কাজী নিশান(Al amin)
"মরীচিকা " "বিজয়" শব্দটা যতোটা সহজ অর্জন করা ততোই কঠিন। বিজয় অর্জন করতে অদম্য হতে হয়। ছুঁটতে হয় মরিচীকার পিছু। পার হতে হয় সহস্র বাঁধা বিপত্তি। হতে হয় বধির। কেননা সমাজের শত কোটি ব্যর্থ সহস্রাধিক অলস মস্তিষ্ক রয়েছে পিছু টেনে ধরতে। তখন সবে HSC শেষ করেছি। অনেকদিনের পরিশ্রম, ক্লান্তি ভুলে বন্ধুদের সাথে রাতে দিনে আড্ডা ঘুরাঘুরিতে ভালোই দিন কাটছিল। ক্লাসের সব থেকে ভালো স্টুডেন্ট সাকিব জানালো সে ভার্সিটি এডমিশন এর জন্য কোচিং করছে। ফি বাবদ প্রায় দশ হাজার নিচ্ছে। এটা শুনে স্রেফ না বলে দিলাম। আমাকে দিয়ে হবে না, সুতরাং মধ্যবিত্তের সংসারে এতোটা রিস্কে কিভাবে ফেলব পরিবারকে। তবে বাবা-মা তো আল্লাহর শ্রেষ্ঠ উপহার। তারা সন্তানের ভালোর জন্য মৃত্যু অবধি কষ্ট করতে রাজি। ক্লাসমেট আম্মুকে বলার পর আম্মুও উৎসাহ দিলো। স্বপ্ন দেখলাম ঢাবিতে পড়ার। বাউন্ডুলে ছেলে ছিলাম। হঠাৎ কেমন যেন পরিবর্তন আসলো। সারাক্ষণ বই সামনে। এবারের স্বপ্নটা আব্বু আম্মুর না যে বলে কয়ে স্কুলে পাঠাবে। এবারের স্বপ্নটা নিজের। ভুলে গেলাম আড্ডা, রাত করে বাসায় ফেরা। যেহেতু টপ লেবেলের রেজাল্টের সাথে আমার সামান্য পুঁজি নিয়ে লড়াই করতে হবে সেক্ষেত্রে আমাকে বিশেষ কিছু করতেই হতো। ঢাকায় এই প্রথম। গ্রামের নির্মল বাতাস ছেড়ে আসলাম বিষাক্ত শহরে। সকাল সকাল যখন এক্সাম হলে গেলাম বাসের বিষাক্ত গ্যাসের গন্ধ শুঁকে শুঁকে ক্লাস রুম তখনো ঘুরছিল। এক্সাম শেষ আবার একটা পলিথিন হাতে নিয়ে বাসায় ফিরলাম। এভাবে ঢাবি, জবি এক্সাম শেষ হলো। ফলাফল ঢাবিতে মেধাতালিকায় ছিলাম কিন্তু ৩টা সাবজেক্টের কোনটা পছন্দ না হওয়াতে দিলাম না চয়েস। এদিকে ঢাকা কলেজ ভর্তি ফর্ম তুলেও এক্সাম দিতে না পারার ব্যর্থতায় একটা বছর বধির হয়ে ছিলাম। মানুষের সাথে ভাগ্যও যখন পরিক্ষা নেয় তখন এক্সামাইন না হয়ে উপায় আছে কি? কুয়াশায় লঞ্চ আটকে গিয়েছিল মাঝপথে। সময় মতো পৌঁছানো হয়নি এক্সাম হলে। পরের বছর চেষ্টা করলাম আবার। এবারও ব্যর্থ। নিশ্চুপ হয়ে গেলাম। যে যেভাবে বলছিল শুনছিলাম। বধির হওয়ার ভাব ধরলেই ত মানুষ বধির হয়ে যায় না। সারা দুনিয়া ঘুরে এখন স্থানীয় কলেজে কোন ভাবে অনার্স, ডিগ্রি শেষ করেই সন্তুষ্ট থাকা ছাড়া কিছুই করার নাই। কেননা ইতোমধ্যে ভাইয়া বলে দিয়েছিল আমাকে দিয়ে হবে না যেহেতু এখানেই কোথাও ভর্তি হয়ে আম্মুকে দেখাশোনা করতে। তাই করলাম। ফর্ম জমা দেওয়ার দুদিন পর আবারো সাহসটা আম্মুই জোগালো বলল ফর্ম ক্যানসেল করে পছন্দের কোথাও এক্সাম দিতে। সময়ের অপরাহ্নে গিয়ে মোটামুটি রিস্ক নিয়ে ক্যানসেল করে ঢাকা কলেজ এপ্লাই করলাম। ফ্রেন্ড ঢাকা যাচ্ছে শুনে ওর কাছে কাগজ জমা দিয়ে দিলাম। পরের দিন লাস্ট ডেট। জমা হতে কোনো সমস্যা হলো না। এক্সামও দিয়ে আসলাম অনেক দিন হয়ে গেলো। ফোনের রিং শুনেই কেমন যেন কেঁপে উঠলো বুক। কোন এক সতীর্থ কল দিয়ে জানলো আজকে রেজাল্ট দেয়ার কথা। শেষ চেষ্টা না হলে, এতো চড়াই-উতরাই করে অবাধ্য হয়ে ডিসির ফর্ম তোলার জন্য চরম অপমান অপদস্ত অপেক্ষা করছে আমার জন্যে। এসব ভেবে ভেবে মাথাটা একদম জ্ঞান শূন্য হয়ে গিয়েছিল। বাসা থেকে আম্মুর মুখটা একবার দেখে বের হয়ে গিয়েছিলাম। এ যাত্রায় না হলে সুইসাইড করব ভেবেই ম্যাসেজটা সেন্ড করে দিয়েছি। রিপ্লাই আসতে আসতে অনেকটা পথ এগিয়ে গিয়েছি। ভাইব্রেশনে ফোন কেঁপে উঠলো হাতের মুঠোয়। চেপে ধরলাম দুনিয়ার সকল শক্তি দিয়ে। ফোনের স্ক্রিনের আলো চোখে লাগতেই মুদিত চোখ তুলছিলাম ধীর গতিতে। ফিরে আসলাম এ যাত্রায় আম্মুর কোলে। ভেজা চোখ বন্ধ করে জড়িয়ে ধরলাম আম্মুকে আরো একবার। ফার্স্ট ম্যারিট লিস্টেই চান্স হলো ঢাকা কলেজে। বিজয়ের হাসিটা যতোটা না পছন্দের বিদ্যাপীঠে চান্স হওয়ায় তার থেকে বেশি আরো অনেকটা সময় আম্মুকে আম্মু বলতে পারার। ছেড়ে গিয়ে ফিরে পাবার। সত্যি বলছি সেদিনের সেই সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ রূপে বিকৃত মস্তিষ্কের। যেটা বর্তমান অবস্থান থেকে হাস্যকর এবং অবিচার ছিল নিজের ও পরিবারের প্রতি। সুতরাং বিজয়ের হাসি তারাই হাসে যারা আজীবন অদম্য এবং অধ্যবসায় বজায় রাখে। একজনের ভুল হোক সবার শিক্ষা।