আমার বিজয়ের গল্প

Md. Fokhrul Islam

লাল নীল হলুদ সবুজের মতো শৈশবেরও একরকম রঙ থাকে। যে রঙে আঁকা হয় সদ্য পৃথিবীর আলোর মুখ দেখা একটি শিশুর তার নিজেরকার শৈশব। মেঘনা নদীর কোলঘেঁষে শিল্পীর রংতুলিতে আঁকা ছবির মতো এক গায়ে জন্ম নেয়ার পর বোধ করি তেমন কোনো রঙেরই অভাব ছিল না। দাদীর কাছে শোনা কথা, আমার জন্মের পর সবাই বলাবলি করছিল, মাশা-ল্লাহ হাওয়া বিবির ঘরে চান্দের লাহান একখান পোলা অইছে। কিন্তু মানুষের এ ঘোর ভাঙতে বেশি দেরি হয়নি। আমাকে নিয়ে তাদের উচ্ছ্বাস আকাশে শঙ্খচিলের মতো ডানা মেলার আগেই ফুটো বেলুনের মতো চুপসে যায় একসময়। এমন হবেই না বা কেন! সোনা বাঁকা হলেও তা সোনাই থাকে। কিন্তু খুঁতওয়ালা মানুষ যত সুন্দরই হোক না কেন, তা খুঁতকে কখনো আড়াল করতে পারে না। দুই থেকে আড়াই বছর বয়সের মধ্যেই শিশুরা ভাঙা ভাঙা শব্দে জড়ানো গলায় তাদের প্রথম কথা বলা শুরু করে। কিন্তু উপযুক্ত সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরেও যখন আমার মুখে কথা ফুটে না, তখন গ্রামের সবাই বলাবলি শুরু করে, হায়রে হাওয়া বিবির এমন রাজপত্রের মতো পোলাডা শেষমেশ কিনা বোবাকালা হইলো। আফসোস। বড়ই আফসোস। কিন্তু নাহ, বোবা হইনি। সবাইকে অবাক করে দিয়ে বেশ দেরীতে হলেও একসময় মুখে কথার ফুল ফুটে। কিন্তু নেটওয়ার্কে গোলমাল হলে যে রকম বাফারিং হয়, কথা আটকে আটকে আসে, আমার কথাও তেমন জড়িয়ে যাচ্ছিল। পরে সবাই বুঝতে পারে, হাওয়া বিবির পোলার কথায় গন্ডগোল আছে, অর্থাৎ তোতলা সে। ইংরেজিতে যাকে বলে, ‘স্পিকিং ডিসঅর্ডার’। এরপর সবাই যখন বাবা-মায়ের আকিকা দিয়ে রাখা সুন্দর নামটা কেটে সে জায়গায় তোতলা ট্যাগটা বসিয়ে দেয়, তখন নদীর বুকে শিকারীর খুঁজে বিরামহীন উড়তে থাকা চিলেরও বুঝতে বাকি থাকে না যে, এটা শুধু নিছক সমস্যা নয়, অভিশাপও বটে। একটি শিশুর বয়স চার কিংবা পাঁচ পেরোলে কেউ না কেউ তার হাতেখড়ির দায়িত্ব নেয়। প্রথম শিক্ষাটা পরিবারের কাছ থেকেই পায়। অতঃপর যখন বয়স আরেকটু বাড়ে তখন স্কুলের সাথে পরিচয় ঘটে। কিন্তু আমি তোতলা হয়ে জন্মানোর দোষে নিদারুণ অবহেলায় হাতেখড়ি কিংবা স্কুল কোনটারই দেখা পাইনি সেই বয়সে। লোকে আমার বাবাকে এসে বলতো, ওরে লেহাহড়া হিগায়া কি করবা মিয়া? তারচেয়ে ভালা হয় আরেকটু বয়স অইলে একটা জব্বর দেইখা কামে লাগায়া দাও। গতর খাইটা অন্তত দুইডা পয়সা কামাই করতে পারব। কিন্তু আমার বাবা মানুষের কথায় ভেতরে ভেতরে কষ্ট পেলেও হাল ছেড়ে দেননি। তিনি অতিউৎসাহী ও পরচর্চাকারী ঐ লোকদের বলতেন, তোতলা হইছে দেইখা কি পড়ালেহা হিগতে পাইরবো না? এইডা কেমুন কথা মিয়ারা। বোবারাও তো পড়ে, তাইলে আমাগো ফখর মিয়া ক্যান পাইরব না। জন্মের পর থেকে এই সমস্যা নিয়ে একজন মানুষেরই সাহায্য পেয়েছি, তিনি আর কেউ নন, আমার হতভাগা বাবা। তার মনে হয়ত এই আশা ছিল যে, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার বাপধনও সুন্দর করে কথা বলতে পারবে। যার জীবনের শুরুটা আর দশটা শিশুর চেয়ে আলাদা ছিল, তার বিদ্যার প্রথম পাঠও ভিন্নরকম হবে এটাই স্বাভাবিক। আমাকে নিয়ে বাবার একরাশ স্বপ্ন ছিল, তার চেয়ে বেশী ছিল মানুষকে দেখিয়ে দেওয়ার খেদ। আর তাই যতদূর সম্ভব চেষ্টা করে গেছেন। বাড়ি থেকে বেশ দূরে প্রায় কয়েক কিলোমিটার পথ পেরোলে শহরের দিকে যাওয়ার মূল সড়ক। প্রতিদিন কাক ডাকা ভোরে, বাবা আমাকে নিয়ে ছুটতেন সেই সড়ক পানে। সড়কের দুইধারে সারি সারি করে বিছানো গাছের গুঁড়ির ওপর গিয়ে বসতাম আমরা। তারপর পিচঢালা রাস্তাকেই আস্ত স্লেট বানিয়ে ইটের টুকরো কুঁড়িয়ে নিয়ে সেখানে একের পর এক বর্ণমালা ফুটিয়ে তুলতেন। এরপর বলতেন, এই হইল গিয়া অ, আর এই যে এইটা দেখতাছোস না, এইটা আ। কি বল বল? আরে বেটা চেষ্টা তো করবি। আমরা মুর্খ হইছি দেইখা তুইও কি আজীবন মুর্খ থাকবি? তারপর আবারও সকালবেলার মক্তবের হুজুরের মতো সুর করে বলতেন, অ, আ, ক, খ। এরপর আমিও সুর করে টেনে বলার চেষ্টা করতাম। কারণ তখনও স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারতাম না। তাই টেনে টেনে বললে তবুও একটু-আধটু পারতাম। এরপর এগুলো শেখানো হলে ইংরেজী বর্নমালা এ, বি, সি, সি, ডি একই কায়দায় রপ্ত করাতেন। এভাবে একে একে সবগুলো বর্ণমালার সঙ্গে সখ্যের পর আমাকে দিয়ে সেগুলো লেখারও চেষ্টা করাতেন। আমি ইটের টুকরা দিয়ে আঁকিবুকির চেষ্টা করতাম। হচ্ছিল না দেখে বাবা প্রথম প্রথম আমার হাতের ওপর নিজের হাত রেখে ঘুরাতেন। এভাবে একসময় লেখতেও শিখে যাই। বাবা চলন্ত গাড়িকে দেখিয়ে বলতেন, বলতো গাড়িটার নাম কি? আমি চোখ বড় করে তাকিয়ে কয়েকবার ঢোক গিলে ভয়ার্ত গলায় বলার চেষ্টা করতাম। বাবা মুচকি হেসে বলতেন, বড়ই খুশি করলিরে বাপ। চল আজ তোরে রহিমের দোকান থেকে মালাই খাওয়ামু। ইটের টুকরাকে চক আর রাস্তাকে স্লেট বানিয়ে বর্ণমালা শেখার পর তারপর শুরু হয় আমার প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনার যাত্রা। ততোদিনে বাপ-বেটা মিলে শব্দ করে জোরে পড়তে পড়তে মুখের জড়তাও কেটে গেছে অনেকটা। গ্রামের স্কুল থেকে প্রাইমারি তারপর উপজেলার কলেজ থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক এবং সর্বশেষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রাজুয়েশনও শেষ করি। একসময় স্রেফ কথার জড়তার কারণে যার জীবন থমকে গিয়েছিল, ভাবতে পারেন, এখন সে মানুষটিই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে টেলিভিশন সাংবাদিকতাকে। প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে এতটা পথ পাড়ি দেয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় কারিগর আমার বাবা। আর এটাই আমার বিজয়ের গল্প।