ছেলের মুখে বিজয়ী হাসি

Meherun nesa Misty

কুয়াশার চাদর টেনে পুব আকাশে উদয় হয় রবি। কিচিরমিচির বুনো পাখির কলতানে মুখরিত চারিদিক। রোদের সোনালী আভায় নিমিষেই শুকাতে থাকে ঘাসের উপর জমে থাকা শিশির কণাও। বাসার পাশে অবস্থিত সিরাজদিখান উপজেলার স্কুল প্রাঙ্গণে ছোট বড় সব বয়সের মানুষের আনাগোনায় জানান দেয় আজ ১৬ এ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস। খানিক পরপরই বিভিন্ন স্কুল থেকে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের আগমন ঘটছে এই স্কুলে। আনন্দ উল্লাসে উল্লাসিত হয়ে ভারী হয়ে উঠেছে প্রকৃতি। মিসেস মেহেরুন্নেছার তিন তলার বাড়িটি স্কুলের ঠিক অপর সাইটেই। অনুষ্ঠানের সবকিছু বাসা থেকে শোনা গেলেও কয়েকটি দোকানের জন্য তেমন দেখা সম্ভব হয় না। মেহেরুন সবে মাত্র নাস্তা করতে বসেছেন, এমন সময় সাদিয়া এসে বলল, "কাকি, কাকি! বাসার সবাই মাঠে অনুষ্ঠান দেখতে যাচ্ছে। আপনিও চলেন না প্লিজ।" মুচকি হেসে উত্তরে বললেন, "বিয়ের এতো বছরে কখনো স্কুলের কোন অনুষ্ঠানে তোমাদের দাদা আমাকে যেতে দেয়নি। কারণ তিনি হাজি মানুষ তার ছেলের বউদেরকে তিনি এসবে এলাও করে না। আমি গেলে অশান্তি হতে পারে। তোমরাই যাও মা।" সাদিয়া মন খারাপ করে চলে যায়। ঠিক তখনই অকস্মাৎ মোহাম্মাদ সাদিয়াকে 'বুবু' ডাকতে ডাকতে ছুটে আসে। ততক্ষনে সবাই চলে গেছে তাদের গন্তব্যে। বের হয়ে বাচ্চাটি যখন দেখলো কেউ নেই, তখন এমনভাবে কান্না জুড়ে দিলো যে ছেলের কান্নায় যেন তার কানে তালা লাগার জোগাড় হলো। মেহেরুন ছেলের কান্নায় বাধ্য হলো আধ খাওয়া খাবারটুকু প্লেটে রেখেই উঠে যেতে। বেসিনে হাত ধুয়ে ছেলেকে নিয়ে ছুটে চলল গেইটের সামনে। উদ্দেশ্যে পরিচিত কাউকে পেলেই ছেলেকে দিয়ে বলবে অনুষ্ঠান দেখিয়ে আনতে। কিন্তু দশ থেকে পনেরো মিনিট দাঁড়িয়ে থাকার পরেও যখন কাউকে পেলো না, তখন নিরাশ হয়ে রুমে ফিরে এলেন। কিন্তু মেহেরুনের পনেরো মাসের অবুঝ শিশুটি যেন নাছোড়বান্দা। বোরকাটা টেনে এনে মায়ের হাতে তোলে দিয়ে চোখের ভাষায় বলতে চাইছে, "মা, তুমিই চলো না আমাকে নিয়ে।" ছেলের এহেন আচরণে কচি মুখপানে তাকিয়ে আছে মেহেরুন। চোখের কোণে শিশির বিন্দুর ন্যায় জমে থাকা অশ্রু ফোঁটাগুলো আলতো হাতে মুছে নিয়ে বলে উঠল, "মোহাম্মাদ, তোমার জন্য তোমার দাদার নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গ করতে আজ আমি বাধ্য হচ্ছি। কারণ তুমি আমার হৃদয়ের স্পন্দন; তোমাকে আনন্দ দিতে পারাটা মা হিসেবে এটি আমার দায়িত্ব এবং কর্তব্য সোনা বাবা।" মায়ের ভাষা মোহাম্মাদ যেন খুব সহজেই বুঝতে পারল। মুখে বিস্ময়কর এক উজ্জ্বলময় হাসি এঁকে ছুটে এসে মাকে জড়িয়ে ধরলো। ছেলের মুখের হাসি দেখে মেহেরুনের চোখ আরো একবার ভিজে উঠে। বোরকা পরে শ্বশুর শাশুড়ির চোখ ফাঁকি দিয়ে পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। স্কুল মাঠে আসতেই পরিচিত সবার সাথেই দেখা। কেউ কেউ যখন মোহাম্মাদকে কোলে নিতে চাইলো; কি বুঝে যে মাকে ছেড়ে কারোর কোলেই বাচ্চাটি যেতে চাইলো না কে জানে। মায়ের কোল থেকেই সে নির্বাক শ্রোতা হয়ে একের পর এক নাচ, গান, অভিনয় উপভোগ করতে লাগল। অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে যখন একটি কিশোর বঙ্গবন্ধুর রুপে এসে বলতে লাগলো, "এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম; জয় বাংলা।" ঠিক তখনই অকস্মাৎ মোহাম্মাদ আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠে। বিজয়ী মাসে ছেলের মুখে বিজয়ী হাসি দেখে মিসেস মেহেরুন ভাবে, "এটাই আমার সার্থকতা। মুজিবের মতোন অন্যায়ের সাথে আপোষ না করে একজন সাহসী মানুষ আর দেশপ্রেমী হয়ে গড়ে উঠো এ দোয়াই করি। আজকের এই দিনটিই তোমার আমার জীবনের বিজয়ের গল্প হিসেবে স্মৃতির পাতায় ইতিহাস হয়ে থাকবে ইনশা-আল্লাহ! জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।"