নাইমুল ইসলাম অপু
আজ বৃহস্পতিবার সকাল বেলায় অন্য দশ দিনের মতই ঘুম ভাঙল। কেন যেন মনে হচ্ছে আর ভালো লাগে না, চিন্তা করে বুঝলাম পরাধীনতায় আর কত? পরাধীনতার স্বাধ বড় যন্ত্রণাদায়ক। নড়িয়া নামক থানায় আমাদের বাড়ি ছিল। পাকিস্তানি আমলে ছিল বলে লেখাপড়ার সুযোগ ছিলনা ,তাই জমিতে ধান,গম,ডাল ইত্যাদি চাষাবাদ করে সংসার চালাতাম।কিন্ত ফসলের ন্যাযমূল্য পাওয়া যেত না। তাই মনটা খারাপ লাগত কত কষ্ট করে ফসল পাইতাম, কিন্তু বিক্রি করে যে অর্থ পাইতাম,এই আর্থ দিয়ে কি সংসার চলতো? স্বল্প আয়ে কোন রকম সংসার চালাতাম। বাবা মারা যাওয়াটা ছিল আমাদের অভাবের গোড়াপত্তন। সেই থেকেই দরিদ্রতার জীবন শুরু। দরিদ্রতা ভুলে থাকার জন্য মাঝে মাঝে আমি গান শুনতাম। পল্লীগীতি আমার অনেক ভালো লাগতো । তাই একটি রেডিও কিনেছিলাম। রেডিওতে প্রতিদিন সকাল দশটার খবরের পর পল্লীগীতির একটি অনুষ্ঠান প্রচার করা হতো। সেই প্রচার শোনার জন্য এটা আমি ক্ষেতে কাজের সময়ও নিয়ে যেতাম । একদিন ক্ষেতে কাজের সময় পল্লিগীতি শোনার জন্য বেতারটা চালু করলাম। কিন্তু আজ পল্লী গান চলছে না। একটা লোকের কন্ঠ শুনতে পাচ্ছি। তিনি বজ্র কণ্ঠে সিংহের মত গর্জনে ভাষণ দিচ্ছিল। কে এই লোক আমি চিনতাম না, তবে মানুষের কাছে শুনেছিলাম একজন নেতা আছে, তিনি নাকি আমাদের বাংলার মানুষকে মুক্ত করতে চায়। আমি মনে মনে সেই নেতার কথাই ভাবছিলাম হয়তো তিনিই হবে। আমি আর কিছুই জানিনা। বজ্র কণ্ঠে ভাষণের ফাঁকে ফাঁকে লক্ষ মানুষের "জয় বাংলা"স্লোগান শোনা যাচ্ছিল। কয়েকদিন পর বাজারে রওনা হলাম ধান বিক্রি করতে,কাল আবার সকাল হতে না হতেই মহাজনের লোক এসে বসে থাকবে ঋনের টাকা আদায়ের জন্য।কিন্তু ধান বিক্রি করে যে টাকা পাইছিলাম তাতে শুধু ঋনের টাকাই হল টেন হিঁচড়ে। বাড়ির জন্য কিছুই কিনতে পাড়লাম না। ঘরে তেল নুন ফুড়াইছে গতকালই, রমিজের মা'র থেকে কয়টা আলু এনে সিদ্ধ করে খেয়ে দিন পার করছিলাম । আজ টাকার জন্য কিছুই কিনতে পারলাম না। ছোট বোনটি বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় বলছিল " ভাইরে বাজার তনে লইগা আলতা, কুমকুম আনবি" আলতা কুমকুম কিছুই আনতে পাড়লাম না। আপাতত মহজনের টাকা পরিশোধ নিয়ে চিন্তা করতে করতে বাড়ির দিকে রওনা হলাম। বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল, গরুগুলো গোয়াল ঘরে বেঁধাই ঘরে ডুকলাম কিন্তু ঘরে কোন আলো নেই, হারিকেন কুপি কিছুল জ্বলছেনা,আমি বউকে বললাম কি হইছে হারিকেন জ্বলছেনা কেন? কিছুক্ষণ পড়ে বলল "ঘরে কেরাসিন নেই কি দিয়া জ্বালামু"? আমি অন্ধকারে পাশের বাড়ি থেকে এক শিশি কেরাসিন ধার এনে কুপিতে ভরলাম। কুপি টা বা হাতের উপর করে আমি খাবার ঘরে দেখলাম পাতিল শূন্য, খাবার বলতে কিছুই নেই। তাই না খেয়েই বালিশের উপর মাথা রেখে চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকাল বেলা ঘুম ভাঙল আমি গোয়াল থেকে গরু বের করতে গেলাম। গোয়াল ঘরে থাকেই হাক ডাক শুনে বুঝতে পারলাম মহাজনের লোক এসেছে ঋনের টাকা আদায় করতে। আজ ৭মার্চ দেশের নাকি অবস্থা ভাল না,ছোট বোন দূর্গাকে বল্লার রেডিওটা দেতো, সে ঘর থেকে বের করে রেডিও দিল। আমি রেডিওটা চালু করলাম রেডিওতে শুনতে পেলাম অনেক মানুষের হুঁড়াহুঁড়ি শব্দ,আর নতুন একটা শব্দ শুনতে পাচ্ছি "জয় বাংলা,জয় বাংলা,জয় বাংলা" এই শব্দে যেন বেতার মুখরিত। আমি কিছুই বুজতে পারছি না।টাকা উঠানো প্রায় শেষ। আমি হরিস কাকুকে বললাম কাকু কেন এমন করছে মানুষ কি হইছে, সে বলল আজ শেখ মুজিব বাঙালী জাতির উদ্দ্যেশ্যে ভাষাণ দিবেন। কিছুক্ষন পরেই শুনতে পেলাম সেই চিরচেনা কন্ঠস্বর মনে ক্ষোভ নিয়ে কথা বলছে। তিনি মিনিট বিশ হবে ভাষণ দিল, আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে বলেছেন। তিনি বলছেন "তোমাদের যা কিছুই আছে তোমরা তা নিয়েই প্রস্তুত থাক, শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে"। আমি তার ভাষণে বুজতে পারলাম আমরা যদি মুক্তি পাই তাহলে আমাদের জীবন যাপন করতে সমস্যা হবে না। আমরা ফসলের সঠিক মূল্য পাব। মনে ক্ষোভের জন্ম হল পাকিস্তানিদের চোখের সামনে পাইলেই গুলি করে মারতাম! কিন্তু গুলি কোথায় পাব? কিভাবে যুদ্ধ করবো? আমাদের গ্রামের আক্তার দাদু মুসলিমলীগ করে, একদিম আমি জমিতে হালচাষ দিতে যাচ্ছিলাম পথিমধ্যে তার সাথে দেখা তিনি আমাকে বলল কিরে আমাদের যুদ্ধ করতে হবে না? আমি এবার সুযোগ পেলাম, বললাম আমি কার সঙ্গে যাব কে আমাকে নিয়ে যাবে? আক্তার দাদু বলল আমি তোকে নিয়ে যার আয়, আর কাজে গেলাম না, দাদুর বাসায় চলে গেলাম সে আমাকে বলল কিছু পান্তা আছে খেয়ে ফেলো। আমি খেতে বসলাম আমাকে বলতেছে কলাপড়ায় আমাদের ক্যাম্প। আমাকে রাতে কলাপাড়ায় যাওয়ার রাস্তাটি ধান ক্ষেতের ভিতর দিনে একটু এগিয়ে দিয়ে আসলো আক্তার দাদু ।রাতের অন্ধকারে কলাপড়ায় গিয়ে পৌঁছলাম। আমাকে কমান্ডার বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলল কালকে থেকে তোমার ট্রেনিং শুরু, পরদিন ঝোপঝাড়ে দিন কাটালাম। রাতের আধারে আমদের ট্রেনিং শুরু হল। পনেরো দিনের ট্রেনিংয়ে আমাদের আত্মরক্ষা এবং গুলি চালায়ে শিখালো। আজ থেকে যুদ্ধ করতে হবে। শুনলাম কাল নাকি বাঁশতলা গ্রাম আগুন ধরিয়ে দিয়েছে ঘর বাড়ি পুড়ে ছাই করে দিয়েছি পাকিস্তানিরা। আবার নারী নির্যাতন করে গুলি করে মেরে ফেলছ।আর ছোট ছোট বাচ্চা গুলোকে ফুটবলের মত করে লাথি মরে হত্যার পর নদীতে এখানে সেখানে ফেলে দিয়েছে ।কি নির্মমতা করছে ওই হায়নার বাচ্চারা। আমাদের আজ থেকে মাঠে সম্মুখ যুদ্ধ শুরু করতে হবে। হায়নারা আমাদের কলাপাড়ায় ক্যাম্পের খবর পেয়েছে। সেই কথার প্রক্ষিতে বাচ্চু ভাই ভীত কন্তু কে দিলো কে এই কথা ভাবতে বলে, রহমতুল্লাহয় ছাড়া আর কেউ এই খবর পাকিস্তানিদের কাছে কেউ দেয়নি আক্রমণ করবে খবর পেয়ে আমরা প্রস্তুতি নিলাম। আমাদের কলাপাড়ার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে জিজ্ঞাসা নদী। আমরা জিজ্ঞাসা নদীর তীরে কাশবন আর ওরকালতা কলমিশাকে ভিতরে ডুকে পড়লাম। কোন প্রতঙ্গ বা সাপ,বিচ্ছুর ভয় না করে সবাই প্রস্তুত হায়নাদের বিরুদ্ধে লড়ব। রাত ঘনিয়ে আসছে দূরে দেখতে পাচ্ছি মিঁটিমিঁটি আলো বুঝতে পারছি হায়নারা আসছে। কমান্ডার বাচ্চু ভাই বলল আমাদের মনে সাহস রাখতে আর ঠিক সময় আক্রমণ করতে হবে।কিন্তু একি হল! আমরা যেখানে গুটিয়ে লুকিয়ে ছিলাম সেখানে না পৌঁছাতেই তাদের বজরা ভিড়ালো নদীর তীরে। কমান্ডার বলছে বুদ্ধি দিয়ে যুদ্ধ, আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। এর মধ্যেই পাকবাহিনী গ্রামে ডুকে পড়েছে। গ্রামের ঘর বাড়িতে আগুন দিচ্ছে চারিদিকে কাঁন্নাকাঁটির শব্দ। বাচ্চু ভাই বলল কেউ বাঁচতে আসিনি প্রয়োজনে মরব। এগিয়ে চলল কমান্ডার চুঁপিচুঁপি নৌকা পাহারায় হায়নাদের দ্রুতই শেষ করলাম আমরা। এবার গ্রামের মধ্যে ডুকে পড়লাম আমরা কলা গাছের আড়াল থেকে পাকিস্তানিদের লক্ষ করে গুলি করলাম। ইতিমধ্য কয়েকজন পাক সেনা শেষ হলো, আমাদের দলের লতিফ,কামাল আহত হয়ে পড়েছে কিন্তু কিছুই করার নাই, এই দিকে মন না দিয়ে গুলি শুরু করলাম। একসম পাকিস্তানিদের শেষ করলাম। আমাদের কামাল ও লতিফ মারা গেছে, আমরা তাদেরকে গণ কবরে দাফন করলাম খুব চুপেচাপে। এইভাবে কয়েকদিন যুদ্ধ করলাম। আমাদের দলের অনেকেই মারা গেল। মার্চ শেষের দিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী দেশের বিভিন্ন স্থানে জোরাল ভাবে হামলা চালাচ্ছে। আর রেডিওতে শুনতে পেলাম দেরটার দিকে শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করছে। এই রাতেই কালুর ঘাট বেতারে কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষনা হয়। আমরা দেশকে মুক্ত করার লক্ষে যুদ্ধ চালিয়ে গেলাম। যুদ্ধে অনেকেই শহিদ হইছে, আমাদের লোকবল কমে গিয়েছিল নতুন কিছু যুবক যুদ্ধে আসছে তাদের ট্রেনিং করানোর পড়ে যুদ্ধে অংশগ্রহন করানো হয়েছে। এভাবে কয়েক মাস যুদ্ধ চালিয়ে গেলাম। অনেক সহযোদ্ধা হারিয়েছি মুক্তি যুদ্ধের যুদ্ধক্ষেত্রে। একদিন শুনতে পেলাম আমরা ছয়টি স্থানে জয় পেয়েছি। আজ ১৪ ডিসেম্বর রাতে আমাদের যুদ্ধ করতে হবে কাঁচিয়াটি গ্রামে আমরা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। রাতে তুমুল যুদ্ধ শুরু হল। রাত শেষ হল আমরা আগামী দিনের জন্য রেডি হচ্ছি এর মধ্য অনেক জেলা স্বাধীন হয়ে গেছে রেডিও থেকে শুনতে পেলাম। বাচ্চু ভাই আমাদের বলল আজ আমাদের কঠিন ভাবে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। পর দিন আমরা যুদ্ধ শুরুর আগেই রেডিওতে খুশির খবর কাল নাকি আত্মসর্মপন করবে পাকবাহিনী! আজ আমাদের যুদ্ধ করতে হবে এবং দেশ স্বাধীন করতে হবে। বাচ্চু ভাই বলল আমরা স্বাধীনতা পাব আমাদের দেশের মানুষের আর না'খেয়ে মরতে হবেনা। স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারবে, আমরা দেশের মানুষে মুক্তি পাবে দেশর উন্নতি হবে। রেডিও বন্ধ করে আমাদের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে বলল আমরা সবাই চটপট রেডি হলাম।রাতে যুদ্ধ শুরু হল, পাকিস্তানিদের মধ্যে অনেকেই বুলেটের আঘাতে মাটিতে পড়ে যাচ্ছে, কিছুক্ষন পরে খেলখতম। হঠাৎ করেই আমাদের কমান্ডার বাচ্চু ভাইয়ের পাঁজরে গুলির বুলেট ডুকে গেল জহু এবং হানিফ কমান্ডার কে জড়িয়ে ধরল, জহু এবং হানিফকেও গুলি করল। ওই দিকে না তাকিয়ে আমি ও আলি আস্রব,কাসেম,দীণেশ,গণেশ, রহমান আরোও কয়েকজন পাকদের উপড়ে গুলি করতেছি। প্রায় পৌনেএক ঘণ্টা গোলাগুলির করে এক সময় পাক বাহিনীকে শেষ করলাম। আমাদের কমান্ডার এবং জহু ও হানিফ মারা গেছে এবং দীনেশ মারা ও গণেশও মারা গেল আমরা বাচ্চু ভাই,জহু,হানিফকে কবর দিলাম। রাতের মধ্যেই আমরা দীনেশ,গণেশকে চিঁতায় পোঁড়া শেষ করলাম। সকাল হয়ে যাচ্ছে পাখির ডাকে ফুল ফুঁটছে মলিন হাওয়া বইছে কিন্তু মন ভালো না, কারণ যারা দেশের স্বাধীনতার জন্য এত করল তারা আজ নেই। সকাল হচ্ছে মানুষ আজ তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে রেডিওটা চালু করে বসে আছে। কারণ আজ পাকবাহিনী নিয়াজী পাকসেনাদের নিয়ে আত্মসমর্পন করবে। রেড়িওতে শুনছি পাকদের লজ্জাজনক পরাজয় আর বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন । অবশেষে আমরা স্বাধীন হলাম এখন মনে হচ্ছে বাংলার মানুষ যেন খাঁচা থেকে আজ মুক্ত এদিকে ওদিকে খুশির সংবাদ ছড়িয়ে দিচ্ছে, যেম খাঁচার বন্দী পাখিগুলো আজ থেকে খাঁচা থেকে মুক্ত আকাশ ছেড়ে দিলে যেমন হয় ঠিক তেমনি হয়েছিল সেদিন। আমরা রেডিওতে শুনতেছি একটি শব্দ পাচ্ছি "জয় বাংলা, জয় বাংলা,জয় বাংলা। জয় বাংলায় বেতার মুখরিত হয়েগেছে।অবশেষে আর বসে থাকতে পারলাম না, সবাই দাঁড়িয়ে গেলাম,জয় বাংলা,জয় বাংলা,জয় বাংলা!! --রচলাকাল-- ২৩-০৯-২০১৮ ---রবিবার---