Jarin Atia Kakon
বিজয় তিন বর্নের শব্দ,তবে এর সন্ধান পাওয়া মোটেই এক দুই তিনের ব্যাপার নয়। সারাটি জীবন ধরেই আমরা বিজয়ের সন্ধানে ছুটে চলি। কখনো তার দেখা পাই,কখনো-বা সবুর করি।বিজয় অর্জনের চেয়ে একে ধরে রাখার সক্ষমতাই মূলত প্রকৃত বিজয়। আমার জীবনে যেকয়টি বিজয় ধরা দিয়েছিল সবই ছিলো আল্লাহর অশেষ রহমত এবং আমার মা বাবার দোয়ায়। ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকতে ভালোবাসতাম।কিন্তু কোনো প্রতিযোগিতায় যাওয়ার মত সাহস আমার ছিলো না।একবার এক প্রতিযোগিতায় গেলাম,তবে প্রতিযোগিতা করার অভ্যাস না থাকায় নির্দিষ্ট সময়ে শেষ করতে পারলাম না।এরপর মনোবল আরো ভেঙে যাওয়ায় বহু বছর কোনো প্রতিযোগিতাই করিনি। হঠাৎ ২০১১ তে ১৭ মার্চ জাতির জনক বংগবন্ধু শেখ মুজিবের জন্মদিন ও শিশু দিবসে স্কুলে আয়োজিত হয় চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা। আঁকতে হবে মুক্তিযুদ্ধ।বাড়িতে একা বসে বসে যুদ্ধের ছবি আঁকতাম ঠিকই,তবে প্রতিযোগিতায় যাওয়ার সাহস কিছুতেই হচ্ছিলো না।তারপর আমার বড় বোন ও মা বাবার অনুপ্রেরণায় এক পর্যায়ে চলেই গেলাম যুদ্ধের ছবি আঁকতে। পুরষ্কার বিতরনের সময় আচমকা আমার নাম টা শুনে সেদিন থেকেই শুরু হয়েছিল আমার চিত্রাংকনের সাহসী যাত্রা।এরপর থেকে আর কোনো প্রতিযোগিতায় যেতে আমার এক বিন্দু ভয় হয়নি এবং এমন কোনো প্রতিযোগিতা নেই যেটায় আমি পুরষ্কার বঞ্চিত হয়েছি।অনুসন্ধানে ছুটে চলতাম কোথাও কোনো চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা হচ্ছে কিনা। ক'দিন পরে জেলা পর্যায়ে আয়োজিত হয়েছিল আরেকটি চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা।আমাদেরকে বলা হলো এত বড় মাপের প্রতিযোগিতায় আমাদের সকলকে অংশগ্রহন করতে দেয়া হবে না,স্যার বাছাই করে পাঠাবেন কারা যাবে আর কারা যাবেনা।আঁকতে হবে "আমার স্বপ্নের খামার"।আবার শুরু হয়ে গেলো দিনরাত খামার আঁকার নেশা,আমাকে সিলেক্ট হতেই হবে।সিলেক্ট হয়েও গেলাম এবং সেবার পুরো জেলায় আমি প্রথম স্থান অধিকার করি।অথচ আমার ছবি আঁকায় ছিলোনা কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণীয় শিক্ষা। আবার মনের জোর আরো বেড়ে গেলো। প্রতিটি প্রতিযোগিতায় আমার মা বাবা আর বড় বোন কিভাবে পাশে থেকেছে সেকথা না বললে নয়।পরেরবার একই প্রতিযোগিতার সময় আমার টেস্ট পরীক্ষা ছিল।কিন্তু আমি কিছুতেই প্রতিযোগিতা হাতছাড়া করবোনা।স্যারকে বলে রাখলাম আমি পরীক্ষা দিয়েই চলে যাবো প্রতিযোগিতা কেন্দ্রে। আমার জন্য সেবার ১০ মিনিট পরে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল যা ছিল একজন প্রতিযোগী হিসেবে অনেক গর্ববোধের জায়গা। তখনো পুরষ্কার হাতছাড়া হয়নি। তারপর ডিসেম্বরে জয়নুল আবেদীনের ১০০ তম জন্মবার্ষিকীতে আয়োজিত হয় আরেকটি চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার।সেখানে গিয়ে দেখি সব প্রশিক্ষন প্রাপ্ত জল রঙের ক্ষুদে চারুশিল্পীরা এসেছে প্রতিযোগিতা করতে। আর আমিই শুধু প্রশিক্ষন বিহীন প্যাস্টেলে আর্ট করি,তবুও আমার মত করে এঁকে এলাম।আমার খুব মন খারাপ হলো। আমি ভেবেই নিলাম এবার তো আর পুরষ্কার পাওয়া হবেই না।বিকেলে ফলাফল শুনতেও যাবো না।মা বললো চলো গিয়ে দেখি কি হয়,আমি তো কোনো ভাবে যাবোই না। বাসায় খুব কান্নাকাটি করলাম পুরষ্কার পাবো না বলে। তবু মায়ের জোরাজোরিতে কোনোমতে রেডি হয়েই চললাম মায়ের সাথে।সব প্রতিযোগী এক সাথে সামনের দিকে। আর আমি এক কোনায় মন মরা হয়ে বসে আছি পুরষ্কার তো পাবোই না,তাই লজ্জায় সামনেই গেলাম না।আলোচনা সভা শেষ হলে এবার পুরষকার বিতরনীর পালা।নিজেকে সামলে নিলাম যেন খুব মন খারাপ না হয়।কিন্তু একি!! শুরুতেই আমার নাম মাইকে ডেকে উঠলো।আর আমি তো এক দৌড়ে স্টেজে...... সেটি ছিল আমার জীবনের সেরা পুরষ্কার।এক সাথে এত উপহার আমি কোনো প্রতিযোগিতায় পাই নি।সব সময়ই মনে হয় ভাগ্যিস মায়ের সাথে গিয়েছিলাম সেদিন বিকেলে.... এরপর আমার মনোবল এত বেড়ে গিয়েছিল যে আমি আমার এস এস সি পরীক্ষার মাঝেও অংশগ্রহন করেছিলাম ছবি আঁকার লড়াইয়ে,এবং আল্লাহর অশেষ রহমতে সফল হয়েছিলাম আমার এস এস সি পরীক্ষা এবং প্রতিযোগিতা দু'টোতেই। যেই আমি এক সময় প্রতিযোগিতায় নিজেকে উপস্থিত করতেই ভয় পেতাম সেই আমি আল্লাহ তা'আলার অশেষ রহমতে জীবনের যেকোনো পরিস্থিতিতে থেকেও আমার প্রিয় কাজ ছবি আঁকায় অংশগ্রহণ করে জয়লাভ করেছি। আমার জীবনের বিজয়গুলোর সাথে আমার পরিবারের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। আর আমি সেই বিজয় ধরে রেখেছি আমার মাঝে।এখন বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে হয়তো আর ছবি আঁকার প্রতিযোগিতা হয়না,তবে দেয়ালে দেয়ালে বন্ধুদের সাথে ছবি এঁকে আমরা ক্যাম্পাসকে সাজিয়ে তুলি।হয়তো পুরষ্কার পাইনা,তবে আমাদের আঁকা ছবিগুলোর পাশে দাঁড়িয়ে যখন সবাই এসে ছবি তোলে,সেখানেই নিজের পুরষ্কার খুঁজে পাই। সময়ের সাথে সাথে এভাবেই আমার বিজয়কে রূপান্তর করেছি আরেক বিজয়ে। ❤️