মুক্তিযোদ্ধাদের কন্ঠে বিজয়

জিহাদ মোল্লা

১)মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন প্রথমে মনে হয়েছিল যে এটা সম্ভব না। কীভাবে আমরা স্বাধীন হয়ে গেলাম। তারপরে যে অনুভূতি হলো তা বলে বুঝানো সম্ভব না। -বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দা উবায়দুন্নাহার খুকু আহমেদ। ২)১৬ ডিসেম্বর বিকেল হতে না হতেই চারিদিকে সবাই হৈচৈ করে উঠলো। মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকার বিভিন্ন বিল্ডিং থেকে একটানা গুলিবর্ষণের শব্দ ভেসে আসছে। ঢাকায় এরই মধ্যে যে এতো মুক্তিযোদ্ধা ঢুকে পড়েছে তা কেউ টেরও পাইনি। আমরা কলেজের ছাদে গিয়ে দেখি চারিদিকেই হৈচৈ। গাড়ি করে মুক্তিযোদ্ধারা মতিঝিলের রাস্তায় ছুটে চলেছে আর আকাশের দিকে গুলি ছুঁড়ে জয়বাংলা শ্লোগান দিচ্ছে। চারিদিকে খবর ছড়িয়ে পড়েছে রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি হানাদাররা যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পন করেছে। দেখতে দেখতে বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে এলো। চারিদিকের বাড়িঘর থেকে মানুষ ততক্ষণে রাস্তায় নেমে এসেছে। আমরাও কলেজের সামনের রাস্তায় ছুটে গেলাম। বাংলাদেশ এখন থেকে স্বাধীন। ভাবতেই ভাল লাগছিল পাক সেনা এবং ফজলু রাজাকারদের ভয়ে এখন আর দিন কাটাতে হবে না। আমরা স্বাধীন ! মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রের গুলির শব্দ যেন খৈ ফোঁটার মতো আওয়াজ করে মতিঝিলের বড় বড় বিল্ডিংয়ে ইকো হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। সন্ধ্যার অন্ধ্যকারে ট্রেসার বুলেটের আলো যেন বিজয়ের আনন্দে সমস্ত ঢাকা শহরকে আলোকসজ্জ্বায় সাজিয়ে তুলেছে। সেদিন রাতেই আমরা কলেজ ছেড়ে বাসায় ফিরে আসি। আরামবাগের রাস্তায় যেন বিজয় মেলা বসেছে। একে অপরকে বুকে জড়িয়ে ধরে সকলেই বিজয়ের আনন্দ উপভোগ করছে। আমিও সকলের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করে বাসায় ফিরে এসে দেখি, বাড়ির সকলে খুশী হলেও মা খুব নিভৃতে নীরবে ঘরের এক কোনায় জায়নামাজ বিছিয়ে কোরান শরীফ পড়ছেন। দু’চোখে তাঁর পানি। দু’এক ফোঁটা চোখের পানি গড়িয়েও পড়েছে। আমরা সকলে আনন্দ করলেও আমার মায়ের মনে আনন্দ নেই। কারণ তাঁর সেজো ছেলে রশিদ ঘরে ফিরে আসেনি। ছেলে তাঁর আদৌ বেঁচে আছে কিনা জানেন না। আর বেঁচে যদি থাকে, তাহলে সে এখনও হয়তো দেশের কোন না কোন ফ্রন্টে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে চলেছে। মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার পর থেকে সেজভাইয়ের কোন খবর আমরা পাইনি। দেশ স্বাধীন হওয়ার বেশ কয়েকদিন পর অস্ত্রহাতেই বাড়ি ফিরেছিলেন। আর সেদিনই আমরা সকলে মিলে প্রথমবারের মতো আনন্দঘন পরিবেশে বিজয় উৎসব করেছি। -কোনো এক মুক্তিযোদ্ধার ভাই। -তথ্যসূত্র: যুগান্তর পত্রিকা। ৩)১৬ ডিসেম্বর সকল রাজাকারদের বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখল করে নেয় উত্তেজিত জনতা ও মুক্তিযোদ্ধারা। কিন্তু এসব লুট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনায় এসব নির্দিষ্ট স্থানে সংরক্ষিত করে রাখা হয়। যা পরে নিলামে বিক্রি করে শহীদ, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও যুদ্ধে বীরাঙ্গণাদের কল্যাণে ব্যায় করা হয়। -হাবিবুর রহমান। ৪)১৬ ডিসেম্বর বাঙালী জাতির জীবনে যেমন গৌরবের দিন, তেমনি প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধার জীবনে স্মরণীয় দিন। কারণ আমরা বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে যুদ্ধে যাই। তাই স্বাধীনতার চেয়ে আরাধ্য আর কিছু ছিলোনা আমাদের কাছে। -মুক্তিযোদ্ধা একে এম খাইরুল আলম ভুলু। ৫) বিজয়ের মাসে চিরবিদায় শ্রদ্ধা: মুক্তিযোদ্ধা-শহীদজায়া বেগম মুশতারী শফী প্রকাশ:২১ ডিসেম্বর, ২০২১ ১৮:০২আহমেদ রিয়াজ বিজয়ের মাসে চিরবিদায় শ্রদ্ধা: মুক্তিযোদ্ধা-শহীদজায়া বেগম মুশতারী শফী ২৭ মার্চ পাকিস্তানি সৈন্যদের কাছ থেকে অস্ত্রগুলো লুঠ করার পর রাখা হয়েছিল ‘মুশতারী লজ’-এ। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে অস্ত্রগুলো সরবরাহ করার সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন গৃহকত্রী মুশতারী শফী। কিন্তু তার প্রতিবেশী বিহারি এটা দেখে ফেলে। আর সেটা জানিয়ে দেয় পাকিস্তানি সৈন্যদের। তার বাড়ির তিনতলায় সেই অস্ত্রের সন্ধান পেয়ে যায় পাকিস্তানি সৈন্যরা। শুধু তাই নয়, তাদের বিরুদ্ধে এগারোটা অভিযোগ দাখিল করে। ১৯৭১ সালের ৭ এপ্রিল। বেলা ১১টা। একটা জিপ আর একটা লরি এসে থামল চট্টগ্রামের এনায়েত বাজারের ‘মুশতারী লজ’ নামের চারতলা বাড়ির সামনে। টপাটপ ৪০-৫০ জন পাকিস্তানি সৈন্য লাফিয়ে নেমে এল গাড়ি থেকে। বাড়ির ভিতর ঢুকে পড়ল সৈন্যরা। তারপর ধরে নিয়ে গেল ডা. আবদুল্লাহ শফীকে। সার্কিট হাউসে নিয়ে কিছুটা জেরা করে আবার ছেড়ে দিল। তবে ছেড়ে দেয়ার মূল কারণ ছিল, পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার বেগ ছিল ডা. শফীর রোগী। এলাকায় দাঁতের ডাক্তার হিসেবে বেশ সুনাম ছিল তার। এরপর ঘরে ফিরে দুপুরের খাবার খাওয়ার সময় আবারও পাকিস্তানি সৈন্যরা হানা দিল বাড়িটিতে। তারপর পুরো বাড়ি তল্লাশি চালিয়ে খুঁজে পেল অনেক অস্ত্রশস্ত্র। ২৭ মার্চ পাকিস্তানি সৈন্যদের কাছ থেকে অস্ত্রগুলো লুঠ করার পর রাখা হয়েছিল ‘মুশতারী লজ’-এ। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে অস্ত্রগুলো সরবরাহ করার সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন গৃহকত্রী মুশতারী শফী। কিন্তু তার প্রতিবেশী বিহারি এটা দেখে ফেলে। আর সেটা জানিয়ে দেয় পাকিস্তানি সৈন্যদের। তার বাড়ির তিনতলায় সেই অস্ত্রের সন্ধান পেয়ে যায় পাকিস্তানি সৈন্যরা। শুধু তাই নয়, তাদের বিরুদ্ধে এগারোটা অভিযোগ দাখিল করে। এই অভিযোগগুলো ধরে তাকে জেরার পর জেরা করতে থাকল এক পাকিস্তানি মেজর। সত্য মিথ্যা মিলিয়ে সেই অভিযোগ থেকে নিজেদের বাঁচাতে যুক্তিতর্ক করেছিলেন মুশতারী শফী। বেগম মুশতারী শফী তার বইতে লিখেছেন- ‘‘মেজর খান আবার আমাকে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো, আর মিসেস শফী, তুমি বলছো আওয়ামী লীগ করো না। অথচ পাবলিক মিটিং, মিছিল এসব করলে কেন?’ বিস্ময়ের পর বিস্ময় আমাদেরকে হতবাক করে দিচ্ছে। এসব এরা জানল কী করে? ‘বলো, চুপ করে কেন? তুমি সরকারের বিরুদ্ধে মিছিল করোনি?’ বললাম, ‘না।’ ‘তব্ ইয়ে কৌন হ্যায়, জারা গওরসে দেখো তো?’ একটা ছোট্ট চামড়ার ব্যাগ থেকে ফটো বের করে ওরা আমার চোখের সামনে ধরল। আর কথা নেই। বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে দেখছি মেজর খানের হাতে ধরা ছবিতে মহিলা পরিষদের ব্যানার। ব্যানারের একদিকে ছাত্র ইউনিয়নের মেয়ে সীমা চক্রবর্তী, অন্যদিকে দিল আফরোজ ধরে আছে। মাঝখানে কবি সুফিয়া কামাল, উমরাতুল ফজল, মালেকা বেগম, হান্নানা আর আমাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। পিছনে অগণিত মহিলা। তাদের মুষ্টিবদ্ধ হাত উপরে তোলা।” - বেগম মুশতারী শফি ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে হানাদারের আক্রমণের পর বঙ্গবন্ধুই দেন স্বাধীনতার ডাক, শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। তা সফল পরিণতি পায় নয় মাস পর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে। স্বাধীন হয় আমাদের দেশ।ডিসেম্বর মাস আমাদের জাতির বিজয়ের মাস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী, সামরিক বাহিনী এবং তাদের সহযোগীরা পরাজয় স্বীকার করে আত্মসমর্থন করতে বাধ্য হয়। বিশ্বের বুকে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় হচ্ছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ-স্বাধীনতা-বাংলাদেশের অভ্যুদয়। এই গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের মহানায়ক হচ্ছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ', 'স্বাধীনতা', 'বাংলাদেশ’, ‘বঙ্গবন্ধু এই শব্দগুলো অবিচ্ছেদ্য। এগুলোকে সমার্থকও বলা যেতে পারে; একটিকে আরেকটি থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। আমাদের জনগণের দীর্ঘ সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের ঘোষণা প্রদান করেন। বীর জনগণ সর্বশক্তি নিয়ে আক্রমণকারী সশস্ত্র পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ৩০ লাখ মানুষ জীবন দিয়েছেন। এক কোটি মানুষ দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। কোটি কোটি মানুষ নানাভাবে নির্যাতিত, নিপীড়িত, ক্ষতিগ্রস্থ, লুণ্ঠিত, অত্যাচারিত, মা-বোনের ইজ্জত-সম্ভ্রম, সব হারিয়ে লড়াই চালিয়ে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় পতাকা উড়িয়ে মাতৃভূমি স্বাধীন করেছেন।আমাদের নতুন প্রজন্মকে বর্তমান যুগের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বিশ্বমানের শিক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তিতে দক্ষ এবং সততা, নিষ্ঠা, জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ ও শ্রদ্ধাশীল, নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন, দেশপ্রেমে উজ্জীবিত পরিপূর্ণ মানুষ তৈরি করার মহান কর্মযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছি। এই পথেই আমাদের দেশকে মর্যাদাশীল রাষ্ট্রে পরিণত করতে আমাদের সফল হতে হবে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ও আদর্শ এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সমগ্র জাতি সেই ধারাবাহিকতায় এগিয়ে যেতে সক্ষম হবে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিজয় সার্থক হবে। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।