এখন চিলবিলদের সময়

শাবলু শাহাবউদ্দিন

বেশ কয়েক সপ্তাহ পরে মোহাম্মদ শুফম বাড়ি ফিরছে। সপ্তাহ কয়েক আগে শুফম হঠাৎ করে এলাকা থেকে বাজপাখির মত উধাও হয়ে যায়। কেউ তার খোঁজ খবর জানে না। আজ আবার সকালে সবাই তাকে দেখতে পায়। সেই চিলবিল প্রধানের ছেলে। চিলবিল প্রধান গ্রামের মোড়ল। কোন এক সময় ডাকাতদের সর্দার ছিল চিলবিল প্রধান। ডাকাতদের সর্দার থেকে এখন গ্রামের প্রধান হয়েছে। গ্রাম প্রধান হওয়ার পিছনেও একটা কারণ আছে। তিনি যখন ডাকাত ছিলেন তখন এই গ্রামের প্রধান ছিল মলয় ঠাকুর। দেশ ভাগের পর ঠাকুর পরিবারের অনেকেই দেশ ছেড়ে চলে যান কিন্তু মলয়ের পিতা গ্রামের প্রধান হিসেবে দেশ ছাড়তে পারে না। কালক্রমে সেই গ্রাম প্রধানের দায়িত্ব আসে মলয় ঠাকুরের উপর। এই মলয় ঠাকুর গ্রাম প্রধান থাকা কালে চিলবিল ডাকাতকে ডাকাতের অভিযোগে গাছে বেধে পিটিয়ে ছিল। যে ব্যাথায় চিলবিল প্রধান এখনো আমাবস‍্যার রাতে পোয়াতি মহিলাদের মত গঙরাইতে থাকে। হঠাৎ করেই চিলবিল ডাকাতি ছেড়ে রাজনৈতিক দলে নাম রাখেন। সাহস থাকার কারনে অল্প দিনে সে দলের ভালো জায়গায় উঠে যায়। দলের জন্য সব জায়গায় সম্মান পেলেও গ্রামের কেউ সম্মান করে না তাকে; শুধুমাত্র মলয় ঠাকুরের জন্যে। এই ঠাকুর তার সম্মানের একমাত্র পথের কাটা। অবশেষে সে দলের সিদ্ধান্তে মলয় ঠাকুরকে হত্যা করে। পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যায় চিলবিলকে। ঠিক তিন মাসের মাথায় দলের কল‍্যাণে সে জেল থেকে মুক্তি পায়। গ্রামে ফিরে এসে দেখে যত টাকাওয়ালা হিন্দু ছিল সব দেশ ছেড়েছে পালিয়েছে চিলবিল ডাকাতের ভয়ে। চিলবিল ঐ সকল হিন্দুদের সমস্ত জমি-জমা দখলে নিয়ে এখন সে এই বাদুপুর গ্রামের রাজা বলা চলে। সেই সময়ে গ্রামের উচ্চবর্ণের সকল হিন্দু গ্রাম ছাড়লেও নিচু বর্ণের হিন্দুরা গ্রাম ছেড়ে ছিল না। কারণ তারা ভেবে ছিল, আমরা গায়ে খেটে খাওয়া মানুষ, আমাদের অর্থ নেই, সুতরাং কেউ কিছু বলবে না। কিন্তু তাদের তো এক টুকরো বসত ভিটা আছে। তাতেই বর্তমানে চোখ পরেছে চিলবিলের। নিচুবর্ণের হিন্দুদের প্রধান হল হরিদাস। তার একটা ডাগর কন্যা আছে। নাম আবার শুফমা দাস। যেমন সুন্দরী তেমনি মাথায় ভগবান চুল দিছে। এ যেন স্বয়ং মা লক্ষ্মী। চিলবিল প্রধানের মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। তার ছোট্ট বউয়ের সন্তান মোহাম্মদ শুফম কে কাজে লাগানো যেতে পারে। সে শুফম কে বুদ্ধি ছিল হরিদাসের মেয়ে শুফমাকে পোটাইতে (প্রেম) হবে। বাকি টুকু আর শুফমকে বোঝায়তে হল না। সে নিজেই বুঝে গেলো। শয়তানের বাচ্চা শয়তানই হয়। তাই তারা পু পু করলে আগে থেকেই বুঝে যায় পুঁটি মাছ হবে। বাবার পরামর্শ অনুযায়ী সে শুফমার সাথে প্রেমের বাহানা শুরু করে দেয়। শুফমা পাত্তা না দিলেও দিনে রাতে সে, হরিদাসের বাড়িতে ঘুর ঘুর করতে থাকে। আজ কাল সবাই জানে শুফম-শুফমা নতুন যুগের লাইলি-মজনু। বাস্তবে না হলেও গ্রামে এটাই প্রচার হয়েছে। হঠাৎ শুফম উধাও। কেউ বলতে পারে না সে কোথায়। ধীরে ধীরে শুফমের পিতা চিলবিল প্রধান হরিদাসের উপর চাপ সৃষ্টি করে। চিলবিল প্রধান হরিদাসের নামে পুলিশে মামলা দেয় এই বলে যে, হরিদাসের মেয়ের সাথে তার ছেলের সম্পর্ক থাকার কারণে হরিদাস তার ছেলেকে গুম করেছে। এরই মধ্যে অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ এসে হরিদাসকে ধরে নিয়ে যায় থানায়। দুই দিন পরে হরিদাসকে পুলিশ ছেড়ে দেয় অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করে। হরিদাস বাড়িতে ফিরে এসে দেখে, তার মেয়ে খুব অসুস্থ। সকালে হোমিওপ্যাথি ডাক্তার রহমান আলি একবার এসেছিল। সেও এক কসাই। টাকা ছিল না বলে ওষুধ দেয় নাই। হরিদাস আসার পরে আবার এসেছে। হরিদাস বড় আশ্চর্য হল। সকালে ডাক্তার ঘুরে গেছে, ওষুধ না দিয়ে চলে গেলো; আবার হঠাৎ দুপুরে আবার কেন আসলো। কই কাউকে তো ডাক্তারকে ডাকতে পাঠানো হয় নাই। সে যাইহোক, ডাক্তার এসেছে ভালোই হয়েছে। ডাক্তার তিন ঢোস ওষুধ দিয়ে গেছে। এক ঢোস খাওয়াতে না খাওয়াতে শুফমা সুস্থ হয়ে উঠলো। রাতের ঢোস ওষুধ যেই খাওয়েছে তখন থেকে শুফমার হালকা পেটে বেদনা শুরু হয়েছে। সকাল অবধি বেদনা ছিল। সাথে বমি বমি ভাবও ছিল। সে যাইহোক সকাল বেলা আবার যেই তৃতীয় ঢোস ওষুধ খাওয়ানো হল শুফমার পেটের বেদনা আবার একটু ভালো। সকাল সকাল হরিদাসের চিলবিল প্রধানের সাথে দেখা হয়ে গেলো। চিলবিল নিজেই ডাক দিয়ে কথা বললো হরিদাসের সাথে। শোন হে হরিদাস মসাই; আমি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি। আল্লাহ্ওলা মানুষ বলতে পারো। কথায় আছে এক কালে বেশ্যা, অন্য কালে তবিশ্যা। তোমরা সবাই জানো আমি বহু বছর হল কোন অন‍্যায় কাজ করি না। এমনকি সহ‍্যও করি না। ইহাতে আল্লাহ্ রহমত আমি অনেক পেয়েছি। আল্লাহ্ আমার মনের কথা বোঝেন এবং শোনেন। তার ইশারায় আমি সব করি। তিনি চান না, তোমার সাথে অন্যায় কিছু হোক। তুমি আমার ছেলে কে গুম করলেও তাঁর ইশারায় আমি আমার ছেলের সন্ধান পেয়েছি। - না। আমি আপনার ছেলেকে গুম করি নাই। ভগবান সাক্ষী আছে। - হরিদাস, রাখ তোমার ভগবান। আমি যা বলি তাই আগে শোনো। আমার আল্লাহ্ চান তোমার মেয়ের সাথে আমার ছেলের বিয়ে হোক। আমি আমার আল্লাহ্ আদেশ পালন করতে বদ্ধপরিকর। তোমার মেয়েকে আমার ছেলে বিয়ে করলে পরকালে আমার ছেলের কপালে বেহেশত নসিব হইবে। এছাড়াও তোমার মেয়ের পেটে আমার ছেলের বাচ্চা আছে। স্বচক্ষে গত রাতে তুমি তা দেখেছো। তোমার মেয়ের পেটে সন্তান এসেছে বলেই সারা রাত তার পেটে বেদনা ছিল এবং বমি বমি ভাব ছিল কিন্তু! কী ছিল না? - হমমম ছিল। - ওকে হতাশ হওয়ার কিছুই নেই। আমি তোমাকে বুদ্ধি দেই। আশা করি আমার কথা মত কাজ করবে। শোন তুমি হিন্দু। মেয়ে নিয়ে জানি পালিয়ে যেতে পারবে। কিন্তু যেখানেই যাও কেউ তোমাদের মেনে নিবে না। কারণ তোমার অবিবাহিত মেয়ের পেটে বাচ্চা আছে। ডাক্তার নিজে আমাকে বলেছে। সে যাইহোক। তোমাকে তোমার মেয়ে নিয়ে ভাবতে হবে না। আজ সন্ধ্যায় তুমি ও তোমার স্ত্রী কাউকে কিছু না বলে এলাকায় ছেড়ে চলে যাবে। এমনকি তোমার মেয়ে কেউ কিছু বলবে না। কালকে সকালে আমার ছেলে ফিরছে। আমার ছেলের সাথে তোমার মেয়ের বিয়ে হবে। তোমরা থাকলে এ বিয়ে আইনি জটিলতার কারণে আমি দিতে পারবো না। কথা শেষ করে চিলবিল প্রধান হাটতে শুরু করে। হঠাৎ কেমন যেন তার মনে খোটকা জাগলো। হরিদাস যাবে তো? তাই সে পকেট থেকে পাঁচ হাজার টাকা বের করে হরিদাসের উদ্দেশ্য হাত বাড়িয়ে দিল। হরিদাস হাত বাড়িয়ে পাঁচ হাজার টাকা নিল। ইহাতে চিলবিলের মনে আনন্দ ধরে রাখতে পারলো না। আবেগের বসতে সে বাম পকেট থেকে আরো তিন হাজার টাকা হরিদাসকে দিয়ে বিদায় নিল। হরিদাস টাকা নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। "ও আমার দেশের মাটি তোমার উপর ঠেকাই মাথা" সন্ধ্যায় হরিদাস ও তার স্ত্রী চলে গেলেন অসুস্থ মেয়েকে বিছানায় ঘুমায়ে রেখে। রাত শেষ। আবার আজ থেকে শুফম গ্রামের মেঠো পথে হাটছে। ২. অনেক বছর পরে হরিদাস তার মেয়েকে দেখার জন্য একবার বাদুপুর গ্রামে আসে। সেই রহমান আলি ডাক্তারের সাথে তার প্রথম দেখা হয়ে যায়। ডাক্তার হরিদাসকে দেখে হাও মাও করে কেঁদে উঠে। সে সব খুলে বলে। তার মেয়ের পেটে কোন বাচ্চা ছিল না। সব ছিল চিলবিল প্রধানের ষড়যন্ত্র। চিলবিলের কারণে সেই পেটের বেদনাদায়ক ঐ ধরনের ওষুধ দিছিল তার মেয়েকে। চিলবিল প্রধান সেই মাসেই মারা গেছে এবং তার ছেলে শুফমও গেছে। আমার তিন সন্তান ছিল তারাও মারা গেছে। আল্লাহ্ আমাদের উপর গজব নাজিল করেছিল হরিদাস; গজব নাজিল করেছিল। -আমার মেয়ে এখন কোথায়? তোমার মেয়েকে সেই রাতেই, চিলবিল বালিশ চাপা দিয়ে মেরে, নদীর পানিতে ভাসিয়ে দেয় ভেলায় করে। পরের দিন সন্ধ্যার সময় চিলবিলের ছেলে নদীতে মাছ ধরতে নামে ঠ‍্যালা জাল দিয়ে। কচুরিরপানার মধ্যে জাল ঠ‍্যালতেই জাল আটকে যায়। আমি নদীর তীরে তখন দাঁড়িয়ে ছিলাম। শুফম আমাকে ডাক দিয়ে কাছে নিয়ে যায়। দেখছেন কাকা কচুরির নিচে মনে হচ্ছে বড় মাছে আছে। জাল টেনে উঠাইতে পারছি না। কচুরিপানা সরাইতে কলাগাছের ভেলা বের হয়ে আসে। শুফম রাগ করে কলাগাছের ভেলা উল্টায়ে দেয়। ভেলা উল্টানোর সাথে সাথে ভেলা সাথে বাধা তোমার মেয়ের লাশ বের হয়ে আসে। শুফমের দিকে মা দুর্গার মত করে চেয়েছি তোমার মেয়ে। শুফম ভয়ে চিল্লাইতে চিল্লাইতে বাড়ি ফিরে আসে। লাশ সহ ভেলাটি আমি নিজ হাতে আবার উল্টায়ে দেই। ভেলার উপর কচুরি ছিটিয়ে দেই। শুফম বলছিল, ও আমাকে ডাকছে। এই বাক‍্যেই ওর শেষ বাক‍্য ছিল। ছটফট করে তাজা মাছের মত লাফাইতে লাফাইতে মারা গেল ছেলেটি। রাতে কত লোক নদীর ধারে এসেছিল সেদিন রহস্য উৎঘাটনের জন্য। কিন্তু ততখনত্ব ভাটার পানিতে ভেলা সহ কচুরি পানা দক্ষিণে চলে যায়। তার তিন দিন বাদে চিলবিল নদীতে নামে। নদী থেকে সে আর ফিরে আসে না। কে জানে, চিলবিল এখন সে কোথায়। এমন হাজারো চিলবিল বাংলার আকাশে বাতাসে দিবারাত্রি ঘুরছে। কত চিলবিল আছে এই সোনার বাংলায় কে রাখে তার সন্ধান। হাজার চিলবিল হায়না রূপে স্থান করে নিয়েছে নানা দলে। রয়েছে মহা সুখে। এখন চিলবিলদের সময়।