"বিজয়ের গল্প"

খাইরুল ইসলাম

দুপুর রোদের তেজ কমেছে তখন। নীল আকাশ কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে যাচ্ছে। প্রিয়ম,প্রিয়াস,প্রিয়াংসু ঠাম্মির সাথে মরিচ জমিতে পাকা মরিচ তুলছে। বিকেল হাত ইশারায় ডাকে। হঠাৎ আকাশ অন্ধকারে ভরে যায়। প্রিয়ম বলে, – ঠাম্মি, কি ব্যাপার, আজ তাড়াতাড়ি সন্ধ্যা নামল? ঠাম্মি মরিচ তোলা বন্ধ করে দাঁড়ায়। কি যেন ভাবে। টুক করে বলে, – কি হল কিচ্ছুতো বুঝছি না নাতি। এখনো বিকেল শেষ হবার কথা নয়। কি জানি কি হল। যাকগে, তোরা মরিচ তুলে নে। বিকেলের শেষে প্রচন্ড গোলাগুলির শব্দে ফেটে যায় গ্রাম। এত গুলির শব্দে গাঁয়ের সবাই ভয় পায়। মনে মনে সবাই বলে পাকসেনারা কি জিতে গেলো এবার। সন্ধ্যা ছুঁইছুঁই। সবাই ঠাম্মির সাথে বাড়ি ফিরে। তখনও গুলির শব্দ থামে না। বাড়ির সবাই ভয়ে কাঁপছে। কারো মুখে কথা নেই। একটু পরে ছোটবাবা বাজার থেকে আসে। মুখে অট্ট হাসি। বড় গলায় সবাইকে উঠোনে ডাকে। ঠাম্মি, বড়মা, মেঝমা, কাকিমা, প্রিয়ম, প্রিয়াস, প্রিয়াংসু সবাই উঠোনে ছুটে আসে। ছোটবাবাকে সবাই ভীষণ ভয় পায়। তাঁর বাড়ি ফেরার শব্দে সবকিছু চুপ হয়ে যায়। তখন পুরো বাড়িতে ভয়ভয় ভাব। কাজে কারো ফাঁকি নেই। যার যে কাজ নীরবে করবে। অদ্ভুত একটি চিত্র। হঠাৎ এভাবে বড় গলায় ডাকায় ভয়ে সবাই একে, ওকে দেখছে। ছোটবাবার চোখে রাগের চিহ্ন নেই। ঠোঁটে অনাবিল হাসি। তখন আবারও গুলির শব্দ কানে বাজে। এবার শব্দ খুবই কাছাকাছি মনে হল। এবার ভয়ে সবাই ঘরে দিকে পা বাড়ায়। ছোটবাবা বড় গলায় বলে, – কিরে,, সবাই ঘরে যাচ্ছ? এখানে ডাকলাম না? সবাই দাঁড়িয়ে পরে। কারো মুখে কথা নেই। সবাই চুপ। ছোটবাবা নিজেই মুখ খোলে। বলে, – মা, কোন ভয় নেই। ভয় পাচ্ছ কেন, এই গুলির শব্দ মুক্তিযোদ্ধার বিজয়ের। পাকসেনারা আত্ম সমর্পন করেছে। দেশ স্বাধীন হয়েছে। জয়বাংলা মা। জয় বাংলাদেশ। সবাই আনন্দ করো মা। এই প্রিয়ম, প্রিয়াস,প্রিয়াংসু সবাই গান কর, জয়বাংলা,জয়বাংলা। পুরো বাড়ি আনন্দের জোয়ারে ভাসে। প্রিয়ম বলে, ছোটবাবা, আমরা শহরে যেতে পারবো? – হ্যাঁরে পারবি। পরশুদিন তোরা সবাই শহরে যাবি। ইশকুল খুলবে লেখাপড়া আবার শুরু হবে। কি আনন্দ তাই না! – হ্যাঁ ছোটবাবা। প্রিয়াস, প্রিয়াংসু, প্রিয়ম বলে। রাতে কানু, শামসু,নুরনবী, দেলোয়ার আরো অনেক মুক্তিযোদ্ধা আসে বাড়িতে। ছোটবাবার সাথে উঠোনে বসে। হাতে ভারী অস্ত্র। সবার চেহারায় আনন্দের ফুলকি। সবার চুল,দাড়ি,লম্বা। শুকিয়ে গেছে সবাই। কতদিন কিছু খায়নি হয়তো। যুদ্ধ চলার সময় ছোটবাবা কতবার মুক্তিযোদ্ধাদের গভীর রাতে ভাত খাইয়েছে। চালডাল,মরিচ, টাকা দিয়েছে। কমান্ডার কানু বলে, – দাদু, আপনার সহযোগীতা না পেলে আমরা সহজে যুদ্ধ করতে পারতাম না। কত কি সাহায্য করছেন ভোলার নয়। -এসব কি বলছ কানু। আমাদের দেশটা স্বাধীন করেছ এটাই বড় কথা। আমিতো যুদ্ধ করিনি কানু। – দাদু যুদ্ধ করেননি কে বললো? মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য,সহযোগিতা করাটাই একটা যুদ্ধ। ক’জন পারে এই কাজটা। আপনি পেরেছেন। আপনিও একজন মুক্তিযোদ্ধা। আজ বিজয়ের দিন। বড় আশা নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা এসেছি আপনার বাড়িতে। আপনি না করতে পারবেন না। – কি বলছ কানু। বল বল কি করতে হবে। নির্ভয়ে বলো। – আজ আমরা সবাই রাতে আপনার বাড়িতে খাব। বিজয় উল্লাস করবো দাদু। – সেতো আনন্দের, ভালো কথা। তবে ভালো তরকারী নেই। ধরো মাছমাংস নেই। যা আছে তা’তে খেতে হবে। তবে হ্যাঁ বাড়িতে নোনা ইলিশ আছে। – ঠিক আছে দাদু, তা’তে হবে। তবে মরিচটা বেশি দিতে হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের দেখে কি আনন্দ প্রিয়ম,প্রিয়াস,প্রিয়াংসুর। সবাই অস্ত্র রেখে পুকুরে স্নান করতে যায়। প্রিয়ম,প্রিয়াস,প্রিয়াংসু অস্ত্রগুলো ধরে। ওরা একটারও নাম জানে না। মুক্তিযোদ্ধা নুরনবী দেখে বলে, – প্রিয়ম কি দেখছ? – অস্ত্র দেখছি। কি সুন্দর। এত ওজন! আচ্ছা এটার নাম কি? – এটা স্টেনগান নুরনবী বলে। – আর এটা, এটার নাম কি? প্রিয়াস, প্রিয়াংসু জিগ্যেস করে। – এটা? এটা হল এস এ লার, আর এটা হল ভারি রাইফেল। – ওম্মা, এগুলো দিয়ে যুদ্ধ করেছ? – শুধু এগুলো নয়। আরো অনেককিছু দিয়ে যুদ্ধ করেছি।এখানেতো সব অস্ত্র নেই। – ইস্ তোমাদের মতো আমরাও যুদ্ধে যেতে পারতাম কি আনন্দ হতো! সবাই আমাদের মুক্তিযোদ্ধা বলে সম্মান করত। – তোমরাতো অনেক ছোট, কিভাবে যাবে বলো! – তোমরা বীর মুক্তিযোদ্ধা, কি সম্মান, দেশ স্বাধীন করেছে। তোমাদের গর্বে আমাদের বাংলাদেশ। প্রিয়ম বলে। প্রিয়াংসু আবছা আলোয় অস্ত্র দেখে হাতে নিতে চায়। পারে না। বারবার চেষ্টা করে। কানু হাতে তুলে দেয়, বলে, এবার নাও প্রিয়াংসু। প্রিয়াংসু হাতে তুলে নেয়। বেশিক্ষণ রাখতে পারেনা। বলে, – বাব্বা এত ভারি? তোমরা এই ভারীঅস্ত্র নিয়ে কিভাবে যুদ্ধ করো। – তুমিতো ছোট। আমার মত বড় হলে তুমিও নিতে পারতে। আগে বড় হও, তবে নিতে পারবে। -যখন বড় হব, তখন আবারও যুদ্ধ হবে? কানু প্রিয়াংসুর হঠাৎ এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না। তবু বলে, আগে বড়তো হও। কারনটা তখনই বোঝা যাবে। তখন ছোটবাবা ডাকে, কানু, নুরনবী,শামসু,দেলোয়ার তোমরা খেতে এসো। কেউ আসে কেউ আসেনি তখন। যখন সবাই একসঙ্গে আসে। সবাই খেতে বসে। কি আনন্দে সবাই লবলব খাচ্ছেতো খাচ্ছে। কারো মুখে কথা নেই। শুধু খাচ্ছে। ছোটবাবা বলে, – খেতে পারছ কানু, নুরনবী নোনা ইলিশ দিয়ে। ছোটবাবার কথা ওদের কারো কানে যায় না। খাচ্ছে, খাচ্ছে। যেন কতদিন খায়নি। খিদায় সবাই শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। ওদের খাওয়া দেখে ছোটবাবার আনন্দ ধরেনা। ঠোঁট কামড়ে হাসে। প্রিয়ম,প্রিয়াস,প্রিয়াংসু ও হাসে।