আমার কিছু কথামালা

মো. মুকুল আলী

গল্পই জীবন। নাকি জীবনই গল্প। জীবন যে নদীর মতোই মাঝে মাঝে বাঁক নেয়, তা আমার জীবন গল্পে হয়তো ফুঁটে উঠেছে। আমার জন্ম ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার ভাতগাঁও গ্রামে। আমার পৈতৃক নিবাস কুড়িগ্রাম জেলার রাজীব থানার মোহনগঞ্জ ইউনিয়নে। নদীভাঙ্গনের মানুষ আমার পিতা। ব্রহ্মপূত্র নদের তীর ঘেষে আমাদের বাড়ি ছিলো। একদিন পিতার সর্বস্ব কেড়ে নেয় ব্রহ্মপূত্র। আমদের এক আত্মীয়ের সুবাদে আমার মা - বাবা ঠাকুরগাঁএ চলে আসেন। তারপরের গল্পগুলো এরকম- সাহিত্য জগতে মনিরুল ইসলাম মুকুল নাম নিয়েই হাঁটতে শুরু করি। আমার সার্টিফিকেট নাম মো মুকুল আলী। আমার প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'শান্ত মেঘে লুকিয়ে তুই' (২০২০) এবং উপন্যাসিকা 'মৃত্যুর পান্ডুলিপি' (২০২১) জাতীয় বইমেলায় প্রকাশিত হয়। আমি পড়াশোনা করছি রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে। আমি নিজেকে সুখী ও গল্পের মানুষ মনে করি। । তবে কি দুঃখ আমাকে ছুঁতে পারে না? ভুল বলছি! এই ক্ষুদ্র জীবনে দুঃখ ছুঁইয়েছিলো বারংবার, কিন্তু থেমে থাকিনি। আমি আমার জীবনের গল্পগুলো লিখছি কিছুটা বিষণ্ণ মুখে । কিছুটা হাসি মুখে। দিনমজুরির টাকায় ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি রোল নাম্বার একানব্বই। সর্বশেষ রোল নাম্বারটি আমার। আমার পর আর কেউ ওই বছর কচুবাড়ী উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হননি। পঞ্চম শ্রেণি অতিক্রম করবার পর অর্থের অভাবে জীবনটা থেমে যায়। টাকার অভাবে স্কুলে ভর্তি হতে পারছিলাম না। পড়াশোনাটাও আমার কাছে বিলাসিতা হয়ে দাড়ায়। কিন্তু থেমে থাকিনি। সেই ছোটো বয়সে সংগ্রাম করাটা বেশ ভালোভাবেই আয়ত্ত করে ফেলেছিলাম হয়তো । কাজ নিলাম মানুষের বাসায়। দৈনিক মজুরি ৫০ টাকা। আর দুপুরে একবেলা খাওয়াতো আমাকে। প্রথমে আমাকে কাজে নিতে চাননি। আমাদের বাড়ির থেকে খানিকটা দুরে প্রতিবেশী মনতাজ ভাইয়ের কাছে গিয়ে একটা কাজ চাইলাম। আমি খুব ছোটো বলে তিনি প্রথমে আমাকে কাজে নিতে চাইলেন না। যখন আমি বললাম অর্থের অভাব আমি স্কুলে ভর্তি হতে পারছি না, তখন তিনি আমাকে কাজে নিলেন। একটানা ১০ দিন সেই বাসায় কাজ করি । জীবনের প্রথম অর্জিত ৫০০ টাকা নিয়ে স্কুলের পথে হাঁটতে থাকি আমি । বন্ধুর পথে হেঁটে চলা মাধ্যমিক শিক্ষার গণ্ডি পেরুতে অনেকটা বেগ পেতে হয়েছে আমাকে। অভাব অনটন নিত্যদিনের সঙ্গী। সংগ্রাম করতে হয়েছে প্রতিটি দিন প্রতিটি মুহূর্ত। দশ ভাই বোনের মধ্যে আমিই সবার ছোটো। ছোটোরা নাকি একটু বেশি আদুরে। কিন্তু আমার ভাগ্যে সে আদর কখনো জোটেনি। বড়ো ভাইরা বিয়ের পর নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়েন। বাবা বয়সের ভাড়ে খুব একটা কাজ করতে পারতেন না। ২০২০ সালের ২২ আগস্ট আমার বাবা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। বাবা মারা গেছেন এই শব্দটি আমি কখনো ব্যবহার করি না! বাবা আমার কাছে এখনো বেঁচে আছেন! মাঝে মাঝেই বাবার সাথে স্বপ্নে আমি কথা বলি! লেখাপড়ার খরচ চালানোর জন্য মানুষের বাসায় কাজ করতে হতো আমাকে। কাজ করা টাকা থেকো একটা ছাগল কিনে রেখেছিলাম। ছাগলটা বিক্রি করে এসএস সির ফরম ফিলাপ করি । এস এস সি মডেল টেস্ট পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলাম। যার ফলে জরিমানা দিয়ে আমাকে ফরম ফিলাপ করতে হয়। । ২০১৩ সালে এস এস সি পরীক্ষায় মানবিক শাখা থেকে জিপিএ ৪.৫৬ পেয়ে উত্তীর্ণ হই । উচ্চ মাধ্যমিক অধ্যায়ন করবার সুযোগ পাই ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজে। সময় গড়িয়ে যাওয়ার সাথে সাথে আমার পরিশ্রম আরো বাড়তে থাকে। মা- বাবাকে নিয়ে তখন আমার ছোটো সংসার, নিজের লেখাপড়া আর আয়ের উৎস আমি নিজেই। সারাদিন শেষে ক্লান্ত শরীর নিয়েও অনেক রাত অবধি করতে হয়েছে পড়াশোনা। শত পরিশ্রমের মাঝেও ২০১৫ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় মানবিক শাখা থেকে জিপিএ ৪.৩৩ পেয়ে উত্তীর্ণ হই । থমকে যায় স্বপ্নযাত্রা ২০১৫-২০১৬ শিক্ষাবর্ষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা বিভাগ অধ্যায়ন করবার সুযোগ পাই । কোচিং করবার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া পরিচিত বড়ো ভাইদের পরামর্শ নিয়ে কাজের পাশাপাশি পড়াশোনা করেছি। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহদাত ভাই এর কাছ থেকে অনেক পরামর্শ পেয়েছি আমি। কিন্তু আমার ভাগ্যটা সুপ্রসন্ন হয়ে ওঠেনি। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ছ' মাস যেতে না যেতেই খবর পাই বাবা প্যারালাইজড। খবরটা শুনবার পর কিছুদিনের মাঝেই বিশ্ববিদ্যালয়ের মায়া ত্যাগ করে চলে আসি মা বাবার কাছে । কেননা বড়ো ভাইরা সবাই নিজ নিজ অন্য চুলায় আগুন জ্বলান। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজে পরের বছর স্নাতকে ভর্তি হয়ে মা- বাবার কাছেই থাকবো। কয়েকমাস অতিক্রম হবার পর আমার এক বড়ো ভাই আমাকে আবার পড়ালেখা শুরু করবার কথা বললেন। আর মা- বাবাকে তিনিই দেখবেন বলে আশ্বাস দিলেন। আমি একটু ভরসা পেলাম। আমার মায়ের ২৩ টি হাস বিক্রি করে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় আর হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি ফরম নিলাম। এর মাঝে মানুষের বাসায় কাজ করে প্রায় ছ হাজার টাকা সঞ্চয় করেছিলাম আমি । বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ভর্তি পরীক্ষায় ৩৬ তম হলাম । নিজের সঞ্চিত টাকা থেকে ৪০০০ আর দু জন বড়ো ভাই এর কাছ থেকে ৫০০০ টাকা নিয়ে ভর্তি হলাম ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে। কিন্তু ভাগ্যের বিড়ম্বনায় অসুস্থ হয়ে আবারও বিশ্ববিদ্যালয়ের মায়া ত্যাগ করে চলে যেতে হয় আমাকে। একসময় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আর পড়াশোনা করবো না। হতাশায় আত্মহত্যার পথও বেঁছে নিয়েছিলাম। কিন্তু ভাগ্যগুনে বেঁচে গেছি। মা আমাকে অনেক বোঝালেন। এবং কি মমতাময়ী মা পরের বছর থেকে আমাকে আবার নতুন উদ্যমে পড়াশোনা শুরু করতে বললেন। টিউশনির টাকা জমিয়ে বই প্রকাশ আমি দুটো টিউশনি করাই। একটির টাকা জমিয়ে বই প্রকাশ করি আর অন্য টিউশনির টাকা দিয়ে নিজের খরচ চালাই। আমার মনের মধ্যে অসংখ্য গল্পের বসবাস। সেই গল্পগুলোই স্হান দেই বইয়ের পাতায়। আমার প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ' শান্ত মেঘে লুকিয়ে তুই'(২০২০) এবং উপন্যাসিকা ' মৃত্যুর পান্ডুলিপি'(২০২১) পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করে। আমার অন্যতম কবিতা 'অন্য ঘরের বাসিন্দা'(২০২০), 'অভিশপ্ত সময়'(২০২১), 'কাব্যদেবী'(২০২১)। আমার অভিশপ্ত কবিতাটি যেন সহস্র বেকারদের আর্তনাদ।আগামী বইমেলায় আমার প্রকাশিতব্য গল্পগ্রন্থ ' শয়তান গ্রহ'। বাংলা সাহিত্যের প্রতি আমার দূর্বলতা রয়েছে। একটু সময় পেলেই সাহিত্যে রচনায় মনোনিবেশ করি । এর মাঝেও টিউশনির টাকা থেকে প্রত্যেক মাসের বাংলা সাহিত্যের বই কিনি। সাহিত্য পড়বার নেশাটা আমাকে জেঁকে বসেছে। অসংখ্য লেখকের বই ইতিমধ্যে পড়ে ফেলেছি আমি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আমার প্রিয় লেখক। আমি আমার স্বপ্নটাকে ছুঁইয়ে দেখতে চাই। বড়ো হয়ে আমি একটি বৃদ্ধাশ্রম, একটি হাসপাতাল এবং একটি এতিমখানা তৈরি করতে চাই।