প্রিয় বাবা আর এক টুকরো বাস্তবতা!

Myeesha Rahman

শীতের কনকনে হাওয়ার মতো মনটাও হুটহাট যেন শীতলতায় আচ্ছন্ন হয়ে আসে। বটবৃক্ষের মতো মাথার উপর যার ছায়া হয়ে থাকার কথা সেই প্রিয় মানুষটাকে ছাড়া গুণে গুণে চৌদ্দটি বছর পেরিয়ে গেলো! কেবল দশে পা দেওয়া স্বপ্নময় কৈশোর ঘিরে শুরু হয়েছিল পিতৃহীন এক নতুন সংগ্রাম। এটা সংগ্রামও নয়। এটা একটা চাপা বেদনা, যার কোনো ভাগ হয় না, যেই শূন্যস্থান পুরণের কোনো বিকল্পও থাকে না। অথচ মাধ্যমিকের শুরুটাই হয়েছিল সেই দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে। তার উপর বাঙ্গালী মধ্যবিত্ত পরিবার। এই শ্রেণীর প্রতিটা সন্তান জানে এই বেদনার সাথে নতুন করে যোগ হওয়া কষ্টের পরিমাণ কতো বিস্তৃত হতে পারে৷ আপন মানুষেরা রঙ বদলে নিল। যারা চেনা ছিল, তারা অচেনা হলো। যারা স্নেহ দিতে কাছে আসার কথা ছিল, তারা দূর থেকে দূরে হারিয়ে যেতে লাগলো। জীবনটা ঘিরে পিতা হারানোর কষ্টের সাথে যোগ হয় আপন মানুষের বদলের যাওয়ার কষ্ট! বটবৃক্ষের ছায়া আর আশ্রয়ে বেড়ে ওঠা প্রাণগুলোকে তখন নতুন করে জীবনের সংগ্রাম শিখতে হয়। আমিও শিখেছিলাম৷ পিতৃছায়া হারানো প্রাণটাকে মাতৃছায়ায় নতুন করে বাঁচতে শিখতে হলো৷ মাধ্যমিকটা কেটে গেলো লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে। অধিকারের লড়াই। শুরু হলো উচ্চমাধ্যমিকের পড়াশোনা। মায়ের ছত্রছায়ায় পড়াশোনা থেমে থাকেনি। এটাই যেন একটা লড়াই। যেভাবেই হোক পড়াশোনাটা শেষ করতে হবে, স্নাতক সম্পন্ন করাটাও একটা চ্যালেঞ্জ তখন। এই চ্যালেঞ্জে জিততেই হবে। তবেই না বাবা-মায়ের স্বপ্ন পূরণ হবে! কিন্তু জীবনে চড়াই-উতরাই পেরোনো এতো সহজও নয়। মোটামুটি মানের একজন ছাত্রী। উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্ট আহামরি না হলেও ভাল কোথাও চান্স পাওয়ার মতো। কিন্তু বিধিবাম! কোনো পাবলিকেই চান্স হলো না, হলো না কোনো মেডিকেলেই। কিন্তু প্রাইভেটে পড়া তো দুঃস্বপ্নের মতো। মনে মনে শুধু একটাই প্রার্থনা- স্রষ্টা সহায় হোক। চোখ বন্ধ করে সরকারি কলেজ আর ন্যাশনালে এপ্লাই করা হচ্ছে, পাশাপাশি পড়াশোনা। এবার পরিশ্রম সার্থক হলো। সেকেন্ড টাইমের জন্য আর অপেক্ষা করতে হলো না। পড়াশোনা আর পাশাপাশি চলছে স্কিল ডেভেলপমেন্ট এর জন্য নানান কোর্স। ১ম বার্ষিকে ২য় স্থান অধিকার করাটা তখন স্বপ্নের মতো ছিল। তাও আলহামদুলিল্লাহ এটাও একটা অর্জন। মায়ের এতো বছরের কষ্টের ফসল। এভাবেই কেটে গেলো চার চারটি বছর। ১ম দু'বছর মন দিয়ে পড়াশোনা করলেও নিজের জন্যই চাকরি জীবনের শুরু তখনই। মায়ের বোঝা এবার হালকা করার সময় এসেছে। নিয়মিত ক্লাসে উপস্থিত থাকা আর সম্ভব হয় না। জীবনটাকে নতুন করে উপলব্ধি করা শুরু হলো। কাছের বন্ধুরা তখন এক একজন আরো আপন হয়ে উঠলো। ক্লাস উপস্থিত হতে না পারা এই বান্ধবীকে তারা প্রতিদিনের লেকচার, প্রয়োজনীয় সাজেশন, নোটস দিয়ে সাহায্য করতে লাগলো নিঃস্বার্থভাবে। একে তো পড়াশোনা করার সময় হয় না, তার উপর বার্ষিক পরীক্ষা আসলেই শুরু হয় অসুস্থতার ঝড়। জ্বরের ঘোরে তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষায় কোনোমতে উত্তীর্ণ হলাম। চতুর্থ বর্ষে ইচ্ছে ছিল আরেকটু ভাল করে পরীক্ষাটা দেওয়ার। ইনকোর্স পরীক্ষাগুলোতে সকালে ডিউটি করে দুপুরে পরীক্ষা দিতে যাওয়া লাগতো। আর বার্ষিক পরীক্ষা জুড়ে ইনফেকশনের ব্যথায় পড়াশোনা করা হয়ে উঠলো না। ছুটিও মিললো না দায়িত্ব থেকে। কোনো রকম পড়াশোনা করে পরীক্ষা দিয়ে একটাই আশা - পাস করা কপালে থাকলেই হলো। অবশেষে মায়ের সংগ্রাম সার্থক হলো। মেয়ে তার স্নাতক পরীক্ষায় ভালই ভালো উত্তীর্ণ হয়েছে, দশের মধ্যে তার আদরের সোনামণির মেধাস্থান। এতোদিনের আশা তার পূরণ হয়েছে। এখন বাবার আর একটা স্বপ্ন পূরণ বাকি। তার আদরের ছোট মেয়েকে আরো অনেক বছর পড়াশোনা করতে হবে, নিজেকে ঘিরে একটা সুন্দর জীবন গড়তে হবে, যেন আকাশ জুড়ে মিটিমিটি জ্বলে উঠা তারার আড়ালে বাবা তার মেয়েকে দেখে একটু শান্তির নিশ্বাস ফেলে; তাকে হারানোয় ব্যথায় আদরের কন্যা ভেঙ্গে পরেনি, উঠে দাঁড়িয়েছে, পরিশ্রম করেছে, স্বপ্ন পূরণ করেছে, তার সহধর্মিণীর ছত্রছায়ায় এখনও টিকে আছে নিশ্চিন্তে। চিরঘুমের দেশে এটুকু আশ্বাস নিয়ে প্রিয় বাবা শান্তিতে থাকুক, নিশ্চিন্তে থাকুক।