বিজয়ের পঞ্চাশ বছর

পারভীন আকতার

আজ সকাল থেকেই রহমত দাদু খুব ব্যস্ত।অনেক সাংবাদিক এসে তাঁর সাথে ছবি তুলেন।স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা শুনেন আর রেকর্ড করেন।রহমত দাদু কোন বিরক্ত হন না।বরং স্থির জলের মত শান্ত তিনি। চেয়ারে বসে একনাগাড়ে ১৯৭১ সালের সেই বিভীষিকাময় কথা বলতে থাকেন।এতে তাঁর খুব গর্ব হয়।সামনের লনের বিস্তৃত বারান্দায় অপেক্ষমান শহর থেকে আসা একঝাঁক কিশোর তরুণ তরুণীর দল "আমরা করব জয়" একটি বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান বসে আছে। রহমত দাদুকে ঘিরে ধরেছে সবাই।রাসেল নামের এক কিশোর দাদুকে জিজ্ঞেস করে,'দাদু বঙ্গবন্ধুর নাকি আমার নামের একটি ছেলে ছিল,তার ব্যাপারে তুমি কিছু জানলে বল। শেখ রাসেলের কথা শুনতে খুব ইচ্ছে হয়।' রহমত দাদু দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন।বয়স হয়েছে সাথে কাশিটাও বড্ড কষ্ট দেয় আজকাল।তবে তিনি সচেতন বটে।করোনা মহামারী চলাকালে সবার মুখে মাস্ক পরিয়েছেন এবং নিজেও পরেছেন।পাশে পড়ে থাকা চশমাটা চোখে দিয়ে তিনি বলেন,'শেখ রাসেল আমাদের ভাই। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর পুরো পরিবারের সাথে ছোট্ট শিশুটিকেও অমানুষরা গুলি করে হত্যা করে।কী নির্মম মানুষ তাই না। 'কথাগুলো বলতে বলতে দাদুর চোখে জল আসে আর "আমরা করব জয়" টিমের সবারই মন খারাপ হয়। আচ্ছা এবার বল দাদু যুদ্ধের সময় তোমরা কী কী খেতে?অনীক দাদুকে জড়িয়ে ধরে। রহমত দাদু হাসেন।সবাই কত কঠিন কঠিন প্রশ্ন করল কিন্তু কখনো কেউ জিজ্ঞেস করেনি মুক্তিযোদ্ধারা কী খেয়ে বেঁচেছিল, যুদ্ধ চালিয়ে গেছিল।অথচ কত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এটি।যাহোক দাদু অনীককে বুকে জড়ালেন।শীত পড়ছে। শালের অর্ধেকটা অনিককে জড়িয়ে দিয়ে তিনি বলেন,'দেখ দাদু শাল জড়িয়ে দিয়ে তোমার কেমন লাগছে।নিশ্চয়ই খুব আরাম লাগছে।আমাদের যুদ্ধের সময় সেই আরামটুকুও ছিল না।সারারাত নদীতে বুক সমান পানিতে দাঁড়িয়ে ওপারে হানাদারদের সাথে প্রচন্ড গুলাগুলিতে অংশ নিয়েছিলাম।একটা কাপড় ছিল না শুকনো।ভেজা কাপড়ে চলে গিয়েছিলাম কোন বাঙালি গেরস্তের ঘরে।তারা আমাদের চুপিসারে লুকিয়ে ঘরে মুড়ি,পান্তা পাত, মরিচ যা থাকত দিত।আমরা তা-ই খেয়ে না খেয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছি। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ অনীক।খুব ভাল প্রশ্ন করেছো।' শামীম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে।সে জানতে চায় বঙ্গবন্ধুর চোখে দেখা বীরত্বের কথা। রহমত দাদু,মর্জিনা তাঁর নাতনীকে এক গ্লাস পানি আনতে ঈশারা করেন। দূর থেকে দ্রুত এসে দেলু বলে,'একজন জেলা প্রশাসক এসেছেন।আপনার সাথে দেখা করতে চান।' রহমত দাদু বলেন,'আসতে দে। ভিতরে বসার ঘরে নিয়ে যা।আমি আমার দাদুদের সাথে কথা শেষ করে আসছি।উনাকে বলবি একটু ধৈর্য ধরে বসতে।আজ তিনি আমার ঘরের অতিথি এবং আত্মীয় হিসেবে এসেছেন।খাবারের ব্যবস্থা কর সবার জন্যই।কেউ যেন না খেয়ে না যায়।' ঠিক আছে, বলে দেলু চলে গেল। রহমত দাদু বঙ্গবন্ধুর কথা বলতে শুরু করেন। 'আমি বঙ্গবন্ধুকে খুব কাছে থেকে দেখেছি।তিনি একজন মহৎ প্রাণের মানুষ ছিলেন।আমাকে সিপাহী রহমত বলে ডাকতেন।খুব স্নেহ করতেন আমায়।উনাকে যতটুকু কাছে থেকে দেখেছি,শুধু বাংলাদেশের মানচিত্র ছিল তাঁর হৃদয়ের ভিতর মনে হয়েছে আমার।যুদ্ধের সময় পাকিস্তানিদের কাছে কিছুতেই মাথানত করেননি।কত কষ্ট,যাতনার শিকার হয়েছেন।বছরের পর বছর জেলে জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। সদা হাসি মুখে কষ্ট বরণ করেছেন।বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি খুব খুশি হয়েছিলেন।কথায় কথায় কীভাবে দেশের উন্নয়ন হবে স্বাধীনতার পর দেশকে কীভাবে দাঁড় করাবেন দিনরাত পরিশ্রম করতেন।দেশ বিদেশে সহায়তা,সমর্থন চেয়েছিলেন।যোদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করে দিয়েছিলেন যাতে সবাই মিলেমিশে ভগ্নদশা প্রায় বাংলাদেশকে ফের গড়তে পারে।অত্যন্ত সাদাসিধে জীবনযাপন করতেন তিনি এবং তাঁর পরিবার।তবে তাঁর ভিতর দারুণ প্রতিবাদী অগ্নিশিখা ছিল।অন্যায়ের কাছে মাথা নত কখনোই করেননি।তাই তাঁকে সত্য ন্যায়ের পথে চলতে গিয়ে দেশীয় অজাত শত্রুদের হাতে নৃশংসভাবে পুরো পরিবারসহ ধানমন্ডির ৩২ নং বাড়ীতে তাঁর শিশুপুত্র শেখ রাসেলসহ মৃত্যু বরণ করতে হয়েছিল।বাংলাদেশে শেখ মুজিব জন্মায় একবারই।আমরা কী বোকা বাঙালি! তাঁকেই বিনাদোষে বুলেটের মুখে জীবন দিতে হল।সত্যিকার দেশ প্রেমিক ছিলেন আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।' বারান্দায় বসা সকলে জোরে করতালি দিল।সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনল দাদুর মুখে বঙ্গবন্ধুর কথা।সত্যি নতুন প্রজন্মকে এভাবে বিজয়ের পঞ্চাশ বছরেও এত সুন্দর করে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে উপস্থাপন করতে পারলে বাঙালি জাতি আরো এগিয়ে যাবে।গর্বের হবে স্বাধীনতার সংগ্রাম। বসার ঘরটি বেশি দূরে নয়।সিপাহী রহমতের কথা জেলা প্রশাসক ফারুক আহমেদ শুনলেন।এবং চোখের জল ফেললেন।মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এত জ্বলজ্বল করা সত্য কথা,কাছ থেকে দেখা বঙ্গবন্ধুকে এমন বিরল অভিজ্ঞতার কথা আগে তিনি কখনোই শুনেননি এত আবেগ দিয়ে। তিনিও হাত তালি দিলেন।এবং রহমতের সামনে গিয়ে তাঁকে স্যালুট দিলেন। "আমরা করব জয়" টিমের সকলেই উঠে দাঁড়ায়।বাহাত্তর বছরের রহমত দাদুকে দুইজন কিশোর ধরে দুই কাঁধে হাত লাগিয়ে দাঁড় করিয়ে দেয়।সবাই মিলে আবার যথাযোগ্য মর্যাদায় তাঁকে স্যালুট জানায়। আজ ১৬ ডিসেম্বর ২০২১ সালে এসে সিপাহী রহমত মিয়া দেশ স্বাধীন করার স্বপ্ন সত্যি হয়েছে ভাবেন।দেশের প্রবোত উন্নয়ন দেখে খুশিতে চোখের জল ফেলেন।আর পরম করুণাময়ের কাছে দেশের শান্তি কামনা করেন।মনে মনে মুক্তিযোদ্ধা রহমত বলেন, "বাংলাদেশের উন্নতিতে আনন্দ সবার, বিজয়ের পঞ্চাশ বছরে জাগো আবার।" -------- পারভীন আকতার শিক্ষক, কবি ও প্রাবন্ধিক চট্টগ্রাম।