হতো।'কারণ ভোর হলেই যে আগামী দুই বছরের জীবন থেকে একটি দিন কমে যাবে! যদি কখনো আলাদীনের প্রদীপ হাতে আসে,আর যদি ইচ্ছা পোষণ করার কথা বলা হয়,আমি এই একটাই ইচ্ছার কথা ব্যক্ত করবো-যুগ যুগ ধরে আমি ফিরে পেতে চাই আমার স্বপ্নের সেই ৬ বছর,আমার বিজয়ের সুখ,আমারই সোনার হরিণ -আত্মোপলব্ধি !আর কিছু বৈ তো নয়!