বিজয়ের বিজয়

বিবি মরিয়ম লাবণ্য

দেশটির নাম পূর্ব পাকিস্তান। সেই দেশেরই একটি গ্রাম রুপালিয়া। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে "রুপালি" নদী। সারা গ্রাম সবসময় মুখরিত থাকত সুখে, খেলাধুলায়, আনন্দ, উল্লাস আর আহ্লাদে। এখন ১৯৭১ সাল। দিনটি ছিল ২৭ মে। রুপালিয়া গ্রাম। আজ খুব সুন্দর মিষ্টি রোদ। যদিও গরম পড়ার সময়, তবে হালকা শীতল পরশ হাওয়া বইছ। গ্রামের মাঝে অনেক বাড়িঘর। "শাহানা আফরোজ। ইনি গ্রামেরই একটি ঘরের একজন গৃহিনী। স্বামী এবং এক ছেলেকে নিয়ে তার সুখের সংসার।" সকালবেলা, শাহানা আফরোজ ঘরের সব কাজ করছেন। এলোমেলো জিনিসগুলো গুছিয়ে নিচ্ছেন। হঠাৎ, কী মনে করে চিৎকার করলেন, "বিজয়.....,ও বিজয়......। কোথায় গেলি বাবা? " এমন সময় বাহির থেকে এক লাফে বাসায় এলো বিজয়। বিজয় ওনার ছেলের নাম। ১৫ বছর বয়স। শাহানা আফরোজ বললেন, " সকাল থেকে তো তোর কোনো পাত্তাই নেই!!! সারাক্ষণ কোথায় কোথায় টইটই করিস বল তো? নাওয়া খাওয়া সব ভুলে কোথায় ছিলি? " বিজয় তখন মায়ের দিকে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে থাকে। মায়ের চোখ মুখ ইদানীং কেমন যেন হয়ে গেছে! বড় মায়া লাগে বিজয়ের। হঠাৎ করে বলে ওঠে, মা আমি কিছু কথা বলব? ------ বল। ------ আচ্ছা, মা! আমি আগে তো রাফি, শিহাব, অনু ভাইয়া, তপু ওদের সাথে খুব খেলতাম। কত সুন্দর সাঁতার কাটতাম। বনে ঘুরে ফল পেড়ে খেতাম। গাছে ঝুলতাম। কিন্তু, এখন তুমি এখন আর আমাকে বের হতে দাওনা! কেন বলোতো ? আর আমাদের দেশের গ্রামে কত সুন্দর খেত ভরা ফসল, গোলা ভরা ধান, পুকুরে এত এত মাছ, কত ফুল - ফল....! কিন্তু দেখ, আমি প্রতিদিন দেখি বাসার সামনে দিয়ে শত মানুষ ব্যাগ, পুঁটলি নিয়ে কোথায় যেন চলে যায়। এখানেতো কোনো কিছুরই অভাব নেই। তাহলে এরা কেন এই দেশ ছেড়ে চলে যায়? তারা কী এই দেশকে ভয় পায়, মা? ওরা কী দেশকে একটু ভালোবাসতে পারে না, মা? বিজয়ের মুখে এসব শুনে মা অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকেন। একটু পরে বলতে শুরু করেন, " শোন রে খোকন! আমাদের দেশে কারা এসেছে, জানিস কিছু? " ---- শুনেছি, কজন দুষ্টু লোক নাকি দেশে ঢুকে প্রচুর তান্ডব চালা। অনেক মানুষকে নাকি ওরা মেরে ফেলছে। আমাদের দেশের মানুষকে ওরা কেন মারছে? বলোনা, মা। মা বলেন, " দেশে সকল কিছুই আছে। কিন্তু একটা জিনিসের খুব অভাব। আর তা হলো স্বাধীনতা। যাই থাক না কেন, স্বাধীনতা ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। বুঝলি? বিজয়ঃ স্বাধীনতা কীভাবে আনতে হয়। ওটা আনতেই কী মানুষ দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে? স্বাধীনতা বুঝি অন্য দেশে থাকে? এসব শুনে ওর মায়ের মুখে মুচকি হাসি দেখা গেল। তবুও চোখের কোণে দুই ফোঁটা পানি দেখা যাচ্ছে। তখন তিনি বিজয়কে বুঝিয়ে বলতে লাগলেন, "যদি তুমি তোমার নিজের মতো করে চলাফেরা করতে চাও, নিজের ভাষায় কথা বলতে চাও তাহলে তোমার স্বাধীনতার দরকার হবে।এর জন্য যে দেশে যুদ্ধ লেগে গেছে। এই ভয়েই মানুষ পালিয়ে যাচ্ছে। আচ্ছা, তুমি কী এখন অন্য ভাষায় কথা বলতে পারবে? তোমাকে যদি ঘরে আটকে রাখা হয়, থাকতে পারবে? " বিজয় বলে, মোটেও না! পারলেই বা কী? অন্য ভাষায় যদি তোমাকে মা ডাকি আমার মনের রেশ কেমন করে মিটবে বলোতো? আর, যুদ্ধ! তা তো অনেক ভয়ংকর। বিজয় অনেক দূর আন্দাজ করতে পারে! মা বলেন, ঠিক তাই। তাহলে শোন, সেদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ডাক দেন। আরো অনেক কিছু বলেন। তা শুনে অনেক মানুষ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। কেউ ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। এজন্যই তো দেশে এত অশান্তি। সেদিন শুনলি না, আমাদের গ্রামের কয়টা ঘর পুড়ে গেছে। ওই মিলিটারিরা খুব দুষ্ট। তাই আমরা যদি ঠিকভাবে বাঁচতে চাই, আমাদের স্বাধীনতা খুব প্রয়োজন। তাই তো তোকে বাইরেও যেতে দেই না। যদি ওরা তোকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে যায়। তুই ছাড়া আমার আর কে আছে বল? তাই তো তোকে চোখের আড়াল হতে দিতে চাইনা। বলেই তিনি শাড়ির আঁচলে মুখটি ঢেকে কাঁদতে শুরু করেন। এমন সময় কাঁপা একটা কন্ঠে আত্মবিশ্বাসের সাথে তিনি শুনতে পেলেন, " মা, আমি যুদ্ধে যাব। " শুনে শাহানা আফরোজের বুকটা ধড়ফড় করে ওঠে। " এ তুই কী বলছিস? " ------ হ্যাঁ, আমি যুদ্ধে যাব। মা অনেক বাঁধা দিয়েও ওর কথা থেকে ওকে এক চুলও সরাতে পারলেন না। অবশেষে, সন্ধ্যা নামল। সূর্য ডুবতে চলেছে। মা ওকে কিছু খাবার দিলেন। সাথে আরও কিছু পুঁটলি দিলেন। মা কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, সাবধানে থাকিস বাবা। কিছু দরকার হলে পুঁটলি থেকে নিয়ে নিস। আল্লাহকে স্মরণ করিস। আরেকবার ভেবে দেখ! ------আচ্ছা, মা। তুমি আমার জন্য দোয়া করো। তোমার বিজয় যেন দেশের বিজয় ছিনিয়ে আনতে পারে। ------ আচ্ছা, সাবধানে যাস। বিজয়ী হোস বাবা! দোয়া করি। এই বলে বিজয়কে নৌকায় উঠিয়ে দেন। ওকে দেখা যাওয়া পর্যন্ত তিনি অগুনতিবার চোখের পানি ফেলেন। ডিসেম্বর মাস চলে এসেছে। তার বিজয়ের কোনো খোঁজ তিনি পাননি। শুধু আগস্ট মাসে একটি চিঠি আর সাথে কিছু টাকা পাঠিয়েছিল বিজয়। ১৬ ই ডিসেম্বর। সকলবেলা। আজ হালকা ঠান্ডা হাওয়া বইছে। এমন সময় একজন একটি চিঠি দিয়ে যায়। তিনি ভেবেছিলেন তার বিজয় পাঠিয়েছে। খুলে পড়তে শুরু করতেই তিনি দেখেন এতে তার বিজয়ের মৃত্যুর কথা লেখা আছে। তিনি বিজয় বলে চিৎকার করতে শুরু করলেন। তার চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় পানি পড়তে শুরু করল। তার প্রানের ছেলে তাকে ছেড়ে চলে গেছে। তার বুকটা ফেটে যাচ্ছিল। বিকেলে খবর পান দেশ স্বাধীন হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তান হয়েছে বাংলাদেশ। শুনে তার বুকে ঝিলিক মেরে ওঠে। মনে পড়ে ২৮ জুলাইয়ের কথা। সেই দিনটা তার কাছে সবচেয়ে দামি দিন মনে হয়। কিন্তু ছেলে হারানোর দুঃখে তিনি কষ্টকে কিছু দিয়েই ঢাকতে পারছিলেন না। এখন তিনি যখনই কোথাও যান, মানুষ বলে ওঠে, " ঐ দেখ! বিজয়ের মা! আমাদের গর্ব শহীদ বিজয়ের মা! " এসব শুনলে তার বুকটা গর্বে ফুলে ওঠে। তার বিজয় আজ দেশের বিজয় এনেছে। অন্যরকম অনুভূতি তার মনে সৃষ্টি হয়। তিনি ভাবেন, ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের মাঝে তার কিশোর ছেলের রক্তটুকুও মিশে আছে। আজ তিনি নিজেকে গর্বিত মনে করেন। " আমাদের সকলের উচিত দেশকে মন প্রাণ দিয়ে ভালোবাসা। "