Naimur Rahman Nishan
অপ্রত্যাশিত মমতা পিছনের ডান পা থেকে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত। কিছুক্ষণ আগেই এক অটো রিকশার সাথে ধাক্কা লেগেছে বাচ্চাটার। মাথাতেও চোট পেয়েছে অনেকটা। আর হাঁটতে পারছে না সে। বাচ্চার মা এদিক সেদিক সাহায্যের জন্য ছুটোছুটি করছে। তার বা চোখের উপরে একটা ক্ষতের দাগ আছে। হয়তো অতীতে এমনই কোনো দুর্ঘটনায় এই ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছিল। বাচ্চাটা ব্যাথায় ছটফট করছে। মানুষের সাহায্য ছাড়া তাকে বাঁচানো সম্ভব না! মা বারবার মানুষের কাছে সাহায্যের জন্য ছুটে ছুটে যাচ্ছে। কিন্তু কোনো মানুষের মনেই একটু দয়া হচ্ছে না। কিছু মানুষ দূরে দাঁড়িয়ে বাচ্চাটাকে কাতরাতে দেখছে আর নিজেদের মধ্যে কী কী সব বলাবলি করছে। অবশেষে তিনটি ছেলে ও একটি মেয়ে এগিয়ে এলো বাচ্চাটির দিকে। মা বুঝতে পারল তারা তাকে সাহায্য করতে এসেছে। কাছে গিয়ে দ্রুত পায়ে ঘুরোঘুরি করতে শুরু করল। মানুষ হলে হয়তো বলত, “আমার বাচ্চাটার কী অবস্থা? দয়া করে ওকে হাসপাতালে নিয়ে চলুন!” কিন্তু কুকুর হওয়ার কারণে তা সে বলতে পারছে না, মানুষের সাথে কথা বলার ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা তাকে দেননি। সে শুধু ঘন ঘন বাচ্চাটাকে জিহ্বা দিয়ে চেটে দিচ্ছে। কিছুক্ষণ দেখেশুনে মানুষগুলোর মধ্যে একজন বলে উঠল, “অবস্থা তো ভালো না।“ আরেকজন ছেলে বলে উঠল, “ভেটের কাছে নিয়ে যেতে হবে। কুইক!” তারা বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিলো তারপর গাড়িতে করে পশু হাসপাতালের দিকে রওনা হলো। মা কুকুরটাও ছুটল গাড়ির পেছন পেছন। ছুটতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে কিন্তু সে এটুকু বুঝতে পেরেছে যে সৃষ্টিকর্তা তাকে সাহায্য করার জন্য কিছু ভালো মানুষকে পাঠিয়েছেন। পশু হাসপাতালের সামনে এসে গাড়ি থামল। মেয়েটির হাতে আহত কুকুরছানা। দ্রুত পায়ে তারা হাসপাতালে প্রবেশ করল। বাচ্চাটি অজ্ঞান হয়ে পড়েছে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই ডাক্তার আসলেন। ডাক্তার বেশ কিছুক্ষণ ধরে বাচ্চাটির চিকিৎসা করলেন অতঃপর সবার উদ্দেশ্যে বললেন, “খুব বাজে ভাবে পিছনের ডান পা আহত হয়েছে। হাড় ভেঙ্গে গেছে। মাথাতেও চোট পেয়েছে অনেকটা। আমি প্রয়োজনীয় সব ট্রিটমেন্ট করছি কিন্তু এখানে ট্রিটমেন্ট শেষ হওয়ার পর ওকে ছেড়ে দেওয়া যাবে না। কিছুদিন হাতে করে খাওয়াতে হবে, হাঁটাহাঁটি করতে দেওয়া যাবে না তাও পনেরো দিন। আর বাচ্চাটা তো বেশ ছোট ওর মা আছে?“ চারজনের মধ্যে একজন বলে উঠলো, “মায়ের খবর তো আমরা জানি না। যেখান থেকে বাচ্চাটিকে রেস্কিউ করেছি সেখানে অবশ্য ছিল কিন্তু এখন কোথায় পাব!” “এতটুকু বাচ্চা মা ছাড়া কী করে থাকবে? স্পেশাল কেয়ারের প্রয়োজন হবে। পারবেন আপনারা?” “হ্যাঁ পারব। আমাদের একটা সংগঠন আছে। সেখানে আমরা আহত পশুপাখিদের সেবা করে সুস্থ করি। সুস্থ হবার পর যদি কোনো সামর্থ্যবান ফ্যামিলি ওদের অ্যাডপ্ট করতে চায় তাদের কাছে দিয়ে দিই।“ “মানে পেট অ্যাডপশান সেন্টার আছে আপনাদের?” “জি সেরকমই।“ “আচ্ছা কিছু ফর্মালিটি আছে পূরণ করে বাচ্চাটিকে নিয়ে যাবেন। তিনদিন পর আবার একবার নিয়ে আসবেন।“ “আচ্ছা” সমস্ত নিয়ম-কানুন সম্পন্ন করে তারা বাচ্চাটিকে নিয়ে গেল। চারজন ছেলে-মেয়ের মধ্যে মেয়েটির নাম প্রিয়াংকা। প্রিয়াংকা সারাদিনই প্রায় বাচ্চাটির কাছে থাকে। ওকে খাওয়ানো, গোসল করানো, ওষুধ দেওয়া সব প্রিয়াংকাই করে। প্রিয়াংকা বাচ্চাটির একটা নাম দিয়েছে, ‘টুটুল’। টুটুলও প্রিয়াংকাকে খুবই ভালোবাসে। প্রাণী হলেও ও বুঝে যে প্রিয়াংকা ওকে সবার চেয়ে বেশি ভালোবাসে! ঠিক যেন মায়ের মত! মায়ের কথা মনে পড়তেই টুটুলের মন খারাপ হয়ে যায়। কে জানে তার মা এখন কোথায় আছে! জ্ঞান ফেরার পর থেকে মাকে আর দেখেনি সে। প্রায় দুই মাস কেটে গেছে, টুটুল এখন সুস্থ। একদিন ওদের বাসায় এক হাসি-খুশি মহিলা আর তাঁর দুই বাচ্চা এসে উপস্থিত হলেন। বাচ্চাগুলোর মধ্যে মেয়েটির বয়স হবে ছয় বা সাত বছর আর ছেলেটির দশ অথবা এগারো। টুটুল তখন প্রিয়াংকার কোলে বসে খেলা করছে। মহিলা বললেন তিনি টুটুলকে অ্যাডপ্ট করতে চান। প্রিয়াংকা তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন তাঁর কুকুর পালনের কোনো অভিজ্ঞতা আছে কিনা। মহিলা বললেন তাঁর দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা আছে ইনফ্যাক্ট সে বিয়ের আগে প্রায় বারো থেকে তেরোটি কুকুর পালতেন। ফর্মালিটি শেষ করে প্রিয়াংকা মহিলার হাতে টুটুলকে তুলে দিলেন। টুটুল বুঝতে পারছে তাকে দূরে কোথাও নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সে যেতে চায় না। তার মনে হয় না প্রিয়াংকার মতো কেউ তাকে ভালোবাসবে। সে তার ছোট ছোট হাত-পাগুলো দিয়ে আঁচড় কেটে বিরোধিতা জানাতে চেষ্টা করল কিন্তু কেউ বিষয়টাকে তেমন গুরুত্ব দিলো না। মহিলা নিয়ে চললেন টুটুলকে। দৃষ্টিসীমার বাইরে যাওয়া অবধি টুটুল চেয়ে থাকল প্রিয়াংকার দিকে। অবশেষে এসে পৌছালো নতুন ঠিকানায়। বেশ গোছানো পরিপাটি বাসা। এই বাসায় মহিলা তাঁর দুই বাচ্চা আর তাঁর স্বামী থাকেন। নতুন ঠিকানায় টুটুলের নতুন এক নাম দেওয়া হলো, “ওরিও”। ওরিওর দিন ভালোই কাটতে লাগল এখানে। ছোটবাচ্চা দুটো সব সময় ওর সাথে খেলতে থাকে। এখানে ওর জন্য অনেক খেলনা আছে, টেন্ট আছে। এখানে অনেক সুস্বাদু খাবার দেওয়া হয়। খাবারের কোনো কমতি নেই। উইকেন্ডে পুরো ফ্যামিলি ঘুরতে যায়, নিয়ে যায় তাকেও। ওই সময়টা ওরিওর অনেক ভালো লাগে। দেখতে দেখতে কেটে গেল কয়েকটা মাস। ওরিও এখন বেশ সুন্দর হয়েছে আর বেশ চটপটে, শক্তিশালী। তারা আজকে আবার ঘুরতে বের হয়েছে। কোথায় এসেছে তারা ওরিও তা জানে না। মাঝে মাঝেই এখানে আসে তারা। একটা বিশাল মাঠ; তাদের মত অনেক ফ্যামিলিই এসেছে এখানে, মাঠে বসে আছে। পাশেই বাচ্চাদের খেলার জায়গা। সেখানেই ওরিওর মালিকের দুই বাচ্চার সাথে ওরিও-ও খেলছে। বাচ্চা ছেলেটা ওরিওর জন্য একটা চিকেন লেগ পিস নিয়ে এসেছে। কিন্তু সেটা ওরিওকে দিচ্ছে না! একবার উপরে উঠাচ্ছে একবার নিচে নামাচ্ছে... ওরিও কিছুতেই নাগাল পাচ্ছে না। হঠাৎ বাচ্চাটা চিকেন পিসটা অনেক দূরে ছুঁড়ে মারল। ওরিও-ও ছুটল সাথে সাথে। পিসটা একটা জীর্ণশীর্ণ, হাড্ডিসার কুকুরের সামনে গিয়ে পড়েছে। সে ওটা মুখে নিয়ে ছিঁড়ে খেতে যাবে এমন সময় ওরিও সেখানে গিয়ে কুকুরটার গায়ে একটা থাবা বসিয়ে দিলো। লেগ পিসটা তখনও ওই কুকুরটার মুখে। ওরিও জোরে গর্জন করে উঠল। অপর দিকের কুকুরটাও রেগে গেছে! এখনি একটা যুদ্ধ বাধবে! যে জিতবে খাবার তার। দুজনই একে অপরের উপর তর্জন গর্জন শুরু করেছে। ওরিও দুই কদম সামনে এগিয়ে গেল। অপর দিকের কুকুরটার চোখও হিংস্রতায় ভরা! সে মাথা থেকে পা অবধি ওরিওকে দেখে নিলো। বয়স তার ওরিওর থেকে বেশি, জীবনের অনেক চড়াই-উৎরাই পার করেছে সে। বাঁচার জন্য, একবেলা খাওয়ার জন্য প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে সে। ওরিওর মত মানুষের আদরের পোষ্য হিসেবে বড় হওয়ার সুযোগ হয়নি তার। এ যুদ্ধ সে নিঃসন্দেহে জিতবে ভালো করেই জানে সে কিন্তু হঠাৎ ওরিওর পেছনের পায়ের দিকে লক্ষ করলো কুকুরটা। পায়ে একটা ক্ষত চিহ্ন আছে। ওরিও একটু খুঁড়িয়ে হাঁটে সেটিও তার দৃষ্টি এড়ায়নি। তারপর কুকুরটা ওরিওর চোখের দিকে চাইলো। ওরিও তখন যুদ্ধ করার জন্য সম্পূর্ণ তৈরি শুধু অপেক্ষা করছে অপর পক্ষের প্রথম আক্রমণ করার সে পালটা আক্রমণ করে কুকুরটার দফা রফা করে দিবে। কিন্তু অপর দিকের আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠা জীর্ণশীর্ণ কুকুরটা হঠাৎ কেমন যেন শান্ত হয়ে গেল! অপলক চেয়ে আছে ওরিওর দিকে। ওরিও কুকুরটাকে রাগানোর জন্য আরো দুবার দাঁত খিচিয়ে ঘেউ ঘেউ করে উঠল। কিন্তু এতক্ষণে কুকুরটা মাটিতে বসে পড়েছে; ওরিওর এমন উত্তেজনা আর রাগ যেন সে বেশ উপভোগ করছে। এক পর্যায়ে মুখের লেগ পিসটা মাটিতে রেখে দু কদম পিছিয়ে গেল কুকুরটা। ওরিও অনেক অবাক হলো। বিনা যুদ্ধে কেউ এভাবে অধিকার ছেড়ে দেয়! ওরিওর মনে প্রশ্ন জাগল, কে এ? কে বিনা যুদ্ধে তার জন্য খাবার ছেড়ে দিতে পারে? পিছন থেকে মানুষের কন্ঠ শোনা গেল। ওরিওর ওউনার এসেছেন, তিনি খুবই বিচলিত! বাচ্চা ছেলেটাকে বকছেন ওরিওর দিকে নজর রাখেনি তাই। তাঁর ধারণা আরেকটু হলেই রাস্তার কুকুরটা ওরিওর ক্ষতি করে দিত। হারনেস ধরে ওরিওকে পিছনে টানতে শুরু করলেন মহিলা। ওরিও ভীষণ বাধ্য ছেলে। মালিকের ডাকে সে পিছন ফিরে চলে যেতে লাগল কিন্তু যেতে যেতে শেষ বারের মত উত্তর পাবার আশায় পিছনে ঘুরে তাকালো। ওরিও দেখল কুকুরটা এখনো তাকেই দেখছে। কুকুরটার চামড়ার রং সাদা মাঝে মাঝে বাদামী রঙের ছাপ, মাথার অর্ধেকটা সাদা আর বাকি অর্ধেক বাদামী, চোখ দুটো ঘন কালো। আর সব থেকে বড় কথা বা চোখের উপরে কেটে যাওয়ার একটা চিহ্ন আছে। এই চিহ্ন ওরিও আগে কোথায় দেখেছে মনে করতে পারল না! আবার হার্নেসে টান পড়ল ওরিও চলে গেল মানুষগুলোর সাথে। পেছনে পড়ে থাকল মানুষের প্রিয় হয়ে উঠতে না পারা, প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে বেঁচে থাকা, জীর্ণশীর্ণ, ধুলো মাখা কুকুরটা। দেখতে থাকল ওরিওর দিকে যতক্ষণ না সে দূরে মিলিয়ে গেল! প্রিয়াংকার কাছে যখন ওরিও ছিল তখন মাঝে মাঝেই লুকিয়ে তাকে দেখে আসত কুকুরটা কিন্তু সেখান থেকে ওরিও চলে আসার পর আর কোনো খোঁজ পায়নি সে বাচ্চাটার। সেই চার মাসেরর বাচ্চাটা আজ কত সুন্দর হয়েছে! মায়ের মতই সাদা-বাদামী গায়ের রঙ, মায়ের মতই রাগ আর সাহস, মায়ের মতই ঘন কালো চোখ! হ্যাঁ একমাত্র মা-ই পারেন সন্তানের জন্য বিনা যুদ্ধে নিজের অধিকার ছেড়ে দিতে, পেটে আকাশ সমান ক্ষুধা জমিয়ে রেখে সন্তানের দিকে খাবার এগিয়ে দিতে।