Puja Paul
আজকে আমি অনেক খুশি কারণ দীর্ঘ পাঁচ বছর পর স্কুল লাইফের প্রানের প্রিয় বন্ধুদের সাথে আজ দেখা হবে। কি যে মজা হবে! এক্সাইটমেন্ট আর ধরে রাখতে পারছিনা।তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে বসে আছি।ঢাকা থেকে যেসব ফ্রেন্ডরা আসছে তারা বাস ভাড়া করেছে। আমরা চট্টগ্রামের ফ্রেন্ডরা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে চলে এসেছি। প্লান ছিল এখান থেকে আমাদেরকে তারা বাসে তুলে নেবে।সীতাকুন্ড গিয়ে পিকনিক করবো। সাড়ে আটটার দিকে বাসে উঠে সীতাকুন্ড রওনা দিলাম। আমার কি যে মজা লাগছে কি আর বলবো।আইটেম,কার্ড, টার্ম ,প্রফ এর প্রেসারে আমিই টাইম দিতে পারছিলাম না। কিন্তু ওরাও নাছোড়বান্দা আমাকে ছাড়া পিকনিক করবে না। এক সপ্তাহ পর ফ্রি হব এমন বলতে বলতে প্রায় দুই মাস পর আজকে টাইম দিতে পেরেছি। তাই এক্সাইটমেন্ট একটু বেশিই।আজ কোন কিছুর বিনিময়ে আমাকে পিকনিকে যাওয়ার থেকে কেউ আটকাতে পারত না, যদি না সন্ধানী থেকে ফোনকলটি আসত।আন-নন নাম্বার থেকে একটা ফোন এলো। ধরতে মন চাইছিল না তাও কেন জানি ধরে ফেললাম। আমি: হ্যালো, নমস্কার। ওপাশ থেকে : আদাব,আপনি কি পূজা আপু বলছেন? আমি: জ্বী। ওপাশ থেকে: ইমারজেন্সি ভিত্তিতে এক ব্যাগ বি নেগেটিভ ব্লাড লাগবে। আপনি কি কষ্ট করে একটু দিতে পারবেন? ততক্ষণে ভাটিয়ারী পৌঁছে গেছি। আমি: আমি বাসায় থাকলে তো ঠিকই দিতাম কিন্তু আমি এখন ভাটিয়ারী। এখন তো সম্ভব না। ওপাশ থেকে:আপু প্লিজ একটু ট্রাই করে দেখেন না। অনেক খুজেছি। বি নেগেটিভ ব্লাড অ্যাভেলেবল নাই।ব্লাড ব্যাংকেও নাই।আর যারা আছে তারা সব ঢাকার। আমি:ওটা তো বুঝেছি বাট এখন তো আমি আসতে পারছিনা। ওপাশ থেকে :আপু প্লিজ বারোটার মধ্যে ব্লাড লাগবে। একটা ডেলিভারি পেশেন্ট। পেশেন্টের হ্যাজবেন্ড এখানে এসে খুব কান্নাকাটি করছে। তারা দীর্ঘ ১৩ বছর ধরে নিঃসন্তান দম্পতি আর ডাক্তার বলেছেন এবারই তাদের সন্তান ধারণের শেষ সুযোগ। আপু ব্লাড যদি ম্যানেজ না হয় তাহলে পেশেন্ট এবং বেবি কাউকেই বাঁচানো সম্ভব নয়। কথাটা শুনে বুকের ভিতর কেমন কেঁপে উঠলো। আর কিছু না ভেবেই বলে দিলাম আমি আধা ঘন্টার মধ্যেই চলে আসছি।ফোন কেটে গাড়ি থামাতে বললাম। ফ্রেন্ডদের বললাম "দোস্ত একটা ইমারজেন্সিতে এখনই মেডিকেলে যেতে হবে। তোরা যা "।কিন্তু ফ্রেন্ডরা আমাকে ছাড়তে নারাজ। ওরা বলল, "তোকে ছাড়া পিকনিক করবো না বলেই তো তুই কখন ফ্রি হবি তার জন্য দুই মাস ওয়েট করেছি। আমরা এতো জন ঢাকা থেকে এসেছি শুধু তোর সাথে একটা দিন কাটাবো বলে। কোন কথা মানিনা তোকে যেতে দেবনা আমরা। তুই আমাদের সাথে পিকনিক করতে যাবি এখন।আমি বললাম ,কিন্তু দোস্ত আমার যাওয়াটা এখন দুইটা জীবন কে বাঁচানোর সাথে রিলেটেড। ব্লাড না দিলে মা ও বেবি দুজনই মারা যাবে। আমি ব্লাড না দিলে আমার কিছুই হবে না কিন্তু ওইদিকে একটা পুরো ফ্যামিলি টা ধ্বংস হয়ে যাবে। নিজের স্বার্থের জন্য তার দুইটা জীবনকে আমি মেরে ফেলতে পারিনা। তোরা আমার কাছে অবশ্যই অনেক ইম্পর্টেন্ট বাট তোদের চেয়েও আমার এখন ফার্স্ট প্রায়োরিটি ওই দুইটা জীবন। হয়ত কথাটা ওদের মনকে নাড়া দিয়েছে। আমাকে শেষ পর্যন্ত যেতে দিতে রাজি হল। ওদেরকে বিদায় জানিয়ে তাড়াতাড়ি একটা সিএনজি নিলাম। অলরেডি ৯টা বেজে গিয়েছে। সাড়ে নয়টার দিকে হাসপাতালে পৌঁছে গেলাম।পেশেন্টের হ্যাজবেন্ডকে দেখে খুব খারাপ লাগলো। কি হাল বানিয়েছেন চেহারার। তাকে আশ্বাস দিলাম টেনশন করিয়েন না দুজনেই সুস্থ হয়ে যাবে।ব্লাড দেওয়ার জন্য বেডে বসতেই এক আপু জিজ্ঞাসা করল কোন অসুখের মেডিসিন নেই কিনা। আগের দিনই এলার্জির মেডিসিন নিয়েছি। আমার মাথায় ছিলনা যে এলার্জির মেডিসিন নিলে এক সপ্তাহের মধ্যে ব্লাড দেওয়া যায় না।এক সপ্তাহ পর দেওয়া যায়। আমার মাথায় শুধু দুইটা জীবনকে বাঁচাতে হবে এ কথাটা ঘুরছিল। মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। খুব কান্না আসছিল। নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছিল। এমন সময় মাথায় আসলো আমার ফ্রেন্ড তৃণাও ত বি নেগেটিভ। ওতো আজ পিকনিকে এসেছে। একটু যেনো আশার আলো দেখতে পেলাম।তখন দশটা বাজে। বারোটার মধ্যে ব্লাড লাগবে ওকে নেওয়ার জন্য সীতাকুন্ড রওনা হলাম। ১০.৫০ এ পৌঁছিয়ে তৃণাকে বললাম দোস্ত ব্লাড দিতে হবে। আমার থাইরয়েড প্রবলেম এর জন্য ব্লাড দিতে পারছিনা। ও বলল তৃণা:দোস্ত তুই জানোস আমি ব্লাড খুব ভয় পাই। এতটাই ভয় পাইছে বাবা-মার তীব্র ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মেডিকেলে ভর্তি হয়নি শুধুমাত্র এই একটা কারনে। আমি: জানি আমি। কিন্তু একবার ভাব এটা দুইটা জীবনের বিষয়। বিলিভ মি তোর কিচ্ছু হবে না। তৃণা:তুই আমাকে জীবন দিতে বল আমি তাও দিতে রাজি। কিন্তু দোস্ত আমাকে প্লিজ ব্লাড দিতে বলিস না। আমি পারবোনা। প্রত্যেকটা মানুষেরই কিছু উইক পয়েন্ট থাকে। এটা আমার একটা উইক এবং বাজে পয়েন্ট আমি জানি। সরি আই এম এক্সট্রিমলি সরি। পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিস। আমি:আমার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে না তোকে। ক্ষমা চা সৃষ্টিকর্তার কাছে, ক্ষমা চা ওই মায়ের কাছে ,ক্ষমা চা ওই বাবার কাছে যারা ১৩ টা বছর ধরে সন্তানের মুখ দেখার আশায় বসে আছে , ক্ষমা চা ওই অনাগত শিশুর কাছে।১৩ টা বছর.It’s not a joke.আমাদের সমাজ জানিসই কেমন। সমাজ তাদেরকে হয়তো বানজা বলে ডাকত। তারা হয়তো সমাজে মুখ পর্যন্ত দেখাতে পারতোনা।হয়তো কোন অনুষ্ঠানে যেতে পারত না। তারা শুধু বেঁচে আছে একটা দিনের জন্য, যেদিন তারা তাদের সন্তানের মুখ দেখবে। মানুষ চাইলে কি না পারে। তুই শুধুমাত্র ভয় পাস বললে দুইটা জীবনকে মেরে ফেলতেসিস। আজকে যদি ব্লাডের অভাবে ওরা মারা যায় এর জন্য তুই দায়ী থাকবি। এর জন্য নিজেকে কোনদিন ক্ষমা করতে পারবি না। কথাগুলা বলে কাঁদতে লাগলাম। হয়তো আমার কথা আর কান্না দুটোই তৃণার মনকে ভাবিত করতে পেরেছিল।ও বলে উঠলো, "আমি ব্লাড দিব"।"আমি আর ভয় পাবো না, ভয় কে জয় করব। "খুশিতে ওকে জড়িয়ে ধরলাম। তখন এগারোটা বেজে গেছে।একটা সিএনজি নিয়ে মেডিকেলে চলে আসলা। বারোটার মধ্যে ব্ল্যাড ম্যানেজ হয়ে গেল। লোকটির হাতে ব্লাডব্যগ দিতেই কৃতজ্ঞতায় সে কেঁদে ফেলল। বলল,"কি যে বড় উপকার করলে তুমি।আমি কিছু সময়ের জন্য ভেবেছিলাম হয়তো তাদেরকে আর বাঁচানো যাবে না। আমার সব শেষ। ভেবেছিলাম সুইসাইড করবো। কিন্তু তুমি আজকে আমাকে এবং আমার পুরো পরিবারকে বাঁচিয়ে দিলে। তোমার কাছে সারা জীবন কৃতজ্ঞ থাকব। আমি বললাম, "আমি ব্লাড দিতে পারিনি। শুধু ডোনার ম্যানেজ করেছি মাত্র। আমার ফ্রেন্ড ব্লাড দিয়েছে। ওকে ধন্যবাদ দিন। তিনি তৃণাকেও ধন্যবাদ দিল এবং দুজনের মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দিল।তারপর আমাকে বলল,"আমার ছেলে বা মেয়ে যাই হোক না কেন আমি তাকে তোমার মত এমন সুন্দর মনের একজন মানুষ বানাবো। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। মনের মধ্যে কেমন যেন একটা তৃপ্তি অনুভব করছিলাম ,যে তৃপ্তি পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়েও কখনো পায়নি। এরকম স্বর্গীয় তৃপ্তি আগে কখনো অনুভব করিনি। এরপর তৃণার কাছে ক্ষমা চেয়ে বললাম," দোস্ত সরি।কটু কথা বলে ফেলেছি। তখন আসলে মাথা ঠিক ছিল না।"তৃণা বলল ,"না দোস্ত, আমিই সরি। আর তোর কাছে সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকব তুই আজকে আমাকে আমার ভয় থেকে বের করে আনতে পেরেছিস।আমি ফিউচারে নিয়মিত রক্তদান করব। আর ভয় পাব না এবং অন্যদেরকেও রক্তদানে উৎসাহিত করবো।"তারপর দুইজন দুইজনকে খুশিতে জড়িয়ে ধরলাম এবং বুকভরা অসীম তৃপ্তি নিয়ে সীতাকুণ্ড পিকনিক করার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।